Monday, June 25, 2018
সম্পাদকীয় / গৌতম সেন
জ্যৈষ্ঠ
শেষে এল আষাঢ়। গ্রীষ্ণ শেষে নিয়ম মতে আষাঢ়ের আকাশ বেয়ে এল বর্ষা, হয়ত বা একটু
আলসেমী করে। তবে বাঙলার বুকে বাদলের জাঁকাল উপস্থিতি এখন মোটামুটি
প্রতিষ্ঠিত। সাম্প্রতিক এক দামাল ঝড়বৃষ্টি, তার সাথে মুহুর্মুহু বজ্রপাতের ঘটনায়
বেশ কিছু প্রাণহানীর খবর পাওয়া গেছে। নিঃসন্দেহে এ ঘটনা বড়ই দুঃখজনক।
এই
বর্ষাকে মাথায় রেখেই, এবারের চিলেকোঠার ই-ম্যাগ সেজেছে বৃষ্টি ভেজা, বাদলের গন্ধ
মাখা নানা রচনায় – আছে বর্ষার কবিতা, গল্প, অনুগল্প ইত্যাদি। সদস্য-সদস্যাদের
স্বতঃস্ফুর্ত অবদানে এবারও এক মনোরম সংকলন নিয়ে হাজির হল ই-ম্যাগ। সবার প্রত্যাশা
পূরণে সে ব্যর্থ হবে না বলেই বিশ্বাস।
জুন
মাসের আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় বলা যেতে পারে ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুলের
গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার সব খবর। মাধ্যমিক, এইচ এস ছাড়াও আরও সব
সর্বভারতীয় যে সব বোর্ডের পরীক্ষার ফলাফল এতদিনে প্রকাশ হয়েছে, তার এক বিরাট শরিক
আমাদের সদস্য-সদস্যাদের কৃতি ছেলেমেয়েরা। তাদের সকলের জন্য চিলেকোঠার তরফে জানাই
হ্রার্দিক অভিনন্দন। প্রসঙ্গত বলা যাক, প্রতিবছরের মত এইসব সফল ছেলেমেয়ের দের
চিলেকোঠা পরিবার থেকে পারিতোষিক প্রদানের মধ্য দিয়ে তাদের ভবিষ্যত দিনগুলোতে আরো
উন্নতি করার উৎসাহ দান করা হবে, জানানো হবে আন্তরিক শুভকামনা। অতএব সকল
সদস্য-সদস্যা যারা এখনও তাঁদের কৃতি সন্তান-সন্ততিদের নাম চিলেকোঠা-র কাছে
জানান নি, একান্ত অনুরোধ তাঁদের কাছে, আপনারা অবিলম্বে জানান আপনাদের ছেলেমেয়েদের
সাফল্যের খবর। ফেলিসিটেশন অনুষ্ঠানকে সাফল্যমন্ডিত করতে সর্বতোভাবে সাহার্য করুন।
অবশেষে
আপনাদেরর সকলকে জানাই বাদলদিনের বৃষ্টিস্নাত শুভেচ্ছা। সকলেই বৃষ্টির আনন্দ
উপভোগ করুন ও সুস্থ থাকুন এই কামনা জানাই।
ধারাবাহিক / স্বপ্নস্বরূপ – ১৯ / ন ন্দি নী সে ন গু প্ত
বর্ষা, প্রকৃতির পরম হিতকারী ঋতুর স্বরূপ চিনিয়েছিলেন কবি।
বলেছিলেন এই ঋতুর মধ্যে লুকিয়ে থাকা ফসল ফলানোর সুরের কথা, বীজবপনের কথা,
ক্ষুন্নিবৃত্তির মন্ত্রের কথা। তবে এই সমস্ত ভাবনাকে ছাপিয়ে বর্ষার আরও যে রূপ
তিনি আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন, আরও যে
ভাবে তিনি আমাদের ভাবিয়ে তুলতে পারেন, সে হল বর্ষার অদ্ভুত প্রেমময় রূপ। কবির অল্প
বয়সের অবতার ভানুসিংহের কলমেও ফুটে উঠেছিল অভিসারিকা রাধার বেদনা,
‘দমকত বিদ্যুৎ, পথতরু লুণ্ঠিত, থরহর কম্পিত দেহ’...
বর্ষা ছাড়া প্রেমময় অভিসারের পরিবেশকে কীভাবেই বা কবি পৌঁছে
দেবেন চরম শীর্ষবিন্দুতে? বারে বারে তাই প্রেমের নেপথ্যে ঘনিয়ে আসে বর্ষার মেঘ,
নেমে আসে রিমঝিম ধারাপাত।
‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার/ পরাণসখা বন্ধু হে আমার’... কে
এই বন্ধু, পরাণসখা? কোনও জাগতিক বঁধুয়া,
নাকি পরমাত্মা ঈশ্বর? ঠিক কার সাথে মিলিত হবার আকুতি ফুটে উঠেছিল পঙক্তিতে –সে
বিতর্কে না ঢুকেও অনায়াসেই বলা যায় এ এক অদ্ভুত সমর্পণের বানী। বর্ষার ঝড়ো হাওয়ায়,
অঝোর বারিধারার মাঝে নিজেকে অকিঞ্চিৎকর বলে হারিয়ে ফেলা এবং পুনরায় খুঁজে পাবার ইঙ্গিত।
বৃক্ষ যেভাবে নতুন পাতায় আরও সতেজ, আরও সবুজ হয়ে ওঠে, মানুষও যেন বর্ষায় নিজেকে
সম্পূর্ণ হারিয়ে আবার নতুন করে খুঁজে পায়। এক জন্মের মধ্যে নিহিত অজস্র জন্মকে
চিনিয়ে দেয় বর্ষা, এবং এই নবজন্মপ্রদানকারী বর্ষাকে চিনিয়ে দেন সত্যদ্রষ্টা কবি।
বর্ষাকে আরেকরকম
রূপে চিনিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। হয়তো বা তার সাজপোশাকের ঘনঘটার মধ্যেই
প্রত্যক্ষ করেছিলেন তার রজোগুণ। বর্ষাকে তুলনা করেন বীরের সঙ্গে, ভাবিয়ে তোলেন এই
বিশ্লেষণে... ‘বর্ষাকে ক্ষত্রিয় বলিলে দোষ
হয় না। তাহার নকিব আগে আগে গুরুগুরু শব্দে দামামা বাজাইতে বাজাইতে আসে — মেঘের পাগড়ি
পরিয়া পশ্চাতে সে নিজে আসিয়া দেখা দেয়। অল্পে তাহার সন্তোষ নাই। দিগ্বিজয় করাই তাহার
কাজ। লড়াই করিয়া সমস্ত আকাশটা দখল করিয়া সে দিক্চক্রবর্তী হইয়া বসে। তমালতালী-বনরাজির
নীলতম প্রান্ত হইতে তাহার রথের ঘর্ঘরধ্বনি শোনা যায়, তাহার বাঁকা তলোয়ারখানা ক্ষণে
ক্ষণে কোষ হইতে বাহির হইয়া দিগ্বক্ষ বিদীর্ণ করিতে থাকে, আর তাহার তূণ হইতে বরুণ-বাণ
আর নিঃশেষ হইতে চায় না। এ দিকে তাহার পাদপীঠের উপর সবুজ কিংখাবের আস্তরণ বিছানো, মাথার
উপরে ঘনপল্লবশ্যামল চন্দ্রাতপে সোনার কদম্বের ঝালর ঝুলিতেছে, আর বন্দিনী পূর্বদিগ্বধু
পাশে দাঁড়াইয়া অশ্রুনয়নে তাহাকে কেতকীগন্ধবারিসিক্ত পাখা বীজন করিবার সময় আপন বিদ্যুন্মণিজড়িত
কঙ্কণখানি ঝলকিয়া তুলিতেছে।’ ... এই অসাধারণ বর্ণনায় আমরাও
কবির সঙ্গে সঙ্গে এসে দাঁড়াই সেই সভাপ্রাঙ্গণে, যেখানে বর্ষা ঋতু রাজাধিরাজরূপে
শাসন করে ফেরেন মাটি, আকাশ, বাতাসের দশদিক।
ভারতীয়
সঙ্গীতের রাগরাগিণীগুলির মধ্যেও বর্ষার জন্য সুরের পাল্লা যে অনেকখানি ভারি, সে
কথা কবি শুধু তার গানগুলির মধ্য দিয়েই বুঝিয়ে দিয়েছেন এমন নয়, শতকণ্ঠে স্বীকার করেছেন,... ‘সংগীত-শাস্ত্রের মধ্যে
সকল ঋতুরই জন্য কিছু কিছু সুরের বরাদ্দ থাকা সম্ভব —কিন্তু সেটা কেবল শাস্ত্রগত। ব্যবহারে
দেখিতে পাই বসন্তের জন্য আছে বসন্ত আর বাহার —আর বর্ষার জন্য মেঘ, মল্লার, দেশ, এবং
আরো বিস্তর। সংগীতের পাড়ায় ভোট লইলে বর্ষারই হয় জিত।’
বর্ষার
আবহে প্রেম এবং অভিসারের বিশেষ গুরুত্ব আমরা দেখতে পাই কবির লেখনীতে। তবে সম্ভবত,
সবার উপরে আছে জায়গা করে নিয়েছে বিরহ। যদিও বিরহ প্রেমেরই অন্য আরেক রূপ, তবুও
বর্ষায় গৃহবন্দী হৃদয়ে বিরহকে কবি স্থাপন করেন এক অপূর্ব মহিমায়। বসন্ত এবং বর্ষা
এই দুই ঋতুর আবহে কবি বিরহের এক সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করেছেন এবং বিরহের উত্তরণ ঘটেছে
এক আধ্যাত্মিক স্তরের দিকে। কবি বলছেন,... ‘বর্ষাকালে বিরহিণীর সমস্ত “আমি” একত্র
হয়, সমস্ত “আমি” জাগিয়া উঠে; দেখে যে বিচ্ছিন্ন “আমি”, একক “আমি” অসম্পূর্ণ। সে কাঁদিতে
থাকে। সে তাহার নিজের অসম্পূর্ণতা পূর্ণ করিবার জন্য কাহাকেও খুঁজিয়া পায় না। চারি
দিকে বৃষ্টি পড়িতেছে, অন্ধকার করিয়াছে; কাহাকেও পাইবার নাই, কিছুই দেখিবার নাই; কেবল
বসিয়া বসিয়া অন্তর্দেশের অন্ধকারবাসী একটি অসম্পূর্ণ, সঙ্গীহীন “আমি”র পানে চাহিয়া
কাঁদিতে থাকে। ইহাই বর্ষাকালের বিরহ। বসন্তকালে বিরহিণীর জগৎ অসম্পূর্ণ, বর্ষাকালে
বিরহিণীর “স্বয়ং” অসম্পূর্ণ। বর্ষাকালে আমি আত্মা চাই, বসন্তকাল আমি সুখ চাই। সুতরাং
বর্ষাকালের বিরহ গুরুতর। এ বিরহে যৌবন মদন প্রভৃতি কিছু নাই, ইহা বস্তুগত নহে।’… এরকম
তুলনামূলক ভাবনার মধ্য দিয়েই বর্ষার নানা রূপ উদ্ভাসিত হয়েছে।
মেঘের লিখনপত্রে চিরবিরহিণীর অপেক্ষা ভাষা
পায়। বর্ষার বারিধারা নেমে এসে ধুয়ে দেয় অশ্রুজল। তবুও জিজ্ঞাসা
ফিরে ফিরে আসে সজল বাতাসে,... ‘আমায় কেন বসিয়ে রাখো একা দ্বারের পাশে?’... বর্ষার বিরহকে সহজ ভাষা দিয়ে বলতে গেলে আবার কবিকে
আশ্রয় করে বলি,… ‘চিরদিনরাত্রি যাকে নিয়ে কেটে যাবে, এমন একটি চিরজীবনের ধন কেউ আছে– তাকে না পেয়েছি-- নাই পেয়েছি,
তবু সে আছে, সে আছে– বিরহের সমস্ত বক্ষ ভরে দিয়ে সে আছে…’
কবিতা / মেঘ ও স্পর্শ / অনুপম দাশশর্মা
মেঘে মেঘে ভরে গেছে
পথঘাট
তুমি সময়ে আসোনি আজও
এক গ্রহ থেকে আরেক
গ্রহে
লুকিয়ে রাখা আছে
স্থায়িত্বের শপথ
তুমি জানতে চাওনি
আমারও কিছু বলার আছে
স্তব্ধতার
অলীক দেয়ালে
অজ্ঞাতবাসে থেকে যাই
যদি
কীভাবে তবে বর্ষার
তন্তুতে গড়ে তুলবে
সমান্তরাল বুকভরা শ্বাস
অনন্ত স্পর্শবেহাগে
এমন মেঘলাদিনে তিরতির
করে দিঘির
জন্ম হয় বুকের গভীরে
এক ভিজে নিশ্চুপ ঠোঁট
জানে
কীভাবে বিষাদের গ্রাফ
নামে বৃষ্টিজলের সম্মেলনে।
কবিতা / বাদলা স্মৃতি / গৌতম সেন
বৃষ্টি আবার আসবে,
গাছে ফুলে ঘাসে বর্ষার ঘ্রাণে ঘ্রাণে
তুমিও আসবে ফিরে
অতীত ভিজবে স্মৃতির নীরব ক্রন্দনে।
মনে পড়ে যাবে শহরের ভেজা কোলাহল
দলে দলে সেই সিক্ত ছাতার ভিড়,
তোমার আমার এই শহর পিছনে ফেলে
একটানা বৃষ্টিস্নান ফুলের মাঝে গাছের দোলে
অতীত বাদলাদিনের ফ্লাসব্যাক।
বর্ষা এসো আবার, বৃষ্টি এসো
তুমি ঋতুচক্রের আবর্তনে অপেক্ষার অবসান,
আমার বুকভরে নেওয়া কেয়াফুলের ঘ্রাণ-
ফিরে পাওয়া ফেলে আসা অতীত
তুমি কমন্ডুলুর জল, সে সুধা সিঞ্চন
আমার সুখের স্মৃতি রোমন্থন।
কবিতা / সই / বুবুসীমা চট্টোপাধ্যায়
চু কিত কিত মেয়েবেলা
খুব কি ছিল ছেলেখেলা ?
রান্নাবাটি ,কাদামাটির
পুতুল বিয়ে সইএর বাড়ির
মান অভিমান সঙ্গীসাখি
ভাব আড়ি বা হাতাহাতি।
বাদল দিনে মন কেমনে-
কান্না পেতো সইকে বিনে।
আজ বাদলে সারাদুপুর
বৃষ্টি পড়ে ঝুপুর-ঝুপুর।
হারানো সেই মেয়েবেলার,
সই যে ছিল আমার খেলার-
পালক হয়ে আসলো মনে ,
জিয়নকাঠি আনলো সনে ;
বুলিয়ে দিয়ে আমার মাথায়
''সই' ' বলে সে ডাকলো আমায় ,
তোমরা যতোই মিথ্যা বলো
কি বা আমার এলো -গেল ?
সত্যি সত্যি নুন- হলুদে
কি পেয়েছি ঘেঁটে ঘুঁটে ?
যে যার মত কাছে ডেকেছো
কাজ ফুরালে পাশ ফিরেছো ;।
মেয়েবেলার স্বপ্ন গুলো
কেমন হলো এলোমেলো ,
খুব কি ছিল ছেলেখেলা ?
চু- কিতকিত মেয়েবেলা ?
খুব কি ছিল ছেলেখেলা ?
রান্নাবাটি ,কাদামাটির
পুতুল বিয়ে সইএর বাড়ির
মান অভিমান সঙ্গীসাখি
ভাব আড়ি বা হাতাহাতি।
বাদল দিনে মন কেমনে-
কান্না পেতো সইকে বিনে।
আজ বাদলে সারাদুপুর
বৃষ্টি পড়ে ঝুপুর-ঝুপুর।
হারানো সেই মেয়েবেলার,
সই যে ছিল আমার খেলার-
পালক হয়ে আসলো মনে ,
জিয়নকাঠি আনলো সনে ;
বুলিয়ে দিয়ে আমার মাথায়
''সই' ' বলে সে ডাকলো আমায় ,
তোমরা যতোই মিথ্যা বলো
কি বা আমার এলো -গেল ?
সত্যি সত্যি নুন- হলুদে
কি পেয়েছি ঘেঁটে ঘুঁটে ?
যে যার মত কাছে ডেকেছো
কাজ ফুরালে পাশ ফিরেছো ;।
মেয়েবেলার স্বপ্ন গুলো
কেমন হলো এলোমেলো ,
খুব কি ছিল ছেলেখেলা ?
চু- কিতকিত মেয়েবেলা ?
গল্প / বর্ষা এল তাই / অরুণ চট্টোপাধ্যায়
পাচপ্যাচে গরমের পর নেমেছে
স্বস্তির বর্ষা। বাতাস হয়েছে ঠান্ডা। যেন একটা স্নিগ্ধ চাদর দিয়ে কে মুড়ে দিয়েছে
রোহিতের শরীর। ভাঙ্গা তক্তপোশে এমনি একটু বসেছিল খাওয়ার পর। বিশ্রাম নিতে নয়। এখন
কোথায় কোন ধান্দায় যাবে সেটুকু চিন্তা করতে। তার ধান্দা মানে তো দুটো পয়সার সংস্থান
করা।
এ ক’দিন যা ভ্যাপসা গরম
পড়েছে ভাদ্র মাসকেও হার মানিয়ে দেয়। খুব ইচ্ছে ছিল বৌ রত্না যদি তার ভাঙ্গা পাখাটা
দিয়ে একটু হাওয়া করে দেয়। বিয়ের পর দিত অবশ্য। তখন বাড়িতে গ্যাস ছিল না। ছিল কয়লা
ঘুঁটের উনুন। মাঝে মাঝে পাথুরে কয়লা বড় ঢ্যাঁটা হয়ে পড়ত। কিছুতেই জ্বলতে চাইত না।
শুধু একরাশ চোখ জ্বলা ধোঁয়া। তাইতেই রান্না বসাত রত্না। হাওয়া করত। মাঝে মাঝে পেছন
ফিরে চৌকিতে বসা রোহিতকে দেখে ফিক করে হাসত।
রোহিত আর থাকতে পারত না।
ধোঁয়া আর দুরবস্থা বৌয়ের সৌন্দর্য যেন বহুগুণ বাড়িয়ে দিত বলে তার মনে হত। ছূটে
গিয়ে জড়িয়ে ধরত বৌকে। সবে এক বছর দশমাস বিয়ে করা বৌটা নববধূর মত ব্রীড়াকাতর হয়ে
বলত, আঃ ছাড় না। তোমার চোখ জ্বলবে যে।
এখন কয়লা ঘুঁটের পালা
চুকেছে। গ্যাসে কোনও পাখা লাগে না। ঘরে মাথার ওপর টালির চালে একটা পাখার কথা
অনেকদিন বলেছে বটে রত্না কিন্তু তার রেস্তো হয় নি। নুন আনার আগেই পান্তা ফুরোবার
কাহিনী এ বাড়ীতে আজ নতুন নয়। ভাতের যোগাড় করতেই হিমসিম খাচ্ছে রোহিত তো মাথার ওপর
পাখা। বিজলিটা কোনও রকমে এসেছে বটে তবে তার দায় অতিকষ্টে বহন করতে হয়। একটা দুটো
লাইট লাগে। যদিও আলো জ্বালিয়ে রাখার অপরাধে বৌকে অনেকবার ধমক ধামক দিয়েছে রোহিত। দিতে
ভাল লাগে নি। বৌটা তার খারাপ নয় কিন্তু বড় ভুলো মনা।
বহুদিন পরে আজ একটা ভাল
রান্না করেছে রত্না। পেঁয়াজ দিয়ে কলমি শাকের চচ্চড়ি। ছেলেবেলা থেকে খেয়ে আসছে এটা
সে। তার মা রান্না করত। এখনও তার স্বাদ যেন লেগে আছে জিভের ডগায়। বৌটা পেয়েছে
শাশুড়ির গুণ। রাঁধে বড় ভাল। গরীবের সংসার কালিয়া কোপ্তা তো আর জোটে না। কিন্তু ওই
ধর সর্ষে বাটা দিয়ে তেলাকুচো পাতা যা রাঁধে তাতে ফেল মেরে যাবে তোমার ওই ভাল
রেস্টুরেন্ট। আর তেঁতুল দিয়ে কলায়ের ডালের বড়ির অম্বল?
আজ রেঁধেছে কলমী শাকের
চচ্চড়ি। বাজারের ঐ হাইব্রিড বড় মোটা মোটা কলমী পছন্দ করে না সে। আর স্বামীর
অপছন্দর জিনিস কোনদিন তার মুখের গোড়ায় ধরে দিতে পারবে নাকি রত্না? দু’ বাড়ি কাজ
করে সে। দু’ বাড়ি ঠিকে আর একটা বাড়ি সপ্তায় দু’দিন জামাকাপড় কাচার। সেটা একটু
বেলায় গেলেই চলে।
সাধনবাবুদের বাড়ী কাজে
যাবার পথে পড়ে একটা পুকুর। প্রোমোটারের থাবা এখনও পড়ে নি বলে সাড়ে দশ কাঠার সেই
পুকুরটা এখনও টিকে আছে কোনরকমে। চারপাশে কারা যেন একটু একটু করে ময়লা আবর্জনা
ফেলছে। সেই আধা মজে যাওয়া পুকুরের মধ্যেই একদিন সে আবিষ্কার করেছিল কতগুলো
মূল্যবান সম্পদ। সেই লাল লাল ডাঁটা কলমি। দিব্বি এখনও জলে ভেসে আছে বড় বড় পাতা
মেলে। আর পাড়ে রয়েছে ডিমেশাকের ঝাড়। একটু তেঁতো বটে কিন্তু আলুভাতে বা সর্ষে বাটা
দিয়ে করলে সে যে অমৃত। রোহিত খুব পছন্দ করে। এখন পুকুরে লোকে বেশি আসে না। তাই
পাড়গুলো এখনও এমন অনেক গাছে ভর্তি। রত্নার মত গরীবদের জন্যে এই পুকুড় পাড় তো একটা
সম্পদ।
আজ সেই দেশী কলমীর চচ্চড়ি
খেয়ে অনেকদিন পরে বৌয়ের সঙ্গে মন কষাকষিটা মিটিয়ে ফেলবে ভেবেছে রোহিত। মন কষাকষি
চলছে বেশ কিছুদিন ধরে। একটা সন্তান চাইছে রত্না। ছেলে বা মেয়ে যা হোক কিছু। এতে
তার কোনও বাছবিচার নেই। নেই আলাদা কোনও স্বপ্ন। কিন্তু একটা কিছু আসুক না তার কোল
ভরে? স্বামীর আদর সে কী শুধুই শরীরের তৃপ্তির জন্যেই জরুরী চিরকাল? শরীর ছাড়িয়ে
রত্নার বুকের মধ্যে মন বলে আর একটা জিনিস আছে তার কি কোনও খোঁজ রাখে না রোহিত?
শুধু স্বামী আর স্ত্রী কি
একটা সংসার ভরিয়ে রাখতে পারে চিরকাল? রোহিত বেশ ঝাঁঝিয়ে উঠেছে সেদিন, আমার
রোজগারের খোঁজ রাখ না বুঝি? আজকাল মজুরী জোটে তেমন? সব কন্টাক্টরের বাঁধা হয়ে
গেছে। কন্টাক্টরকে তেল না মারলে কি আর কাজ জুটবে?
মাসে আটদশ দিন মজুরী জোটে।
সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির নামমাত্র মূল্য। চা জলখাবারের যা টাকা দেয় মালিক তার
আদ্দেক মেরে দেয় ওই নেপো কন্টাক্টার। সকাল বিকাল দেয় দুটো লেড়ো বিস্কুট আর চা।
দুপুরে জোটে একটা পাউরুটি আর এক ভাঁড় মোড়ের চা–দোকানের করা আলুর দম। নামমাত্র আলু
থাকা সে ঝোলের কত আর দম থাকবে যে সোহাগে সারারাত বৌকে ভরিয়ে ন’মাস পরে ভরিয়ে দেবে
তার কোল?
মাঝে মাঝে ভ্যান বয়।
কিন্তু আজকাল ওই ভ্যানোদের দাপট। সব ইঞ্জিন হয়ে গেছে আজকাল। মানুষ-ইঞ্জিনের আর কদর
কই? মাঝে মাঝে ছোট কুঁড়ে বাড়ির কলি ফিরিয়েও আসে। যা দু’চার পয়সা হয়। বৌটা বড় ভাল।
ছেলের আবদার করলেও গয়নার আবদার করে নি কখনও। হেসে বলেছে, গয়না গড়াবার দিন কি
পালিয়ে যাচ্ছে গা?
একটা হাত-জাল আছে তার।
মাথার ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে ফেলা যায়। লুকিয়ে চুরিয়ে এ পুকুর সে পুকুর করে দু’চারটে ধরে
মাঝে মধ্যে। তাছাড়া গঙ্গাতেও কুঁচো চিংড়ি আর কিছু চুনো মাছ ধরে। রত্না চুনো মাছ
খেতে খুব ভালবাসে। তার হাতের বাটি চচ্চড়ির স্বাদ ভুলতে কখনও পারে নি রোহিত। মাঝে
মাঝে চুনো মাছ এনে দেয়। কিন্তু রত্না বলে, এগুলো তুমি বেচে এস। এখনও বাজার বন্ধ হয়
নি। দুটো পয়সা আসুক গো।
ভেবে মাঝে মাঝে বেশ অবাক
হয় রোহিত। তার ট্যাঁকের খবর কিন্তু ঠিক জানতে পারে রত্না। জানে পুরুষ মানুষেরও সময়
বিশেষে কিছু টাকার দরকার হয়। বর তো আর স্কচ হুইস্কি খাবে না। খাবে তো বদনের
দোকানের দেশী মাল কী খালপারের গগনের হাতের বানানো তাড়ি। সে খবর রত্নাকে দিয়েছিল
তার এক প্রতিবেশিনী। বলেছিল, কত্তা যে তোমার মাল খায় সেটা তো জান নাকি? শুধু দেশী
মাল নয় আবার গাঁজানো তাড়িও আছে।
রত্না তার দিকে তাকিয়ে
বুঝেছিল এ হল ঈর্ষা। বহুদিন ধরে তার রোহিতকে ঢলাবার চেষ্টা করেছে মেয়েটা। বরটা তো
ফ্যাক্টরির একটা অ্যাকসিডেন্টে অথর্ব হয়ে পড়ে। তাই নজর পড়েছে রত্নার বরের দিকে।
রত্না ঝগড়া করে নি। ঝগড়া
করতে তার খুব ঘেন্না করে। ঠান্ডা মাথায় বলেছে, পুরুষ মানুষ একটু মাল খাওয়া ভাল।
ওতে মাথা ঠান্ডা থাকে। রাতে বৌকে আদর করে বেশী।
এমনি তার বৌ। যে নিজেই
একটা গয়না রোহিতের কাছে তার আবার গয়না চাওয়ার দরকার কী? কিন্তু তবু তার সন্তানের
ইচ্ছে পূরণ করতে বড় ভয় পায় রোহিত। কী হবে যদি একরত্তি ওই ছেলেটাকে সে খেতে দিতে না
পারে? অসুখে যদি চিকিতসা করাতে না পারে? যদি মরে যায় বেচারি? তখন রত্নার কান্না যে
বন্ধ হবে না কিছুতেই। হয়ত দূষবে তাকেই। বলবে, তুমি কেমন বাবা যে ছেলেটা্র একবাটি
দুধের যোগাড় করে দিতে পার না? অসুখে এক দানা ওষুধ দিতে পার না?
রত্নার থেকে পালিয়ে পালিয়ে
বেড়িয়েছে মাসের পর মাস। কাজ খোঁজার ছল করে বাড়ির বাইরে খালপারে গিয়ে গাছের নিচে
শুয়ে কাটিয়েছে। অনেক রাতে বাড়ি ফিরে পাঁড় মাতালের অভিনয় করেছে যদিও বেশি মদ সে
কখনোই খায় না। রত্না তার মাতলামী সহ্য করতে পারে না রোহিত জানে। আবার কোনদিন
ক্লান্তির ভাব দেখিয়ে চোখ বুজে অন্য পাশ ফিরে শুয়ে থেকেছে। কিন্তু রোহিত টের
পেয়েছে রত্না কিন্তু ঘুমোয় নি। শেষ রাতে খুব ক্লান্তি এসে হয়ত বুজিয়ে দিয়ে থাকবে
রত্নার চোখ।
ভেবেছিল খেয়েদেয়ে একটু
নকুড়মামার কাছে যাবে। নকুড়মামা একটা শেড করাবে তার সাইকেল সারানোর দোকানের জন্যে।
যদি কাজটা তাকে দেয় তো দু’চারটে পয়সা হলে একটা সরু হার গড়িয়ে রত্নাকে ঠান্ডা রাখার
চেষ্টা করবে। সে অবশ্য তেমন ভাল করে জানে না একটা সরু হার গড়াতে কত টাকা লাগে।
অন্তত ‘বাচ্চা দাও বাচ্চা দাও’ বলে ঘ্যানঘ্যান হয়ত করবে না কিছুদিন। সাজগোজ
নিয়ে মত্ত থাকবে।
ভেবেছিল পাখা না থাক একটা
পুরোন পিচবোর্ড বা যা হোক কিছু দিয়ে চৌকিতে বসে বৌ যদি তাকে একটু হাওয়া করে আরাম
দেয় তবে সে আরও বুঝিয়ে বলবে কেন তাদের বাচ্চা নিয়ে এখন একদম ভাবা ঠিক নয়।
নকুড়মামার শেড করে একটু অভিজ্ঞ হলে আর কিছু ভাল কাজ যদি সে পায় তো তার অবস্থা আর
এমন হাঘরে থাকবে না হয়ত।
আজ রত্না রেঁধেছিল সেই
দেশী কলমির চচ্চড়ি আর চুনো মাছের বাটিয়ে কাচালংকা দিয়ে। এমনিতে সে তো গুগলি খায়।
কে নাকি বলেছে গুগলিতে খুব প্রোটিন থাকে আর মেয়েদের একটু প্রোটিন না খেলে চলে না।
যাওয়া হল না নকুড়মামার
কাছে। ঘুম এসে জাঁকিয়ে বসল রোহিতের দু’চোখের পাতায়। আর তারপরেই ঝমঝমিয়ে নামল এ
বছরের প্রথম বৃষ্টি। সে কী মুশলধারে এল। চারিদিক যেন রাতের মত অন্ধকার। আর সে কী
শব্দ। কোথায় গেল গরম। শরীরে স্নিগ্ধ ছোঁয়া। রোহিত একটা স্বপ্ন দেখছিল। কে যেন তাকে
বলেছিল সিমলা না কোথায় যেন খুব বরফ পাওয়া যায়। কি মিষ্টি তার স্বাদ।
নকুড়মামার শেড শেষ হতে
তাকে আরও অনেক ভাল ভাল কাজ দিয়েছে। এখন অনেক টাকা রোহিতের। সে রত্নাকে ট্রেনে
চাপিয়ে সিমলায় বেড়াতে নিয়ে এসেছে। রত্না তার পাশে পাশে হাঁটছে। সামনে মাথার ওপর
বরফের পাহাড়। রত্না বলছে, আঃ কী ঠান্ডা!
চোখ হঠাৎ খুলে গেল
রোহিতের। তার মাথা রত্নার কোলে। রত্না বলছে, কী বে-খেয়ালে মানুষ গো তুমি? একটা
বালিশ নিয়ে তো শোবে নাকি?
তুমুল বৃষ্টি বাইরে
দাপাদাপি করছে। রোহিতের সারা শরীরে স্নিগ্ধ-শীতল স্রোত বইছে। রত্নার নরম কোলে তার
মাথা। চোখ তুলে ভাল করে দেখছে বৌকে। তার ঠোঁটে কী সুন্দর এক হাসির ঝিলিক। ভরা
চকচকে গালে কী অপূর্ব পেলবতা। চোখের দৃষ্টিতে কী অদ্ভুত গভীরতা।
--কী হাঁ করে দেখছ মশাই?
আমাকে কি আজ আবার নতুন করে দেখছ নাকি?
রত্নার মাথার চুল ভিজে।
জানলা দিয়ে আসা আলোতে চকচক করছে কয়েকটা ফোঁটা। অপ্রস্তুত হেসে বলল, কাপড়গুলো উঠোনে
মেলা ছিল। হঠাৎ এমন পাজী বৃষ্টিটা এল যে—
এই বৃষ্টি সত্যিই বড় পাজী।
নাহলে বৌয়ের এমন মনোহর রূপটাকে আজ সে প্রকট করে?
--বৃষ্টিটা হয়ে ভালই হল কি
বল? গরমটা একটু কমল। উঃ বাবা আর পারছিলুম না।
কিন্তু আজ ঠিক এই মুহূর্তে
একটু গরম যে চাইছে রোহিত নিজে? একটা ভালবাসার উষ্ণতা। চাই তার একটা আপন আপন গন্ধ।
একটা গভীর ছোঁয়া। একটা গভীর সুখের ছোঁয়া। যে সুখে ধনী-দরিদ্রের ভেদ নেই।
এক ঝটকায় উঠে পড়ল রোহিত।
ব্যস্ত রত্না বলল, কী হল তোমার? আমি ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলাম বুঝি? রাগ কর না গো।
রোহিতের মুখে কোনও কথা
সরছিল না। সে একভাবে চেয়েছিল বৌয়ের চোখের দিকে। রত্না একটু ভয় পেয়ে বললে, কী হয়েছে
কিছু বললে না? তারপর একটু শংকিত হল, এই বৃষ্টিতে তোমার বেরোন বন্ধ হল? বুঝেছি নেশা
করতে দেরি হয়ে গেল বুঝি?
রোহিত সেই একভাবেই তাকিয়ে
আছে। ঠোঁট ফুলিয়ে রত্না বলল, কতদিন বলেছি ছেঁড়া ছাতাটা সারিয়ে আন তা শুনলে না। আজ
তোমার কাজে লাগত তো? ঠেকে তো যেতে পারতে ঠিক সময়েই? পুরুষ মানুষের একটু মৌজ নাহলে
কি চলে?
একটু থেমে বলল, তা পুরুষ
মানুষের একটু নেশা থাকা ভাল। আমি ঝরণার মাকে সেদিন আচ্ছা করে বলে দিয়েছি জান? সে
কিনা নালিশ করতে এসেছিল তোমার চোলাই খাওয়া নিয়ে আমার কাছে। সাহস দেখ?
পুরুষ মানুষের একটু নেশা
থাকা ভাল। তার অল্পবয়সী বৌটা বোঝে অথচ সে কথা রোহিত কিনা আজ বুঝল? যে নেশা সংসার
ভাঙ্গে সেই নেশা এতদিন সে করত। আজ করবে সেই নেশা যা করলে একটা সংসার মনের মত করে
গড়া যায়।
ঝাঁপিয়ে পড়ল সে রত্নার
ওপর। তার নেশাচ্ছন্ন ঠোঁট বউয়ের ঠোঁট দুটোকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল মুহূর্তে। চকচকে
সেই গালদুটোর ওপর দিয়ে যেন রোলার চলতে লাগল। তারপর অর্ধনগ্ন রত্নার দেহের ওপর দিয়ে
বয়ে চলল একটা পুরুষ মানুষের নেশার ঝড়।
--কী করছ জানলা খোলা আছে
যে? ফিসফিস করে বলল রত্না, বন্ধ করে দিই আগে?
-- দরকার নেই। বাইরের
বৃষ্টি এখন পাহারা দেবে আমাদের। কারুর চোখে পড়তে দেবে না।
রত্না যেন আশ্বাস পেয়ে
স্বামীর কাছে আত্মসমর্পণ করল। একটা পুরুষের কাছে আত্মসমর্পণ যে এত সুখের হয় আজকের এই
ঝড়-বৃষ্টির দুপুরে ভাল করে যেন বুঝল রত্না। আর বুঝল জানলা যতই খোলা থাক না কেন
তাদের এই অনাবৃত দেহগুলো আপাতত তুমুল বৃষ্টির জিম্মায় আছে। আছে বৃষ্টিঘেরা এক চরম
সুখের মধ্যে।
রোহিত আচ্ছন্নের মত বলল,
গরীব কি বাবা হতে পারে না রত্না?
--পারে গো পারে। স্বামীর
গালে নিজের গাল ঘষতে ঘষতে আদুরে গলায় রত্না বলল, একটা গরীব যদি জন-মজুর হতে পারে,
জেলে হতে পারে, চুন মিস্ত্রী হয়ে অন্যের কলি ফেরাতে পারে-- তবে সে বাবাও হতে পারে
গো। বাবার মত মন একটা পেলেই সে বাবা হতে পারে। সে নিজের সংসারের কলিও ফেরাতে পারে।
রত্নার গলায় খুশির সুর।
পরের বসন্তে বাবা হল
রোহিত। নকুড়মামার শেড তৈরির কাজ সে পায় নি। এখনও সে মাসে আট-দশদিন চশমখোর কৈলাস
কন্টাকটারের অধীনে কাজ পায়। মাথার ওপর ঘুরনি জাল ঘুরিয়ে গঙ্গা বা ডোবায় চুনো মাছ
ধরে। রহিমের কুঁড়েঘরের কলি ফেরায়।
রত্না আজও ঠিকে কাজ করে
দু’বাড়ি। একবাড়ি সপ্তায় দু’দিন জামাকাপড় কাচে। রোহিতের জন্যে পুকুর পাড় থেকে তুলে
আনে কলমী, হিঞ্চে, ডিমেশাক। বেসন দিয়ে উচ্ছেপাতার বড়া করে। রোহিতের আনা চুনোমাছ
বেচে দিয়ে আসতে বলে বাজারে। আর নিজের জন্যে আনতে বলে গেঁড়ি-গুগলি। বাচ্চাটা দুধ
খায়। এসময় প্রোটিন তো একটু দরকার নাকি?
আর পুরুষ মানুষের একটু
নেশা তো দরকার নাকি? কিন্তু রোহিত এখন আর দেশী খেতে ঢোকে না। ঢোকে না খালপারের
তাড়ির আড্ডায়। চুনো মাছ বেচার পয়সায় ছেলেটাকে খেলনা কিনে সারা বিকেল কাঁধে চাপিয়ে
ঘোরায়। বড় তো হচ্ছে। এরপর বইপত্র একটু কিনতে তো হবে নাকি? পুরুষ মানুষের একটু নেশা
থাকা ভাল। তার ভালবাসার বৌ রত্না বলেছে। বাবা হয়ে ছেলেকে মানুষ করার নেশাটা খারাপ
কিসে শুনি? পুরুষ মানুষই তো বাবা হয় নাকি?
আবার বর্ষা আসে। তুমুল আর
তুখোড় হয়ে। জানলার ধারে রত্নার পাশে ছেলেকে কোলে নিয়ে সেই দৃশ্য দেখে রোহিত। আর
ভাবে সেদিন বর্ষা এসেছিল তাই।
ছোট গল্প / "জীবনসঙ্গিনী" / রীনা রায়।
মরিয়মকে আমি প্রথম দেখি মিসৌরির সেন্ট লুইস- এ, ম্যালর্ডস ওয়ে স্ট্রিটের পাশেই একটা কফিশপে আমি বসেছিলাম। সেটা ছিলো জুনের শেষদিক, তারিখটা আজও মনে আছে পঁচিশে জুন, ওখানে রেনি সিজন তখনও শুরু হয়নি, হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামলো। সাইকেল নিয়ে মরিয়ম যাচ্ছিলো, দুধসাদা ড্রেস, সোনালি চুলে মরিয়মকে মনে হচ্ছিলো ফেয়ারী টেলের পাতা থেকে উঠে এসেছে , সাইকেলের সামনের ক্যারিয়ারে বেশ কিছু বই, বোধহয় লাইব্রেরি বা ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরছে।
পরে অবশ্য জেনেছিলাম ও 'সেন্ট লুইস ইউনিভার্সিটি'তে পুরাতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করছে।
হঠাৎ বৃষ্টি আসাতে মরিয়ম কফিশপে এসে দাঁড়ালো। সাইকেলটা শেডের নিচে রেখে মরিয়ম আমার কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে আমার টেবিলেই বসলো, আস্তে আস্তে দুজনের মধ্যে আলাপ জমে উঠলো।
আমার কোম্পানি দুমাসের একটা প্রজেক্ট দিয়ে আমাকে সেদেশে পাঠিয়েছিল, সেই দুমাস শেষ হতে সাতদিন বাকি ছিলো, কিন্তু প্রজেক্টের কাজ সময়ের আগেই শেষ হয়ে যাওয়ায় ওই সাতদিন আমি নিজের মতো কাটানোর সুযোগ পেয়েছিলাম, ঠিক এইরকম সময়েই মরিয়মের সাথে পরিচয়, সেদিন কেন যে ও আমার টেবিলেই এসে বসেছিল, সবই বোধহয় পূর্বনির্দিষ্ট...যাইহোক, আমার দেশ নিয়ে ওর প্রবল আগ্রহ ছিলো, আমরা সেই নিয়েই কথা বলছিলাম, লক্ষ্য করলাম, আমি নিজের দেশের পুরাতত্ত্ব নিয়ে যেটুকু জানি, তার থেকে অনেক বেশি ও জানে।
ওর জ্ঞানের গভীরতা আমাকে মুগ্ধ করছিলো, কেন জানিনা আমি ওর প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করছিলাম, ও আমাকে ওর বাড়িতে ইনভাইট করলো, বাড়িতে শুধু ওর মা ছিলেন, ওর পাঁচ বছর বয়েসেই ওর বাবা মাযের সেপারেশন হয়ে গেছিলো, বাবার সাথে ওদের আর কোনো যোগাযোগ নেই।
আমার ছুটির সেই সাতদিন দিনের অনেকটা সময় শুধু নয়, অনেক রাত পর্যন্ত আমরা পরস্পরের সান্নিধ্য উপভোগ করেছি।
মরিয়ম আমাকে সমস্ত দ্রষ্টব্য স্থানে নিয়ে ঘুরেছে, আর আমরা দুজন কখন যেন দুজনের খুব কাছে চলে এসেছিলাম, আমার দেশে ফেরার আগের দিন মরিয়ম আমাকে জানালো ও আমাকে ভালোবাসে, কিন্তু আমার বাড়ির গোঁড়া কালচার যে কোনোদিন ওকে মেনে নেবেনা, সেটা ও জানতো, তাই সেদিন এক অদ্ভুত বায়না করলো আমার কাছে, অন্তত এক রাতের জন্য ওকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে, আমিও ওকে ভালোবেসে ছিলাম, তাই আমার দিক থেকেও কোনো দ্বিধা ছিলোনা।
পরের দিন এয়ারপোর্টে ও আমাকে সি অফ করতে এসেছিলো, ওর মুখে এক অদ্ভুত তৃপ্তি দেখেছিলাম, ব্যাস, সেই ওর সাথে আমার শেষ দেখা।
এরপর আমি অনেকবার ওদেশে গেছি, কিন্তু ওকে আর খুঁজে পাইনি।
......
পেরিয়ে গেছে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর, অসুস্থ মায়ের কথায় বাধ্য হয়েছিলাম বিয়ে করতে, একটি কন্যা সন্তানের পিতাও আমি, আমার স্ত্রী ও খুবই ভালো মনের মানুষ, তবু এমন একটা দিন মনে করতে পারিনা যেদিন মরিয়মকে আমার মনে পড়েনি, আমি তো প্রতিদিন ওকে মনে করে সেই ভাবনায় ডুবে থাকতেই চেয়েছি।
ঈশ্বরের কাছে বারবার একটাই প্রার্থনা করছি, মৃত্যুর আগে একবার যেন তার সাথে আমার দেখা হয়।
জুনের মাঝামাঝি, বসে বসে পছন্দের গান শুনছি, "তোমায় পড়েছে মনে, আবার শ্রাবণ দিনে একলা বসে নিরালায়....", মনে মনে মরিয়মকেই ভাবছিলাম।
চাকরি থেকে রিটায়ার করার পর এই গান আর ল্যাপটপ যেন আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে উঠেছে!
গান শুনতে শুনতে ল্যাপটপ অন করলাম, মেল চেক করতে গিয়ে দেখলাম, ক্লারা নামের এক বিদেশিনীর মেল!
----
আজ পঁচিশে জুন, মরিয়ম আসছে আমার কাছে, দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পর!
কর্কট রোগে আক্রান্ত মরিয়মের শেষ ইচ্ছে ছিলো, একবার তার স্বামীর দেশে পা রাখার, আর আমার তাকে দেওয়া তার জীবনের সবশ্রেষ্ট উপহার ,আমাদের মেয়ে ক্লারাকে আমার সাথে পরিচয় করানো।
অসুস্থ শরীর নিয়ে সে এতটা পথ আসবে জেনে, আমিই তার কাছে সেদেশে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমাকে বাধা দিয়ে ক্লারা জানালো, মায়ের শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে সে মাকে এদেশেই নিয়ে আসতে চায়।
প্রতীক্ষায় আমি দিন গুনেছি, আমার মরিয়মকে আমি আবার এ জীবনে দেখতে পাবো ভাবিনি। আর আমার কন্যা, ক্লারা তাকে দেখবো কিনা তার জীবনের অর্ধেক পথ পেরিয়ে যাবার পর!
রাগ হলো মরিয়মের ওপর, কেন সে আমাকে জানায়নি আমার মেয়ের কথা? আমি তো তাকে অনেক খুঁজেছি, তাকে পাইনি, তার মানে সে ইচ্ছে করেই নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিল, হয়তো আমি বিবাহিত জেনে আমার সংসারের শান্তি নষ্ট করতে চায়নি!
আমার স্ত্রীকে আমি মরিয়মের ব্যাপারে সব সত্যি বলেছিলাম, তার দিক থেকে এ বিষয়ে কোনো অনুযোগ ছিলোনা, হয়তো বহুদূরের সে মহিলা তার সংসারে কোনো ছায়া ফেলবেনা বুঝেই সে কোনো অভিযোগ করেনি, কিন্তু আজ যখন মরিয়ম আমার কাছে আসছে, আমার স্ত্রী রুমার রিঅ্যাকশন কি হবে, সে ব্যাপারে আমি বেশ চিন্তিত ছিলাম।
সময় যত এগিয়ে আসছে, আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছিলো, আমি যেন সেই আঠাশের যুবক, তরুণী প্রেমিকার প্রতীক্ষায়!
এয়ারপোর্টে আমি একাই ওদের আনতে গেছিলাম...
ওই যে, আমার মরিয়ম আসছে, হুইল চেয়ারে বসে, বার্ধক্য, কর্কট রোগ ওর শরীরে থাবা ফেললেও ও এলে এখনো চারপাশ আলো হয়ে ওঠে! আমি নিস্পলকে তাকিয়ে ছিলাম, আর ক্লারা যেন তরুণী মরিয়মের প্রতিরূপ, সঙ্গের ওই সুপুরুষ প্রৌঢ় বোধহয় ক্লারার হাসব্যান্ড।
ওরা আমাকে এতটাই চেনে যে আমাকে এগিয়ে গিয়ে পরিচয় করতে হলোনা, ক্লারা দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, "বাআবা, আমি ক্লারা, টুমার মেয়ে!"
মেয়ে এসে বাবাকে নিজের পরিচয় দিচ্ছে, এমন দৃশ্য কি কেউ কখনো দেখেছে?
আমার দুচোখে জল, আমি নির্বাক, ক্লারার হাত দুটো ধরে আমি মরিয়মের দিকে এগিয়ে গেলাম।
নির্বাক দুজনে, দুজনকে দেখে যাচ্ছি, চোখ দিয়ে জল ঝরছে, কে কি ভাবলো আমাদের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।
ক্লারা আমাদের দুজনের চোখের জল মুছিয়ে দিতে আমরা সচেতন হলাম।
মরিয়মের শরীরের কথা ভেবে আমরা বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। রাস্তায় যেতে যেতে শুধু ভাবছিলাম, রুমা ওকে কিভাবে গ্রহণ করবে!
---
মরিয়ম আজ চলে গেল, সব মায়া কাটিয়ে, যেন আমাকে দেখার জন্যই ওর প্রাণবায়ু বেরোতে পারেনি! হয়তো, এতটা জার্নির ধকল ওর শরীর নিতে পারেনি, হয়তো আরো কটা দিন বাঁচতো, কিন্তু ওর শেষ ইচ্ছে তো পূরণ হলো, স্বামীর দেশে, স্বামীর ভিটেতে তো সে পা রাখলো, সেদিন রুমা ওকে বরণ করে নিয়েছিলো, আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো রুমার কাছে, কোনোরকম অসুয়া না দেখিয়ে এই তিনটে দিন নিজের স্বামীর জীবনে অন্য নারীকে সহ্য করেছে!
তিনদিন, মাত্র তিনটে দিন আমার জীবনে তাকে আবার পেলাম, এই কদিন রুমা পরম আদরে তাকে বুকে টেনে নিয়েছিলো,মরিয়মের ভাঙা বাংলা উচ্চারনে ওর কাছে ক্ষমা চাওয়া, আমার স্ত্রীর আন্তরিক ব্যবহার ,কখন যেন ওদের কাছে এনে দিয়েছিল।
ক্লারা রুমাকে মা ডাকে, ও ফিরে যাবে কদিন পরেই, আমার আর রুমার মেয়ে ব্রততীর সাথেও ওর খুব ভাব হয়ে গেছে।
কথা দিলো, ছেলে মেয়ে নিয়ে ওরা মাঝেমাঝেই বাড়ি আসবে, হ্যাঁ, এটা যেমন ব্রততীর বাড়ি, তেমন ক্লারারও বাড়ি!
মরিয়ম নেই, এটা ভীষণ সত্য, কিন্তু শেষ সময়ে সে এসে আমাকে যেন তার সারাজীবনের না থাকাটা পুষিয়ে দিয়ে গেল!
আজও বাইরে অকালশ্রাবন, ঠিক সেদিনের হঠাৎ বৃষ্টির মতোই!
বর্ষাকাল ও আমি / অর্পিতা ভট্টাচার্য
বৃষ্টি ও বর্ষাকাল
নিয়ে আমি একটু বেশি রোমান্টিক বলেই , এই বর্ষাকালে আমার জীবনটা সবসময় ঘটনা
ও দূর্ঘটনা পূর্ণ থাকে।। এটা অবশ্য আমার সবচেয়ে বড়ো শত্রুপক্ষের, মানে আমার
পতিদেবতার ভাষায়। তা এমন সব ঘটনা আমি ঘটাই, যা তাকে এসব কথা বলতে ইন্ধন যোগায়,
সেটা অনিচ্ছাতেও মানতেই হয়। অবশ্য সে সব ঘটনার ঝামেলা গুলো তাকেই তো পোহাতে হয়।
তাই বলছে বলে রাগ দেখাতেও পারিনা সবসময়।
যেমন যখন খুব বৃষ্টি
হয়, আমার খুব টিনের চালের উপর ঝমঝম শব্দ শুনতে ইচ্ছা করে। আমার ছোট বেলায় , আমার
বাড়ির একটা দিকে, টিনের চাল ছিলো। আর আমি তাই ভীষন নস্টালজিক,এই ব্যাপারে। এটা
নিয়ে এমন বায়না এবং বকবক জুড়ে তার জীবন অতিষ্ট করে তুলেছিলাম যে, সে বেচারি
অনেক মাথা খাটিয়ে আমার ফ্ল্যাট বাড়ির একমাত্র খোলা ব্যালকনির মাথা টিন দিয়ে
ঢেকে দিলো। উফ্ কি খুশি আমি। বৃষ্টি হলেই সেই টিনের চালের আওয়াজে , ছোটোবেলায়
ফিরে যাই।
আমার ফ্ল্যাটের সামনের
রাস্তায় একটু বৃষ্টিতেই জল জমে। আমার বাড়ির সবার খুব বিরক্তি এতে। আমার অবশ্য
বিশেষ বিকার নেই তাতে।
বর্ষাকালে জল তো জমবেই,
তাই বলে কি বাড়িতে বসে থাকতে হবে ? প্রচন্ড বৃষ্টি এবং ওতো জল উপেক্ষা করে,
প্রায়শই ওই নোংরা ,
ঘোলা এক হাঁটু জল ভেঙে বেরিয়ে পড়ি। শত্রুপক্ষ কতো কিছু যে সাবধান বানী শোনায়,
অসুখ করবে, পা ভাঙবে। ধুত্তোর , যা হবে হবে। আমি শোনবার পাত্রী নয়।
কদিন আগে ওইরকমই এক
প্রবল বৃষ্টির পর কলকাতা শহরে তখন সব রাস্তাই প্রায় জলমগ্ন। আমার বাড়ির সামনের রাস্তা
তো সমুদ্র হয়ে গেছে। এদিকে নন্দন চত্বরে একটি মঞ্চে অনুষ্ঠান আছে। যেতে তো হবেই।
সবার সব আপত্তি অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে পড়লাম। এক হাঁটু জল ভেঙে এগোচ্ছি তো এগোচ্ছি
। জল ক্রমশ বাড়ছে। সে যাকগে, আমায় যেতেই হবে, অনুষ্ঠানটাও করতে হবে। আমার শিল্পী
সত্বা তখন দারুন ভাবে জেগে উঠে, উৎসাহ দিচ্ছে আমায়।
খানিকটা যেতেই একটা পা
কেমন হাল্কা মনে হল, সে যাকগে, আমায় তখন রিক্সা পেতেই হবে। ওতো খেয়াল করার সময়
নেই।আমি একমনে জল ভেঙে এগোচ্ছি।
একসময়পরম ভরসার বস্তু,
একটা রিক্সা পেয়ে গেলাম।
রিক্সায় উঠতে গিয়ে
দেখি এক পায়ে চটি নেই। নেই তো নেই। সে কখন যেন জলে ডুবে আত্মহত্যা করেছে। এবার
বুঝতে পারলাম ওই জন্যই একটা পা হাল্কা লাগছিলো। তখন আর কোথায় পাবো তারে ? বাড়ি
ফিরে যাব ? কিছুতেই না। আমি আজ যাবই যাব। আরেক টিকে বিসর্জন দিলাম ওই জলে।
মুক্ত,ভারহীন পা দুখানি নিয়ে, প্রচন্ড গাম্ভীর্য নিয়ে রিক্সায় উঠলাম।
রিক্সাওয়ালা অবাক হয়ে দেখছে আমায়। আমি মেট্রো স্টেশনে গিয়ে সম্পূর্ণ খালি
পায়ে ট্রেনে উঠলাম।
ওতো দূর্যোগে সবাই কেমন
ব্যস্ত, তাই অনেকক্ষণ কেউ খেয়াল করেনি। কিছুক্ষণ পর দেখি কয়েকজন অদ্ভুত ভাবে
তাকাচ্ছে আমার দিকে আর হাসছে। আমি অসম্ভব গম্ভীর হয়ে থাকলাম, যেন তাদের হাসি
খেয়ালই করিনি। রবীন্দ্রসদন মেট্রো স্টেশনে নামার পর আমার বেশ সাজগোজ করা, চেহারার
সাথে খালি পা অনেকেরই চোখে পড়েছে। না , বলতেই হবে কলকাতার মানুষজন ভালো, কেউ
জিজ্ঞেস করেনি কিছু। নিজেদের মধ্যে একটু হাসাহাসি করছিল। তা না হয় করছিলো, কি
হয়েছে তাতে ? আমি সিগন্যাল পার হয়ে শিশির মঞ্চের দিকে আসতেই দেখি, না ভগবান আছেন
, একটি লোক এই ওয়েদারেও কতগুলো হাওয়াই চটি নিয়ে বসেছে। উঃ বাঁচলাম। তাড়াতাড়ি
একটা কিনে পরে নিয়ে নির্দিষ্ট মঞ্চে পৌঁছালাম।
একটু ডিজাইন করা রঙিন
হাওয়াই চটি দেখে, সবাই ভাবলো এতো বৃষ্টি , তাই পরেছি। কাউকে কিচ্ছু বলিনি।
বাড়ির শত্রুপক্ষকেও
না। হাতে করে খেপানোর অস্ত্র তুলে দেয় কেউ কখনো?
তোমরা আমার বন্ধু বলে
তোমাদের বললাম গোপন কথাটা। কাউকে যেন বলোনা প্লিজ। আমার কতো লজ্জা করবে তাহলে তাই
না ?
গল্প / বৃষ্টি বিলাস ও যন্ত্রণা র উপাখ্যান / শমিতা চক্রবর্তী
আবার ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি
নামলো --কাল থেকে প্রায় একনাগাড়ে চলছে বৃষ্টি টা --বোধহয় এবার নিম্নচাপের হাত ধরেই
বর্ষা এলো ! মেঘের বুক চিরে রূপোলী আলোর ঝিলিক আর মেঘের গুরু গুরু শুনতে
শুনতে কেমন যেন বিমনা হল নন্দনা ! সুদীপ্ত অবশ্য ব্যাজার মুখ করে অফিস গেল
--সত্যিই তো এমন ঝমঝমে বৃষ্টিতে কাজকর্ম সব লাটে ওঠার যোগাড় --তারপর রাস্তায় যা জল
জমেছে --গাড়ি না বিকল হয়ে যায় !
নন্দনার কিন্তু বৃষ্টি
ভীষণ ভালো লাগে --সব কাজকর্ম শিকেয় তুলে -ঝুলবারান্দার দোলনায় বসে বসে বৃষ্টি
উপভোগ করছে ! গোপালের মা আসলে আবার নাহয় কাজে মন দেবে ! আর কিই বা কাজ -দুটি
প্রাণী র ! সুদীপ্ত অফিস চলে গেলে --অলস মন্থর গতিতে বেলা কাটে ! তবু
গোপালের মা এলে ওর সাথে বকবক করে একটু সময় কাটে ! দুপুর টা কেটে যায় এখন
গোপালকে পড়া দেখাতে দেখাতে . গোপালের মা -ই একদিন বলেছিল --বৌদিমণি দুকুরের দিকে
তো তোমার তেমন কাজ নেই --আমার গোপাল টাকে এ বচ্ছর ইস্কুলে দিয়েচি --ওর পড়ালেখা টা
এট্টু দেকিয়ে দিও না ! বাহ্ এ প্রস্তাব তো মন্দ নয় ! আজকাল হাঁপিয়ে ওঠে
নন্দনা --এই অখণ্ড অবসর যেন গিলে খেতে আসে ওকে ! ----বেশ বেশ -গোপাল কে
পাঠিয়ে দিও দুপুরের দিকে . সেই থেকে চলছে গোপালের প্রশিক্ষণ ! ভারী মিষ্টি
ছেলে টা --গরীবের ঘরে জন্মালে হবে কি --ইন্টেলিজেন্সি কিছু কম নেই ওর !
রোজ গোপালের জন্য রকমারী
চকোলেট আনিয়ে রাখে নন্দনা , আজকাল আবার ইউটিউব দেখে দেখে রকমারী কেক -কুকিজ
-পেস্ট্রি ও বানিয়ে রাখে ! গোপাল টা ভারী ভালোবাসে ! এমনভাবেই গোপালের মধ্যো
দিয়েই বুঝি ওর অপূর্ণ মাতৃত্বের স্বাদ পূরণ করে নন্দনা ! বিয়ের পনেরো বছর হয়ে গেল
--আজও কোল খালিই রয়ে গেলো ! চিকিত্সার অবশ্য ত্রুটি রাখেনি সুদীপ্ত --কিন্তু ফল
সেই শূন্য ! আ্যডপশনের কথা যে সুদীপ্ত কে দু -একবার বলেনি এমন নয় -তবে সুদীপ্ত
ব্যাপার টা বরাবরই এড়িয়ে গেছে !
অতএব শূন্য ঝুলি আর হাহাকার মাতৃত্বই
সম্বল !
একটানা বৃষ্টির বন্দিশ শুনতে শুনতে আনমনা
নন্দনা তখন ভাবনা -বিবশ --এই বর্ষা ভারী আনন্দময় ! বর্ষাই তো পূর্ণতার ঋতু --আমার
প্রাণের ঋতু , ভালোবাসার ঋতু ! এমনি করে নিজের ভাবনায় বিলীন হয়ে কতটা সময়
অলস ভাবে কেটে গেল ! হঠাত্ ভাবনার জাল ছিঁড়ে বাস্তবে ফিরলো নন্দনা ---নাঃ
অনেকটা বেলা হয়ে গেলো -এই বৃষ্টি তে আর গোপালের মা র আসার সম্ভবনা নেই !
---যাই কাজে হাত লাগাই ! ইস্ আজ বৃষ্টি না থামলে গোপালটা ও আসবে কি না
সন্দেহ --মাফিন বানিয়েছিলাম ওর জন্য ! মন ভারী হল নন্দনার !
দিবানিদ্রার অভ্যেস নেই নন্দনার ! বার বার
অস্থির হচ্ছিল --বৃষ্টি টা তো এখন ধরে এসেছে --গোপাল টা তো এলেই পারে এসময় !
ডিংডঙ্ - দরজায় কলিং বেলের আওয়াজ
----এলেন বুঝি নাড়ু গোপাল ! --ওমা পাশের বাড়ির কাজের মাসি মিনতি ----হাউমাউ
করে কেঁদে উঠলো --ও বৌদিমণি গো কী সব্বোনাশ হল গো ! এমন বিলাপের সুরে বুক কেঁপে
উঠলো নন্দনার ! ---কি হল গো ? --ও বৌদিমণি গোপাল ! কি হলো গোপালের ? অস্থির হল
নন্দনা ! ---কাল অঝোর বিষ্টি তে গোপালদের মাটির দেয়াল এক্কেরে ভেঙে পড়লো গো --আর ঐ
দেয়াল চাপা পড়েই --আবার কান্না ! বুঝতে বাকি রইলো না নন্দনার --কী দুর্ঘটনা ঘটে
গেছে ! --বুকের ভেতর যেন অগুনতি ঢেউ আছড়ে পড়লো --দুগাল বেয়ে শুধু নোনা জলের
অবিরাম ধারা ! মনে পড়লো কোথায় যেন পড়েছিল --এক অনামী কবির লেখা দু লাইন
------
বহুতলের বৃষ্টি সুখ ---
অলস বেলা আলতো
পায়ে গড়িয়ে
যাস
মাটির দেওয়াল আশঙ্কা
তে
অঝোর আকাশ বান
ডেকেছে
ভাঙলো বুঝি সুখের বাস
!
কবিতা / বর্ষা তোমাকে / সোমা বসু
বর্ষা
তোমাকে পেয়েছি তো সাথে
ভিজতে বেরোন এবারের
মতো...
তুমি যে ভিজিয়ে রাখো এ
আমায় চারিপাশ থেকে -
বর্ষার জলে ভালোবাসা
জানি "নিতুই নব" ।
আমি পারি নে তো দিতে
কদর "তোমার ওজন করা" ভালোবাসার ।
ঝরঝর যেন অবিরাম
ঝরে
এসে জমে যায় বক্ষ তলে
কাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে
ভিজে নেওয়া এই সারাটা
জীবন।
নিশীথে বারি পতন শব্দ
ঝংকারে ভরে রাতের প্রমোদ,
রাতের বক্ষ চিরে হানা
দেয় অশনির আলো
বড়ো সমাদরে ঘিরে ধরে
তারা উচ্চে বলে ডেকে
"ঐ যে আলো তোমার
তরে জ্বলে আছে দেখো
প্রদীপের মত আকাশের নব
যুবকের ভালে..."
তারা তো আমার রাত জেগে
থাকা দুটি চোখের সাথী...
না বুঝেই ভালোবাসবার
তরে ব্যাকুল বিবশ !
তোমার আশায় বর্ষার জলে
বন্যা আসে,
বন্যা আসে ঐ লাল রাংগা
দুটি কপোল তলে,
ভালোবাসা আসে তারপরে
-
প্রেম এসেছিল ঠিকই
নিঃশব্দ চরণে
ভরেছে মনের আংগিনা, আলো
ও বাতাসে লুটোপুটি একরাশ
জেগেছে শরীরী
বাসনা।
নিয়ে চলে যায় ভেসে
বয়ে যায়
কামনার ভার ,
আগুন জলেছে জলের
ভেতর,
আগুন লেগেছে জেগেছে মন
মনের মধ্যে বেজেছে
প্রেমের গুংজরণ ।
ঐ সে তো এল ভাসাতে
ভাসতে আপনার জন। বাধা নেই তাতে নেমে পড়ো সাথে
বর্ষার রাত পার করো এই
হাতে হাত
রেখে নিয়ে ।
কবিতা / বারিধারা / সোমা দে
ধাবমান সময়, প্যাঁচপেঁচে
গরমের উগ্রতা,
আদর করে চলেছে জীয়ন কাঠিগুলোকে।
যুতসই উত্তর দিতে দিতে বেঁচে
থাকা-
আর নড়বড়ে জীয়নকাঠি গুলোর আর্তনাদ,
এই তো চরম বেঁচে থাকার অনুষঙ্গ;
প্রার্থনায় বসেছে কতগুলো
শুকনো হাত..
. ভেজা হাতও মেখে নিতে চায়
আঁজলা জল।
আকাশ কালো করে নবজন্মের আখ্যান,
ফেরারী পাখিকে বুকে করে ধারাস্নানের ডাক,
বৃষ্টির ধারাপাতে পার হয়
বিগত জন্ম-
আকুল নয়ন চেয়ে থাকে রাস্তার মোড়ে,
বারিধারায় স্নাত হয়ে কখন
আসবে সে?
Subscribe to:
Posts (Atom)
সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া
সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

-
ধর্ম আমায় ধারণ করেছে আগুন করেছি বর্ম ... দেখতে পাচ্ছ এই দাবানলে জ্বলছে অস্থি , চর্ম ? দেখতে পাচ্ছ উড়ছে ফিনিক্স , চাঁ...
-
শত চেষ্টা করে যখন একটা কাঠও জোগাড় করা গেল না , তখন নদীর চরে গর্ত খুঁড়ে অভাগীকে শোয়ানো হল । যে খড়ের আঁটি জ্বেলে কাঙালি মায়ের মুখে আগুন...
-
বিষাদের মেঘ ছেয়েছে আকাশে বৃষ্টি বুঝি আসন্ন— বাতাসের চোখ ছল ছল ভাসে প্রতীক্ষা কার জন্য? ওগো মেয়ে তুমি কার কথা ভাবো, সে কি ...
-
শুকনো বকুল চললি কোথায় ? গ্রহণলাগা দুপুরবেলা লাল মাটি পথ একলা চলা - রুদ্রপলাশ মোড়ের মাথায় ? কি বললি ? আজ বিকেলে মোরগ লড়াই ...
-
ওকি বৃষ্টির শব্দ ? নাকি পায়ের থেকে নূপুর খুলে হাতে নিয়ে তোর দৌড়ে আসার শব্দ ; যদি তাই হয় তবে এখন কেন ? এখন তো অনেক রাত , ব...
-
ছাদের কার্ণিশ ঘেঁষে রোজ খেলে মরে, একাকী দেয়ালে খেয়ালে বা অখেয়ালে... হেসে কুটে একাকার। মাথা নেড়ে নেড়ে অবাধ...
-
জীবনের পথ দিয়ে চলতে চলতে দিয়ার ক্লান্ত অবসন্ন মন্ ঘরের জানলায় চোখ রেখে আকাশটাকে দেখতে চাইত । কিন্তু তার আকাশটা হারিয়ে যেত , অভিমানে ...
-
বসন্তে যেমন ফুল ফোটে তেমন ফুল ঝরে। কুদরতের নিয়মে যত ফুল ফোটে ঠিক তত ফুলই ঝরে। আল্লা তালার হিসেব চুলচেরা। শুধু কি ঝরে ? ফুল কাঁদে , ফ...
-
হাইবারনেশানে যাই যখন তখন তার অবগাহনে ডুবে যেতে। ফিরে যাই সেই মাতোয়ারা দিনগুলোতে জীবনের জরদ্গভ প্রাচীর ডিঙিয়ে অদ্ভুত এক লুকোচুর...