Sunday, March 25, 2018

স্বপ্নস্বরূপ - ১৬ / ন ন্দি নী সে ন গু প্ত




গত বছর এমনই কোনও বসন্তের দিনে কবির কথা মনে করতে গিয়ে লিখেছিলাম যে অপেক্ষায় আছি এরকম কোনও বসন্ত উৎসবের যেখানে উদযাপনের প্রাণশক্তির প্রকাশ ঘটাতে গিয়ে কেউ কাউকে পাঁকে টেনে নামানোর খেলায় মেতে উঠবে না। আশা মরে না, তাই অপেক্ষাও মরেনি।  এই জগতে নিয়ত চলেছে সুন্দর-অসুন্দরের লড়াই। কবি নিজের জীবন দিয়ে যেন সুন্দরকে জিতিয়ে দিয়ে যেতে চান বারে বারে। বসন্তের আগমন তাই তার কাছে এরকমই একটা লড়াই। কিন্তু সুন্দর যে কখনো খুব উচ্চকিত নয়। সে জোরগলায় ঝগড়াটুকু অবধি করে উঠতে পারে না, তবে লড়াই করবে কীভাবে? সুন্দরের ‘করুণ চরণ’ সে বিছিয়ে দেয় আঁধার কর্দমলাঞ্ছিত পৃথিবীর বুকে। সে দুর্বল। তবে এই দুর্বলতার মধ্যেই নিহিত তার শক্তি। অন্ধকারকে দমিয়ে  রাখবার মত প্রবল পৌরুষ হয়ত বা তার নেই, কিন্তু আছে সদিচ্ছা, আছে শুভকামনা। হয়তো বা সেই কারণেই বসন্ত বার বার আসে এই পৃথিবীর বুকে। মনে করিয়ে দেয়, অসুন্দরের  বিরুদ্ধে, রিক্ততার বিরুদ্ধে হেরে গেলে চলে না। নতুন পাতায়, ফুলে পৃথিবীকে সাজিয়ে দিতে চায় সে। এই আগমন যেন এক উপাসনায় রূপান্তরিত হয়। কবি উচ্চারণ করেন,
‘--- কুঞ্জে কুঞ্জে জাগিছে বসন্ত পুণ্যগন্ধ,
        শূন্যে বাজিছে রে অনাদি বীণাধ্বনি
......’
অসুন্দরের কুৎসিত আঘাত অজস্রবার সয়েছেন কবি। হয়তো বা চরম হতাশায় কখনো বলেছেন, ‘...মনে হল,  মানুষ অন্যায়ের আগুনে আপনার সমস্ত ভাবী কালটাকে পুড়িয়ে কালো করে দিয়েছে,  সেখানে বসন্ত কোনোদিন এসে আর নতুন পাতা ধরাতে পারবে না। ... তখন এত দিনের আয়োজন আবর্জনা হয়ে ওঠে। তখন চারি দিক থেকে শুনতে পাই,  জয়, পশুর জয়। তখন শুনি, “আজও যেমন কালও তেমনি। সময় চোখে-ঠুলি-দেওয়া বলদের মতো, চিরদিন একই ঘানিতে একই আর্তস্বর তুলছে। তাকেই বলে সৃষ্টি। সৃষ্টি হচ্ছে অন্ধের কান্না। মন বললে, “তবে আর কেন। এবার গান বন্ধ করা যাক। যা আছে কেবলমাত্র তারই বোঝা নিয়ে ঝগড়া চলে, যা নেই তারই আশা নিয়েই গান।...... ‘ হ্যাঁ, এই জায়গায় এসে ভাবতে বাধ্য করেন কবি। সময়ের আর্তনাদ কীভাবে তাকে স্পর্শ করেছিল যে তিনি ভেবেছিলেন, ‘এবার গান বন্ধ করা যাক!’ আমরা ভুলে যাই যে তিনি স্রষ্টা, যেকোনো ক্ষুদ্র অসাম্য, তুচ্ছ বিরূপতাও এড়িয়ে যেতে পারেনা তার চোখ, তার অনুভব। হয়তো বা সময়ের দাবী মেনে চুপ করে যেতে চান তিনি সেখানে, যেখানে সমস্ত কোলাহল ছাপিয়ে শোনা যাবেনা বসন্তের কুহুতান। হয়তো বা বিলুপ্ত হয়ে যেতে চাইবে সুর, মুছে যেতে চাইবে সৌন্দর্য। কিন্তু সেই মুছে যাবার আগের মুহূর্তে, যখন তার অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে, তখন কি ঘুরে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে চাইবে না সুন্দরের দাবী? যতই দুর্বল হোক সে, যতই মৃদু হোক তার কণ্ঠস্বর, ধ্বংসস্তুপের পোড়া ছাইয়ের ভিতর থেকে হয়তো বা ফিনিক্স পাখির মত ডানা মেলে দেবে সে, যে আগের মুহূর্তে মরে গিয়েছিল। কীভাবে? সেই যে কবি বলেছেন, যা নেই, তারই আশা নিয়ে মানুষ গান গায়। চরম আশাবাদী সুরে তাই কবি বলে ওঠেন পথে নামার কথা, বলেন বীণায় সুর লাগাবার কথা।
সুন্দরকে এবং সদিচ্ছাকে প্রতি পদে বাধার সম্মুখীন হতে হয়, সে কথা চরম সত্যি। সে শিক্ষা কবি নিশ্চয়ই পেয়েছিলেন নিজের জীবন দিয়েই, নাহলে কেন তিনি বলে উঠবেন, ‘বড় বড় বুদ্ধিমান লোকের সৌন্দর্য্যের উপর বড় একটা বিশ্বাস নাই, সৎ-উদ্দেশ্যের প্রতি অকাট্য সংশয় বিদ্যমান। এই জন্য সৎকার্য্যের নাম শুনিলেই ইহাঁদের সংশয়কুঞ্চিত অধরৌষ্ঠের চারি দিকে পাণ্ডুবর্ণ মড়কের মত একটা বিষাক্ত হাসি ফুটিয়া ওঠে। অতিবুদ্ধিমান জীবের সম্মুখের দাঁতের  পাটিতে যে একটা দারুণ হাস্যবিষ আছে, হে জগদীশ্বর, সেই বিষ হইতে পৃথিবীর সমুদয় সৎকার্য্যকে রক্ষা কর। ইহাঁরা যখন পরস্পর টেপাটিপি করিয়া বলিতে থাকেন “এই লোকটার মৎলব বুঝিয়াছ? কেবল আমাদের খোশামোদ করা “ বা “অমুকের নিন্দা করা “ বা “সাধারণের কাছে নাম পাইবার প্রয়াস” – তখন সৎলোকের জীবনের মূলে গিয়া কুঠারঘাত পড়ে, তাহার সমস্ত জীবনের আশা ম্রিয়মাণ হইয়া যায়।’ এইখানে এসে মনে হয়, তাহলে কি অতিবিজ্ঞতার সাথে সুন্দরের বিরোধ আছে কোথাও? সম্ভবত আছে। স্বার্থবুদ্ধি হয়তো কোথাও মানুষকে সুন্দরের পরিপূর্ণ রসাস্বাদনে বাধা দেয়। মানুষ যদি সচেতন হয়ে ভাবতে বসে, এই সুন্দরে আমার কী লাভ? ব্যস, তাহলে আর সুন্দর তার কাছে ধরা দেবেনা কোনওদিন। সেই অর্থে সুন্দর হয়ত বা চঞ্চল। 
তার সেই চঞ্চলতাকে তিনি চিনতে পারেন, কারণ তিনি যে কবি। তার ভাষায় তাকে বেঁধে রাখেন সহজ সরল ভঙ্গীতে। প্রকৃতির মাঝে যা স্বাভাবিক, অমোঘ-- সেখানেই চোখে আঙুল দিয়ে তিনি দেখিয়ে দিতে পারেন সুন্দরের অধিষ্ঠান। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ব্যাপ্ত প্রাণশক্তির মধ্য থেকে খুঁজে  নিয়ে সঠিক পর্দায় বেঁধে রাখতে পারেন গানের সুর। কবি আনন্দগান গেয়ে বলে ওঠেন, ‘‘ভয় নেই, ভয় নেই!... এই তো মূল সুর আমি বেঁধে রেখেছি, এই আদি প্রাণের সুর। সকল উন্মত্ত তানই এই সুরে সুন্দরের ধুয়োয় এসে মিলবে আনন্দের গানে। সকল পাওয়া, সকল দেওয়া ফুলের মতো ফুটবে, ফলের মতো ফলবে        

    




No comments:

Post a Comment

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া