তৃতীয়
দিনের যাত্রা
আজ আমাদের যাত্রা হবে নদী
অর্থাৎ ভাগীরথীর ওপারে। কাল যেদিকে গিয়েছিলাম আজ যাত্রার শুরু তার উল্টোদিকে।
কিন্তু একটু পরে গিয়ে নদীর ব্রিজ পেরিয়ে আমরা আবার সেই একই দিকে অর্থাৎ উত্তর দিকে
চলেছি। এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার। যারা মুর্শিদাবাদ ভ্রমণে যাবেন তারা যেমন
সরাসরি মুর্শিদাবাদে গিয়ে নামতে পারেন আবার বহরমপুরেও থাকতে পারেন। মুর্শিদাবাদ
বহরমপুরের তুলনায় ছোট শহর। সেখানে সব সুবিধে পাওয়া যায় না। বহরমপুর জেলার সদর শহর
আর বেশ বড় শহর। তাই বহরপুরে থেকেও মুর্শিদাবাদ অনায়াসে ঘুরে আসা যায়। যেমন আমরা
করেছিলাম। যারা বহরমপুরে থাকবেন তাদের মুর্শিদাবাদ দেখতে যেতে হবে উত্তরে। যেমন
আমরা চলেছি। আর যারা মুর্শিদাবাদে থাকবেন তাদের আসতে হবে দক্ষিণে। অর্থাৎ আমাদের
ঠিক উলটো দিকে। এই যা পার্থক্য।
হাইওয়ে বেশ ভালই লাগছিল।
সুন্দর সুবিস্তৃত ঝকঝকে এক রাস্তা। চারিদিকে বিস্তীর্ণ প্রান্তর। বিশুদ্ধ অক্সিজেন
নেবার প্রশস্ত এক পরিসর। উন্মুক্ত প্রকৃতির বুক চিরে যখন কোনও দীর্ঘ পথ বয়ে চলে
তখন আমার খুব আনন্দ হয়। আমার মন গাইতে থাকে মুক্তির জয়গান, হারিয়ে যেতে নাই মানা।
একটু পরেই অবশ্য হারিয়ে
যেতে হল। চওড়া হাইওয়ে ছেড়ে আমাদের গাড়ি ধরল মাঠের মধ্যে দিয়ে এক সর্পিল সংকীর্ণ
পথ। সর্পিল বা সার্পেন্টাইন কথাটা অনেকে শুনেছেন। সাপের চলার আঁকাবাঁকা গতির
সঙ্গেও আমাদের সকলেরই পরিচয় আছে অল্পবিস্তর। কিন্তু এই সার্পেন্টাইন শব্দটা যে এত
ক্লান্ত, এত বিরক্তি আর এত আশঙ্কার জন্ম দিতে পারে তা এই আঁকাবাঁকা পথটাকে না
দেখলে বিশ্বাস হত না। সরু এবড়ো খেবড়ো রাস্তার দুদিকে খাদ। তার মধ্যে দিয়েই হুস হুস
করে বয়ে চলেছে সব গাড়ি। কত ট্রাক্টর মাটি কেটে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে দিব্বি। কেউ কেটে
নিয়ে যাচ্ছে আবার কেউ বা কাটতে যাচ্ছে। দুই মুখ থেকে আসা গাড়িগুলোকে দেখে ভয় আর
বাগ মানছিল না। এই বুঝি একটা গিয়ে পড়ল নিচে মাঠের মধ্যে। আমি ঈষৎ আশংকিত হয়ে
চালককে জিজ্ঞেস করি ফেরার সময় আমাদের আবার এই পথ অতিক্রম করতে হবে কিনা। চালক
আশ্বস্ত করল, না ফেরা হবে অন্য পথা দিয়ে।
রাস্তার দীর্ঘ
অস্বাচ্ছন্দকর এক যাত্রার পরিসমাপ্তি ঘটল অবশ্য এক সময়। আমাদের প্রথম দর্শনীয়
স্থান হল কীরিটেশ্বরী মন্দির। একান্ন মহাপীঠের একটি। এখানে সতীর মুকুট অর্থাৎ
কীরিট পড়েছিল তাই এমন নাম। এখানে মন্দির আর তার ভেতরে পুজো দেওয়া ছাড়া দর্শনীয়
তেমন কিছু নেই। দেবী এখানে ‘বিমলা’। এক হাজার বছরের পুরোন এই মন্দির হল মা
‘মহামায়ার’ নিদ্রাস্থল বলে সকলের বিশ্বাস। আর স্থানীয়দের মধ্যে এই মন্দিরের
পরিচিতি হল ‘মহিষমর্দিনী’ নামে। ১৪০৫ সালে ধ্বংসপ্রাপ্ত এই মন্দিরটি উনবিংশ শতকে
পুনর্নিমিত হয় লালগোলার রাজা দর্পনারায়ণের দ্বারা আর এটিই মুর্শিদাবাদের সবচেয়ে
প্রাচীন মন্দির। প্রতি বছর পৌষ মাসের প্রতি মঙ্গল আর শনিবারে এখানে মেলা বসে।
এরপরে আমরা গেলাম যেখানে
তার দৃশ্য, বৈভব আর প্রাচুর্য দেখে মোহিত বা হয়ে উপায় নেই। বিশাল চত্বর জুড়ে
সম্পূর্ণ শ্বেত পাথরের তৈরি বিরাট এক মন্দির আর আশ্রম। এটি হল দহপাড়ার শ্রী প্রভু
জগদ্বন্ধুসুন্দরের আশ্রম। আম আর বকুল গাছের সবুজ শোভায় আমোদিত যেন এক স্বপ্নকুঞ্জ।
কুঞ্জদাস ব্রহ্মচারীর তৈরি নয়ন মনোহর এই আশ্রমে বহু দূরান্তরের ভক্ত সমাগম হয়।
পুজোর ভোগের জন্যে এখানে সকাল এগারটার মধ্যে টিকিট কাটতে হয়। এগারটায় এই মন্দিরের
বিগ্রহস্থল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিগ্রহ দর্শন আমাদের হয় নি।
পর পর দুটি মন্দির
দর্শনের পর আমরা পৌঁছে গেলাম সুজাউদ্দিনের কবরখানায়। সুজাউদ্দিন খাঁ ছিলেন
মুর্শিদকুলি খাঁর জামাই। তার স্ত্রী ছিল মুর্শিদকুলির মেয়ে আজিমুন্নেসা।
সুজাউদ্দীন খাঁর কবর দর্শন করে এবার আমরা ঢুকছি খোসবাগে। যেখানে শায়িত এক বিখ্যাত
ব্যক্তির মধ্যে হলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা। সুজাউদ্দীনের ছেলে
সরফরাজের সিপাহশালার ছিলেন আলীবর্দী খাঁ। পরে যিনি নবাব হয়েছিলেন বাংলার। এই
আলীবর্দীর নাতি হলেন সিরাজ।
আলীবর্দীর স্বপ্নের স্থান
ছিল খোসবাগ। প্রথমে নাম ছিল খুসবু বাগ। সেখান থেকে খোসবাগ। কথিত আছে এখানে ১০৮
রকমের গোলাপ চাষ করাতেন নবাব আলীবর্দী খাঁ। নবাবের স্ত্রী সইফুন্নেসা বেগম আর তিন
মেয়ে ঘষেটি বেগম, আমিনা বেগম আর মুভিনা বেগমের পরপর সমাধি রয়েছে এখানে। আমিনা বেগম
ছিলেন সিরাজের মা আর ঘষেটি বেগম ছিল মাসি যার নাম ইতিহাসে বেশ পাওয়া যায়। ঘষেটি
বেগমের কথা আগেও বলেছি মোতিঝিলের গল্প বলার সময়। কথিত আছে ঘষেটি বেগমের চক্রান্তেই
নাকি নবাব সিরাজ বন্দী হয়েছিলেন ইংরেজদের হাতে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব
পরাজিত হয়ে এক বিশ্বস্ত ব্যক্তির ছদ্মবেশ ধারণ করে পালিয়ে যাওয়ার পথে ধরা পড়েন
শুধু তার পায়ের জুতো জোড়ার জন্যে। কারণ বেশ পাল্টালেও এগুলি তিনি পাল্টাতে ভুলে যান।
নৌকোর মাঝি তাঁকে চিনতে পারে আর ইংরেজদের হাতে ধরিয়ে দেয়। অবশ্য মীরজাফরের ছেলে
মীরণের পরামর্শে ইংরেজরা বহু টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল সিরাজকে ধরিয়ে দেবার
জন্যে।
বন্দী অবস্থায় সিরাজ তাঁর
আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা থেকে
প্রায় সতের জন আত্মীয় আসেন। কিন্তু সিরাজ সমেত এই ১৭ জনকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা
হয়। খোসবাগে দাদু আলীবর্দীর কবরের কাছেই কবর দেওয়া হয় সিরাজকে। আর একটু দূরে বাকি
১৭ জনকে। খানিক দূরে মাঠের মধ্যে একটি কুয়োতে সমাধি দেওয়া হয় সিরাজকে ধরিয়ে দেওয়া
সেই বিশ্বাসঘাতককেও। তাই খোসবাগের ঐতিহাসিক গুরুত্ব যেমন বেশী তেমনি তা পর্যটকদের
দৃষ্টি আকর্ষণ করতেও বেশ সমর্থ। একটু দূরেই আছে রেসিডেন্সি সিমেট্রি যাতে আছে
তৎকালীন ইংরেজ রাজপুরুষদের কবর।
এবার কাশিমবাজার।
কাশিমবাজার স্টেশনের অদূরে আছে কাশিমবাজার বড় আর ছোট রাজবাড়ি। কৃষ্ণকান্ত নন্দী
ছিলেন এই রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা। কথিত আছে সিরাজ ইংরেজদের কাশিমবাজার কুঠি আক্রমণ
করলে ওয়ারেন হেস্টিংসকে কৃষ্ণকান্ত নন্দী যিনি কান্তমুদি নামে পরিচিত ছিলেন, নিজের
বাড়িতে আশ্রয় দেন আর পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। এরপর হেস্টিংস যখন বাংলার গভর্ণর
হন তখন দিল্লীর বাদশার কাছে সুপারিশ করে কৃষ্ণকান্তর ছেলে লোকনাথকে মহারাজা করেন
আর নাম হয় মহারাজা লোকনাথ রায় বাহাদুর। আস্তে আস্তে এই রাজবাড়ি বিরাট হয়ে যায়। এটি
হল কাশিমবাজার বড় রাজবাড়ি। এর থেকে একটু দূরে আছে ছোট রাজবাড়ি। এই ছোট রাজবাড়িই
বর্তমানে পর্যটকদের জন্য খোলা হয় আর এর মধ্যে একটি মিউজিয়াম সমেত বহু জিনিস দেখার
আছে। নিকটেই আছে ডাচদের কবর।
ছোট রাজবাড়ির থেকে বেরিয়ে
আমরা এলাম পাতালেশ্বর মন্দির ও সংলগ্ন সতীদাহ ঘাট দেখতে। পাতালেশ্বর মন্দিরে ঢোকার
মুখেই রাস্তার এপারে রয়েছে শিবের বিরাট ধ্যনমগ্ন এক মূর্তি। গেট পেরিয়ে আমরা বাগান
ও মন্দিরে ঢুকলাম। সম্পূর্ণ শ্বেতপাথরের মন্দিরের ঠিক গায়েই আছে বিশাল পুরোন এক
বটগাছ। এর পাশেই বিরাট এক জলাশয়। তার অনেকগুলি ঘাটের একটাকে সতীদাহ ঘাট বলে অভিহিত
করা হয় কথিত আছে বহু অতীতে এই ঘাটে সতীদাহ হত। এখন অবশ্য মাছ ধরা হচ্ছে দেখলাম।
বিরাট বাগানে রঙ বেরঙয়ের অনেক ফুল আর এক গোশালা নজরে পড়ল। এখানে আছে সত্তরটি গরু
যাদের দুধ এই মন্দির আর আশ্রমের কাজে লাগে। খুব ভাল লাগবে এই ফলে ফুলে ভরা বাগান
সমেত মন্দির পরিদর্শন করতে।
দেখেছি ব্যাসপুরের
শিবমন্দির। যা পন্ডিত কৃষ্ণনাথ রায় পঞ্চাননের বাবা পন্ডিত রাম কেশব দেবের দ্বারা
১৮১১ সালে প্রতিষ্ঠিত। ছোট অথচ অপূর্ব সুন্দর এই মন্দির রাজা যোগেন্দ্র বাহাদুর
রায়ের দ্বারা ১৯১৮ সালে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এটি সত্যিই একটি দর্শনীয় স্থান ও বিষয়।
গত কালকের থেকে আজ কিন্তু
দর্শনীয় বস্তুর তালিকা বেশ ছোট ছিল। তাই ফিরেছিও একটু আগে। এসে বহরমপুরের রাস্তায়
একটু পদচারণা আর তার সঙ্গে পরিচয় পর্ব গাঢ় করে লজে ফিরেছি। কাল ফেরার পালা। তাই
গোছানোর পালা তো বটেই। তাই সময় নষ্ট না করে ডাইনিং-এ গিয়ে চিকেন আর ভাত খেয়ে টিভি
দেখা আর ঘুম।
চতুর্থ
দিনের যাত্রা
বহরমপুর থেকে আমাদের গাড়ি
ছিল সকাল দশটা পঞ্চাশ। পৌঁছেছি সময়মত। আর সময়ের ট্রেন সময়ে আসায় আমরা উৎফুল্ল।
গাড়ি সওয়া তিনটে নাগাদ শিয়ালদহ পৌঁছবে। রিজার্ভড কম্পার্টমেন্টে বসে আমার বন্ধু
যখন খরচ খরচার হিসেব নিয়ে ব্যস্ত তখন আমিও ব্যাপৃত ছিলাম আর একটা হিসেব নিয়ে। সেটা
হল চাওয়া পাওয়ার হিসেব। এই ভ্রমণে যা চেয়েছি পেয়েছি যেন তার চেয়ে অনেক অনেক গুণ
বেশি। শুধু অতীত নয়, নয় শুধু মন খারাপ করা কবরস্থান, মুর্শিদাবাদে ইতিহাস আছে
উজ্জ্বল হয়ে। কবরের গাঢ় নিঃশ্বাস বন্ধ করা অন্ধকারেও আছে ইতিহাসকে জানার আলোর
আশ্বাস। এটা কি কম কথা।
চারটের মধ্যেই পৌছে গেছি
বাড়িতে। আবার সেই একঘেয়ে বর্তমান। সেই একঘেয়ে রোজনামচার চর্বিত চর্বন। তার মাঝেই
স্মৃতি হিসেবে মুর্শিদাবাদ উঁকি দিয়ে যাবেই মনের অন্দরে।
[শেষ]
Aro cholle bhalo lagto.
ReplyDeleteEbar natun kichur protikhyaye.