Wednesday, April 25, 2018

ধারাবাহিক / স্বপ্নস্বরূপ – ১৭ / ন ন্দি নী সে ন গু প্ত






স্বাগত বাংলা নববর্ষ ১৪২৫। বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি - এ বিষয়ে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে কারো কোনও দ্বিমত নেই। তবুও নববর্ষের বাঙালিয়ানাটুকু কীভাবে যেন মরে যেতে যেতেও বেঁচে গিয়েছে নানা প্যাকেজ গুছিয়ে রাখা এক বিজ্ঞাপনের মত। সেই প্যাকেজের গায়ের লেবেলটুকু সাজিয়ে দেবার জন্য বাঙালি এখনো রবীন্দ্রনাথকেই আঁকড়ে ধরে আছে। এই আঁকড়ে ধরাটাই সম্ভবত মরতে মরতে বেঁচে যাওয়ার একটা অন্যতম কারণ। হ্যাঁ, এই ব্যাপারে কোনও দ্বিমত নেই যে বাঙালি এখনো নানা বিজাতীয় সংস্কৃতির কালবৈশাখী ঝড়ের মুখে যেনতেন প্রকারেণ ‘রবীন্দ্রনাথ’ নামের খড়কুটোটুকু আঁকড়ে ধরতে চায়।    
প্রশ্ন উঠতে পারে যে ‘খড়কুটো’ বলছি কেন? তিনি তো মহীরুহ। ছায়া দিয়ে যাচ্ছেন নিরন্তর। সত্যিই কি তাই? সে ছায়াটুকুর কতখানি মর্যাদা দিয়েছি আমরা? কবিপক্ষ কেটে গেলে তাকে এবং তার ভাবনার শিক্ষাটুকু মনে রাখবারও দায় থাকেনা আমাদের। আমরা নিজেরাই কি সেই গাছকে ভুলে গিয়ে তাকে খড়কুটোয় পরিণত করিনি? নিজেকে চিনে  নেবার, জেনে নেবার যে অপরিসীম ভাবনা নিয়ে আমরা জীবনের পথে চলেছি প্রতিদিন, সেখানে তাকে আঁকড়ে ধরলে যে সেই ভার লঘু হয়ে যায়, সেকথা হয়তো ভুলেই গিয়েছি।
মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে তিনি একাই কি ধর্মের মতই ধারণ করে রাখতে পারেন আমাদের? উত্তরে আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করে প্রচণ্ড শব্দে ‘হ্যাঁ’ বলতে সাধ জাগে। আমরা যারা দিশেহারা এই মুহূর্তে, তাদের জন্য অবশ্যই তিনি এক বিরাট অবলম্বন হয়ে উঠতে পারেন রবীন্দ্রনাথ।   
স্বপ্নস্বরূপের সঙ্গ খুঁজে ফিরেছিলেন কবি। এই খোঁজই ছিল তার জীবনচর্যা। জীবনের যাত্রাপথের বাঁকে বাঁকে  রেখে গিয়েছেন অজস্র মণিমুক্তা এবং তিনি নিজেই হয়ে উঠেছেন আমাদের জীবনের স্বপ্নস্বরূপ। আসলে আমরা  ঈশ্বরের উপস্থিতি টের পেলেও তাকে বুঝবার শক্তি জুটিয়ে উঠতে পারিনা। তার ক্ষেত্রেই এমনটিই হতে চলেছে। ঈশ্বরকে গজদন্তের সিংহাসনে বসিয়ে রেখে তার জন্মতিথি পালনের আচার অনুষ্ঠানটুকু যান্ত্রিকভাবে করে চলেছি আমরা এবং তার শিক্ষার মূল ভাবনা বিস্মৃত হয়েছি।
তিনি বলে গিয়েছিলেন, ‘জগতে স্বার্থপর হইবার যো নাই। পরার্থপরতাই এ জগতের ধর্ম। এই নিমিত্তই মানুষের সর্বোৎকৃষ্ট ধর্ম পরের জন্য আত্মোৎসর্গ করা। জগতের ধর্ম আমাদিগকে আগে হইতেই পরের জন্য উৎসৃষ্ট করিয়া রাখিয়াছে, সে বিষয়ে আমরা জগতের জড়াদপি জড়ের সমতুল্য। কিন্তু আমরা যখন স্বেচ্ছায় সচেতনে সেই মহাধর্মের অনুগমন করি তখনই আমাদের মহত্ত্ব, তখনই আমরা জড়ের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। কেবল তাহাই নয়, তখনই আমরা মহৎ সুখ লাভ করি।’
তিনি জগতসংসারের নিয়মকে আরোপ করতে চেয়েছিলেন মানুষের ধর্মাচরণের মধ্যে। এই পরার্থপরতা তার কাছে বিভিন্ন মনুষ্যসৃষ্ট আচার- আচরণবহুল ধর্মের চেয়েও অনেক মহৎ বলে প্রতিভাত হয়েছিল। মানুষের সমস্ত অসুখ যে লুকিয়ে আছে স্বার্থপরতার ভেতরে, সে কথা বারে বারে বলে গিয়েছিলেন তিনি। এমনকি কঠোর আধ্যাত্মিক নিয়মপালনও যে স্বার্থপরতার নামান্তর মাত্র, একথা বলতে তিনি দ্বিধাবোধ করেননি।
তিনি বলেছিলেন, ‘সকল স্বার্থপরতায় চূড়ান্ত এই আধ্যাত্মিক স্বার্থপরতা। কারণ, সংসারের মধ্যে এমন একটি  অপূর্ব্ব কৌশল আছে যে, স্বার্থসাধন করিতে গেলেও পদে পদে স্বার্থত্যাগ করিতে হয়। সংসারে পরের দিকে একেবারে না তাকাইলে নিজের কার্য্যের ব্যাঘাত ঘটে। নৌকা যেমন গুণ দিয়া টানে তেমনি সংসারের স্বার্থবন্ধন আমাদিগকে ইচ্ছায় অনিচ্ছায় সর্ব্বদাই প্রতিকূল স্রোত বাহিয়া নিজের দিক হইতে পরের দিকে আকর্ষণ করিতে থাকে। আমাদের স্বার্থ ক্রমশই আমাদের সন্তানের স্বার্থ, পরিবারের স্বার্থ, প্রতিবেশীর স্বার্থ, স্বদেশের স্বার্থ এবং সর্ব্বজনের স্বার্থে অবশ্যম্ভাবীরূপে ব্যাপ্ত হইতে থাকে।
কিন্তু যাঁহারা সংসারের দুঃখ শোক দারিদ্র্য হইতে পরিত্রাণ পাইবার প্রলোভনে আধ্যাত্মিক বিলাসিতায় নিমগ্ন হন তাঁহাদের স্বার্থপরতা সর্ব্বপ্রকার আঘাত হইতে সুরক্ষিত হইয়া সুদৃঢ় হইয়া উঠে।’ হ্যাঁ, আধ্যাত্মিক ধর্মপালনকে ‘বিলাসিতা’ বলে অভিহিত করতে দ্বিধাবোধ করেননি তিনি এবং সেই কারণে জগতসংসারের সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকাকেও সমর্থন করেননি। 
জগতের ধর্ম বলতে অনেকক্ষেত্রেই প্রশ্ন ওঠে যে এর ভিত্তি কি নিষ্ঠুরতা নয়? প্রাণের ধারা প্রবাহিত থাকার অন্যতম শর্ত কি অন্যের প্রাণহরণ নয়? এখানে কবি মনে করিয়ে দেন যে আমরা খণ্ডচিত্র দেখছি। সমগ্র জগতের সাম্যাবস্থাকে দেখছিনা। তিনি বলে ওঠেন, ‘নিষ্ঠুরতাই যদি জগতের মূলগত নিয়ম হইত, হিংসাই যদি জগতের আশ্রয়স্থল হইত, তবে জগৎ এক মুহূর্ত বাঁচিত না। উপর হইতে যাহা দেখি তাহা ধর্ম নহে। উপর হইতে আমরা ত চতুর্দিকে পরিবর্তন দেখিতেছি, কিন্তু জগতের মূল ধর্ম কি অপরিবর্তনীয়তা নহে? আমরা চারি দিকেই ত অনৈক্য দেখিতেছি, কিন্তু তাহার মূলে কি ঐক্য বিরাজ করিতেছে না?’ 
এই ভাবধারা তো কোনও রূপক নয়। জগতছাড়া অনাসৃষ্টি কোনও অবাস্তব স্বপ্ন নয়। তবুও সেই ভাবনা আজো মানুষের কাছে অধরা হয়ে থেকে যাচ্ছে। স্বপ্নস্বরূপ সেই ভাবনার বাস্তবায়ন কি মানুষ কোনওকালে করতে পারবেনা?
(চলবে)       

      


2 comments:

  1. ব্যাপার হচ্ছে, 'নিষ্ঠুরতা' কী, বা কাকে বলে, এটা নিয়েও বিতর্কের সুযোগ থেকে যাচ্ছে।
    যাই হোক, অনেক পরে দেখছি, অনেক পর্ব পেরিয়ে। খুব ভাল লাগছে আলোচনা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, সেটা ঠিক। 'নিষ্ঠুরতা' সংজ্ঞায়িত করা মুশকিল। একটা চেষ্টা থাকবে পরের পর্বে এই বিষয়টা ধরবার।

      Delete

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া