পাচপ্যাচে গরমের পর নেমেছে
স্বস্তির বর্ষা। বাতাস হয়েছে ঠান্ডা। যেন একটা স্নিগ্ধ চাদর দিয়ে কে মুড়ে দিয়েছে
রোহিতের শরীর। ভাঙ্গা তক্তপোশে এমনি একটু বসেছিল খাওয়ার পর। বিশ্রাম নিতে নয়। এখন
কোথায় কোন ধান্দায় যাবে সেটুকু চিন্তা করতে। তার ধান্দা মানে তো দুটো পয়সার সংস্থান
করা।
এ ক’দিন যা ভ্যাপসা গরম
পড়েছে ভাদ্র মাসকেও হার মানিয়ে দেয়। খুব ইচ্ছে ছিল বৌ রত্না যদি তার ভাঙ্গা পাখাটা
দিয়ে একটু হাওয়া করে দেয়। বিয়ের পর দিত অবশ্য। তখন বাড়িতে গ্যাস ছিল না। ছিল কয়লা
ঘুঁটের উনুন। মাঝে মাঝে পাথুরে কয়লা বড় ঢ্যাঁটা হয়ে পড়ত। কিছুতেই জ্বলতে চাইত না।
শুধু একরাশ চোখ জ্বলা ধোঁয়া। তাইতেই রান্না বসাত রত্না। হাওয়া করত। মাঝে মাঝে পেছন
ফিরে চৌকিতে বসা রোহিতকে দেখে ফিক করে হাসত।
রোহিত আর থাকতে পারত না।
ধোঁয়া আর দুরবস্থা বৌয়ের সৌন্দর্য যেন বহুগুণ বাড়িয়ে দিত বলে তার মনে হত। ছূটে
গিয়ে জড়িয়ে ধরত বৌকে। সবে এক বছর দশমাস বিয়ে করা বৌটা নববধূর মত ব্রীড়াকাতর হয়ে
বলত, আঃ ছাড় না। তোমার চোখ জ্বলবে যে।
এখন কয়লা ঘুঁটের পালা
চুকেছে। গ্যাসে কোনও পাখা লাগে না। ঘরে মাথার ওপর টালির চালে একটা পাখার কথা
অনেকদিন বলেছে বটে রত্না কিন্তু তার রেস্তো হয় নি। নুন আনার আগেই পান্তা ফুরোবার
কাহিনী এ বাড়ীতে আজ নতুন নয়। ভাতের যোগাড় করতেই হিমসিম খাচ্ছে রোহিত তো মাথার ওপর
পাখা। বিজলিটা কোনও রকমে এসেছে বটে তবে তার দায় অতিকষ্টে বহন করতে হয়। একটা দুটো
লাইট লাগে। যদিও আলো জ্বালিয়ে রাখার অপরাধে বৌকে অনেকবার ধমক ধামক দিয়েছে রোহিত। দিতে
ভাল লাগে নি। বৌটা তার খারাপ নয় কিন্তু বড় ভুলো মনা।
বহুদিন পরে আজ একটা ভাল
রান্না করেছে রত্না। পেঁয়াজ দিয়ে কলমি শাকের চচ্চড়ি। ছেলেবেলা থেকে খেয়ে আসছে এটা
সে। তার মা রান্না করত। এখনও তার স্বাদ যেন লেগে আছে জিভের ডগায়। বৌটা পেয়েছে
শাশুড়ির গুণ। রাঁধে বড় ভাল। গরীবের সংসার কালিয়া কোপ্তা তো আর জোটে না। কিন্তু ওই
ধর সর্ষে বাটা দিয়ে তেলাকুচো পাতা যা রাঁধে তাতে ফেল মেরে যাবে তোমার ওই ভাল
রেস্টুরেন্ট। আর তেঁতুল দিয়ে কলায়ের ডালের বড়ির অম্বল?
আজ রেঁধেছে কলমী শাকের
চচ্চড়ি। বাজারের ঐ হাইব্রিড বড় মোটা মোটা কলমী পছন্দ করে না সে। আর স্বামীর
অপছন্দর জিনিস কোনদিন তার মুখের গোড়ায় ধরে দিতে পারবে নাকি রত্না? দু’ বাড়ি কাজ
করে সে। দু’ বাড়ি ঠিকে আর একটা বাড়ি সপ্তায় দু’দিন জামাকাপড় কাচার। সেটা একটু
বেলায় গেলেই চলে।
সাধনবাবুদের বাড়ী কাজে
যাবার পথে পড়ে একটা পুকুর। প্রোমোটারের থাবা এখনও পড়ে নি বলে সাড়ে দশ কাঠার সেই
পুকুরটা এখনও টিকে আছে কোনরকমে। চারপাশে কারা যেন একটু একটু করে ময়লা আবর্জনা
ফেলছে। সেই আধা মজে যাওয়া পুকুরের মধ্যেই একদিন সে আবিষ্কার করেছিল কতগুলো
মূল্যবান সম্পদ। সেই লাল লাল ডাঁটা কলমি। দিব্বি এখনও জলে ভেসে আছে বড় বড় পাতা
মেলে। আর পাড়ে রয়েছে ডিমেশাকের ঝাড়। একটু তেঁতো বটে কিন্তু আলুভাতে বা সর্ষে বাটা
দিয়ে করলে সে যে অমৃত। রোহিত খুব পছন্দ করে। এখন পুকুরে লোকে বেশি আসে না। তাই
পাড়গুলো এখনও এমন অনেক গাছে ভর্তি। রত্নার মত গরীবদের জন্যে এই পুকুড় পাড় তো একটা
সম্পদ।
আজ সেই দেশী কলমীর চচ্চড়ি
খেয়ে অনেকদিন পরে বৌয়ের সঙ্গে মন কষাকষিটা মিটিয়ে ফেলবে ভেবেছে রোহিত। মন কষাকষি
চলছে বেশ কিছুদিন ধরে। একটা সন্তান চাইছে রত্না। ছেলে বা মেয়ে যা হোক কিছু। এতে
তার কোনও বাছবিচার নেই। নেই আলাদা কোনও স্বপ্ন। কিন্তু একটা কিছু আসুক না তার কোল
ভরে? স্বামীর আদর সে কী শুধুই শরীরের তৃপ্তির জন্যেই জরুরী চিরকাল? শরীর ছাড়িয়ে
রত্নার বুকের মধ্যে মন বলে আর একটা জিনিস আছে তার কি কোনও খোঁজ রাখে না রোহিত?
শুধু স্বামী আর স্ত্রী কি
একটা সংসার ভরিয়ে রাখতে পারে চিরকাল? রোহিত বেশ ঝাঁঝিয়ে উঠেছে সেদিন, আমার
রোজগারের খোঁজ রাখ না বুঝি? আজকাল মজুরী জোটে তেমন? সব কন্টাক্টরের বাঁধা হয়ে
গেছে। কন্টাক্টরকে তেল না মারলে কি আর কাজ জুটবে?
মাসে আটদশ দিন মজুরী জোটে।
সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির নামমাত্র মূল্য। চা জলখাবারের যা টাকা দেয় মালিক তার
আদ্দেক মেরে দেয় ওই নেপো কন্টাক্টার। সকাল বিকাল দেয় দুটো লেড়ো বিস্কুট আর চা।
দুপুরে জোটে একটা পাউরুটি আর এক ভাঁড় মোড়ের চা–দোকানের করা আলুর দম। নামমাত্র আলু
থাকা সে ঝোলের কত আর দম থাকবে যে সোহাগে সারারাত বৌকে ভরিয়ে ন’মাস পরে ভরিয়ে দেবে
তার কোল?
মাঝে মাঝে ভ্যান বয়।
কিন্তু আজকাল ওই ভ্যানোদের দাপট। সব ইঞ্জিন হয়ে গেছে আজকাল। মানুষ-ইঞ্জিনের আর কদর
কই? মাঝে মাঝে ছোট কুঁড়ে বাড়ির কলি ফিরিয়েও আসে। যা দু’চার পয়সা হয়। বৌটা বড় ভাল।
ছেলের আবদার করলেও গয়নার আবদার করে নি কখনও। হেসে বলেছে, গয়না গড়াবার দিন কি
পালিয়ে যাচ্ছে গা?
একটা হাত-জাল আছে তার।
মাথার ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে ফেলা যায়। লুকিয়ে চুরিয়ে এ পুকুর সে পুকুর করে দু’চারটে ধরে
মাঝে মধ্যে। তাছাড়া গঙ্গাতেও কুঁচো চিংড়ি আর কিছু চুনো মাছ ধরে। রত্না চুনো মাছ
খেতে খুব ভালবাসে। তার হাতের বাটি চচ্চড়ির স্বাদ ভুলতে কখনও পারে নি রোহিত। মাঝে
মাঝে চুনো মাছ এনে দেয়। কিন্তু রত্না বলে, এগুলো তুমি বেচে এস। এখনও বাজার বন্ধ হয়
নি। দুটো পয়সা আসুক গো।
ভেবে মাঝে মাঝে বেশ অবাক
হয় রোহিত। তার ট্যাঁকের খবর কিন্তু ঠিক জানতে পারে রত্না। জানে পুরুষ মানুষেরও সময়
বিশেষে কিছু টাকার দরকার হয়। বর তো আর স্কচ হুইস্কি খাবে না। খাবে তো বদনের
দোকানের দেশী মাল কী খালপারের গগনের হাতের বানানো তাড়ি। সে খবর রত্নাকে দিয়েছিল
তার এক প্রতিবেশিনী। বলেছিল, কত্তা যে তোমার মাল খায় সেটা তো জান নাকি? শুধু দেশী
মাল নয় আবার গাঁজানো তাড়িও আছে।
রত্না তার দিকে তাকিয়ে
বুঝেছিল এ হল ঈর্ষা। বহুদিন ধরে তার রোহিতকে ঢলাবার চেষ্টা করেছে মেয়েটা। বরটা তো
ফ্যাক্টরির একটা অ্যাকসিডেন্টে অথর্ব হয়ে পড়ে। তাই নজর পড়েছে রত্নার বরের দিকে।
রত্না ঝগড়া করে নি। ঝগড়া
করতে তার খুব ঘেন্না করে। ঠান্ডা মাথায় বলেছে, পুরুষ মানুষ একটু মাল খাওয়া ভাল।
ওতে মাথা ঠান্ডা থাকে। রাতে বৌকে আদর করে বেশী।
এমনি তার বৌ। যে নিজেই
একটা গয়না রোহিতের কাছে তার আবার গয়না চাওয়ার দরকার কী? কিন্তু তবু তার সন্তানের
ইচ্ছে পূরণ করতে বড় ভয় পায় রোহিত। কী হবে যদি একরত্তি ওই ছেলেটাকে সে খেতে দিতে না
পারে? অসুখে যদি চিকিতসা করাতে না পারে? যদি মরে যায় বেচারি? তখন রত্নার কান্না যে
বন্ধ হবে না কিছুতেই। হয়ত দূষবে তাকেই। বলবে, তুমি কেমন বাবা যে ছেলেটা্র একবাটি
দুধের যোগাড় করে দিতে পার না? অসুখে এক দানা ওষুধ দিতে পার না?
রত্নার থেকে পালিয়ে পালিয়ে
বেড়িয়েছে মাসের পর মাস। কাজ খোঁজার ছল করে বাড়ির বাইরে খালপারে গিয়ে গাছের নিচে
শুয়ে কাটিয়েছে। অনেক রাতে বাড়ি ফিরে পাঁড় মাতালের অভিনয় করেছে যদিও বেশি মদ সে
কখনোই খায় না। রত্না তার মাতলামী সহ্য করতে পারে না রোহিত জানে। আবার কোনদিন
ক্লান্তির ভাব দেখিয়ে চোখ বুজে অন্য পাশ ফিরে শুয়ে থেকেছে। কিন্তু রোহিত টের
পেয়েছে রত্না কিন্তু ঘুমোয় নি। শেষ রাতে খুব ক্লান্তি এসে হয়ত বুজিয়ে দিয়ে থাকবে
রত্নার চোখ।
ভেবেছিল খেয়েদেয়ে একটু
নকুড়মামার কাছে যাবে। নকুড়মামা একটা শেড করাবে তার সাইকেল সারানোর দোকানের জন্যে।
যদি কাজটা তাকে দেয় তো দু’চারটে পয়সা হলে একটা সরু হার গড়িয়ে রত্নাকে ঠান্ডা রাখার
চেষ্টা করবে। সে অবশ্য তেমন ভাল করে জানে না একটা সরু হার গড়াতে কত টাকা লাগে।
অন্তত ‘বাচ্চা দাও বাচ্চা দাও’ বলে ঘ্যানঘ্যান হয়ত করবে না কিছুদিন। সাজগোজ
নিয়ে মত্ত থাকবে।
ভেবেছিল পাখা না থাক একটা
পুরোন পিচবোর্ড বা যা হোক কিছু দিয়ে চৌকিতে বসে বৌ যদি তাকে একটু হাওয়া করে আরাম
দেয় তবে সে আরও বুঝিয়ে বলবে কেন তাদের বাচ্চা নিয়ে এখন একদম ভাবা ঠিক নয়।
নকুড়মামার শেড করে একটু অভিজ্ঞ হলে আর কিছু ভাল কাজ যদি সে পায় তো তার অবস্থা আর
এমন হাঘরে থাকবে না হয়ত।
আজ রত্না রেঁধেছিল সেই
দেশী কলমির চচ্চড়ি আর চুনো মাছের বাটিয়ে কাচালংকা দিয়ে। এমনিতে সে তো গুগলি খায়।
কে নাকি বলেছে গুগলিতে খুব প্রোটিন থাকে আর মেয়েদের একটু প্রোটিন না খেলে চলে না।
যাওয়া হল না নকুড়মামার
কাছে। ঘুম এসে জাঁকিয়ে বসল রোহিতের দু’চোখের পাতায়। আর তারপরেই ঝমঝমিয়ে নামল এ
বছরের প্রথম বৃষ্টি। সে কী মুশলধারে এল। চারিদিক যেন রাতের মত অন্ধকার। আর সে কী
শব্দ। কোথায় গেল গরম। শরীরে স্নিগ্ধ ছোঁয়া। রোহিত একটা স্বপ্ন দেখছিল। কে যেন তাকে
বলেছিল সিমলা না কোথায় যেন খুব বরফ পাওয়া যায়। কি মিষ্টি তার স্বাদ।
নকুড়মামার শেড শেষ হতে
তাকে আরও অনেক ভাল ভাল কাজ দিয়েছে। এখন অনেক টাকা রোহিতের। সে রত্নাকে ট্রেনে
চাপিয়ে সিমলায় বেড়াতে নিয়ে এসেছে। রত্না তার পাশে পাশে হাঁটছে। সামনে মাথার ওপর
বরফের পাহাড়। রত্না বলছে, আঃ কী ঠান্ডা!
চোখ হঠাৎ খুলে গেল
রোহিতের। তার মাথা রত্নার কোলে। রত্না বলছে, কী বে-খেয়ালে মানুষ গো তুমি? একটা
বালিশ নিয়ে তো শোবে নাকি?
তুমুল বৃষ্টি বাইরে
দাপাদাপি করছে। রোহিতের সারা শরীরে স্নিগ্ধ-শীতল স্রোত বইছে। রত্নার নরম কোলে তার
মাথা। চোখ তুলে ভাল করে দেখছে বৌকে। তার ঠোঁটে কী সুন্দর এক হাসির ঝিলিক। ভরা
চকচকে গালে কী অপূর্ব পেলবতা। চোখের দৃষ্টিতে কী অদ্ভুত গভীরতা।
--কী হাঁ করে দেখছ মশাই?
আমাকে কি আজ আবার নতুন করে দেখছ নাকি?
রত্নার মাথার চুল ভিজে।
জানলা দিয়ে আসা আলোতে চকচক করছে কয়েকটা ফোঁটা। অপ্রস্তুত হেসে বলল, কাপড়গুলো উঠোনে
মেলা ছিল। হঠাৎ এমন পাজী বৃষ্টিটা এল যে—
এই বৃষ্টি সত্যিই বড় পাজী।
নাহলে বৌয়ের এমন মনোহর রূপটাকে আজ সে প্রকট করে?
--বৃষ্টিটা হয়ে ভালই হল কি
বল? গরমটা একটু কমল। উঃ বাবা আর পারছিলুম না।
কিন্তু আজ ঠিক এই মুহূর্তে
একটু গরম যে চাইছে রোহিত নিজে? একটা ভালবাসার উষ্ণতা। চাই তার একটা আপন আপন গন্ধ।
একটা গভীর ছোঁয়া। একটা গভীর সুখের ছোঁয়া। যে সুখে ধনী-দরিদ্রের ভেদ নেই।
এক ঝটকায় উঠে পড়ল রোহিত।
ব্যস্ত রত্না বলল, কী হল তোমার? আমি ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলাম বুঝি? রাগ কর না গো।
রোহিতের মুখে কোনও কথা
সরছিল না। সে একভাবে চেয়েছিল বৌয়ের চোখের দিকে। রত্না একটু ভয় পেয়ে বললে, কী হয়েছে
কিছু বললে না? তারপর একটু শংকিত হল, এই বৃষ্টিতে তোমার বেরোন বন্ধ হল? বুঝেছি নেশা
করতে দেরি হয়ে গেল বুঝি?
রোহিত সেই একভাবেই তাকিয়ে
আছে। ঠোঁট ফুলিয়ে রত্না বলল, কতদিন বলেছি ছেঁড়া ছাতাটা সারিয়ে আন তা শুনলে না। আজ
তোমার কাজে লাগত তো? ঠেকে তো যেতে পারতে ঠিক সময়েই? পুরুষ মানুষের একটু মৌজ নাহলে
কি চলে?
একটু থেমে বলল, তা পুরুষ
মানুষের একটু নেশা থাকা ভাল। আমি ঝরণার মাকে সেদিন আচ্ছা করে বলে দিয়েছি জান? সে
কিনা নালিশ করতে এসেছিল তোমার চোলাই খাওয়া নিয়ে আমার কাছে। সাহস দেখ?
পুরুষ মানুষের একটু নেশা
থাকা ভাল। তার অল্পবয়সী বৌটা বোঝে অথচ সে কথা রোহিত কিনা আজ বুঝল? যে নেশা সংসার
ভাঙ্গে সেই নেশা এতদিন সে করত। আজ করবে সেই নেশা যা করলে একটা সংসার মনের মত করে
গড়া যায়।
ঝাঁপিয়ে পড়ল সে রত্নার
ওপর। তার নেশাচ্ছন্ন ঠোঁট বউয়ের ঠোঁট দুটোকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল মুহূর্তে। চকচকে
সেই গালদুটোর ওপর দিয়ে যেন রোলার চলতে লাগল। তারপর অর্ধনগ্ন রত্নার দেহের ওপর দিয়ে
বয়ে চলল একটা পুরুষ মানুষের নেশার ঝড়।
--কী করছ জানলা খোলা আছে
যে? ফিসফিস করে বলল রত্না, বন্ধ করে দিই আগে?
-- দরকার নেই। বাইরের
বৃষ্টি এখন পাহারা দেবে আমাদের। কারুর চোখে পড়তে দেবে না।
রত্না যেন আশ্বাস পেয়ে
স্বামীর কাছে আত্মসমর্পণ করল। একটা পুরুষের কাছে আত্মসমর্পণ যে এত সুখের হয় আজকের এই
ঝড়-বৃষ্টির দুপুরে ভাল করে যেন বুঝল রত্না। আর বুঝল জানলা যতই খোলা থাক না কেন
তাদের এই অনাবৃত দেহগুলো আপাতত তুমুল বৃষ্টির জিম্মায় আছে। আছে বৃষ্টিঘেরা এক চরম
সুখের মধ্যে।
রোহিত আচ্ছন্নের মত বলল,
গরীব কি বাবা হতে পারে না রত্না?
--পারে গো পারে। স্বামীর
গালে নিজের গাল ঘষতে ঘষতে আদুরে গলায় রত্না বলল, একটা গরীব যদি জন-মজুর হতে পারে,
জেলে হতে পারে, চুন মিস্ত্রী হয়ে অন্যের কলি ফেরাতে পারে-- তবে সে বাবাও হতে পারে
গো। বাবার মত মন একটা পেলেই সে বাবা হতে পারে। সে নিজের সংসারের কলিও ফেরাতে পারে।
রত্নার গলায় খুশির সুর।
পরের বসন্তে বাবা হল
রোহিত। নকুড়মামার শেড তৈরির কাজ সে পায় নি। এখনও সে মাসে আট-দশদিন চশমখোর কৈলাস
কন্টাকটারের অধীনে কাজ পায়। মাথার ওপর ঘুরনি জাল ঘুরিয়ে গঙ্গা বা ডোবায় চুনো মাছ
ধরে। রহিমের কুঁড়েঘরের কলি ফেরায়।
রত্না আজও ঠিকে কাজ করে
দু’বাড়ি। একবাড়ি সপ্তায় দু’দিন জামাকাপড় কাচে। রোহিতের জন্যে পুকুর পাড় থেকে তুলে
আনে কলমী, হিঞ্চে, ডিমেশাক। বেসন দিয়ে উচ্ছেপাতার বড়া করে। রোহিতের আনা চুনোমাছ
বেচে দিয়ে আসতে বলে বাজারে। আর নিজের জন্যে আনতে বলে গেঁড়ি-গুগলি। বাচ্চাটা দুধ
খায়। এসময় প্রোটিন তো একটু দরকার নাকি?
আর পুরুষ মানুষের একটু
নেশা তো দরকার নাকি? কিন্তু রোহিত এখন আর দেশী খেতে ঢোকে না। ঢোকে না খালপারের
তাড়ির আড্ডায়। চুনো মাছ বেচার পয়সায় ছেলেটাকে খেলনা কিনে সারা বিকেল কাঁধে চাপিয়ে
ঘোরায়। বড় তো হচ্ছে। এরপর বইপত্র একটু কিনতে তো হবে নাকি? পুরুষ মানুষের একটু নেশা
থাকা ভাল। তার ভালবাসার বৌ রত্না বলেছে। বাবা হয়ে ছেলেকে মানুষ করার নেশাটা খারাপ
কিসে শুনি? পুরুষ মানুষই তো বাবা হয় নাকি?
আবার বর্ষা আসে। তুমুল আর
তুখোড় হয়ে। জানলার ধারে রত্নার পাশে ছেলেকে কোলে নিয়ে সেই দৃশ্য দেখে রোহিত। আর
ভাবে সেদিন বর্ষা এসেছিল তাই।
No comments:
Post a Comment