Monday, June 25, 2018

ধারাবাহিক / স্বপ্নস্বরূপ – ১৯ / ন ন্দি নী সে ন গু প্ত



বর্ষা, প্রকৃতির পরম হিতকারী ঋতুর স্বরূপ চিনিয়েছিলেন কবি। বলেছিলেন এই ঋতুর মধ্যে লুকিয়ে থাকা ফসল ফলানোর সুরের কথা, বীজবপনের কথা, ক্ষুন্নিবৃত্তির মন্ত্রের কথা। তবে এই সমস্ত ভাবনাকে ছাপিয়ে বর্ষার আরও যে রূপ তিনি আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন, আরও  যে ভাবে তিনি আমাদের ভাবিয়ে তুলতে পারেন, সে হল বর্ষার অদ্ভুত প্রেমময় রূপ। কবির অল্প বয়সের অবতার ভানুসিংহের কলমেও ফুটে উঠেছিল অভিসারিকা রাধার বেদনা,   
‘দমকত বিদ্যুৎ, পথতরু লুণ্ঠিত, থরহর কম্পিত দেহ’...  
বর্ষা ছাড়া প্রেমময় অভিসারের পরিবেশকে কীভাবেই বা কবি পৌঁছে দেবেন চরম শীর্ষবিন্দুতে? বারে বারে তাই প্রেমের নেপথ্যে ঘনিয়ে আসে বর্ষার মেঘ, নেমে আসে রিমঝিম ধারাপাত।
  
‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার/ পরাণসখা বন্ধু হে আমার’... কে এই বন্ধু,  পরাণসখা? কোনও জাগতিক বঁধুয়া, নাকি পরমাত্মা ঈশ্বর? ঠিক কার সাথে মিলিত হবার আকুতি ফুটে উঠেছিল পঙক্তিতে –সে বিতর্কে না ঢুকেও অনায়াসেই বলা যায় এ এক অদ্ভুত সমর্পণের বানী। বর্ষার ঝড়ো হাওয়ায়, অঝোর বারিধারার মাঝে নিজেকে অকিঞ্চিৎকর বলে হারিয়ে ফেলা এবং পুনরায় খুঁজে পাবার ইঙ্গিত। বৃক্ষ যেভাবে নতুন পাতায় আরও সতেজ, আরও সবুজ হয়ে ওঠে, মানুষও যেন বর্ষায় নিজেকে সম্পূর্ণ হারিয়ে আবার নতুন করে খুঁজে পায়। এক জন্মের মধ্যে নিহিত অজস্র জন্মকে চিনিয়ে দেয় বর্ষা, এবং এই নবজন্মপ্রদানকারী বর্ষাকে চিনিয়ে দেন সত্যদ্রষ্টা কবি।       
  বর্ষাকে আরেকরকম রূপে চিনিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। হয়তো বা তার সাজপোশাকের ঘনঘটার মধ্যেই প্রত্যক্ষ করেছিলেন তার রজোগুণ। বর্ষাকে তুলনা করেন বীরের সঙ্গে, ভাবিয়ে তোলেন এই বিশ্লেষণে...  বর্ষাকে ক্ষত্রিয় বলিলে দোষ হয় না। তাহার নকিব আগে আগে গুরুগুরু শব্দে দামামা বাজাইতে বাজাইতে আসে — মেঘের পাগড়ি পরিয়া পশ্চাতে সে নিজে আসিয়া দেখা দেয়। অল্পে তাহার সন্তোষ নাই। দিগ্‌বিজয় করাই তাহার কাজ। লড়াই করিয়া সমস্ত আকাশটা দখল করিয়া সে দিক্‌চক্রবর্তী হইয়া বসে। তমালতালী-বনরাজির নীলতম প্রান্ত হইতে তাহার রথের ঘর্ঘরধ্বনি শোনা যায়, তাহার বাঁকা তলোয়ারখানা ক্ষণে ক্ষণে কোষ হইতে বাহির হইয়া দিগ্‌বক্ষ বিদীর্ণ করিতে থাকে, আর তাহার তূণ হইতে বরুণ-বাণ আর নিঃশেষ হইতে চায় না। এ দিকে তাহার পাদপীঠের উপর সবুজ কিংখাবের আস্তরণ বিছানো, মাথার উপরে ঘনপল্লবশ্যামল চন্দ্রাতপে সোনার কদম্বের ঝালর ঝুলিতেছে, আর বন্দিনী পূর্বদিগ্বধু পাশে দাঁড়াইয়া অশ্রুনয়নে তাহাকে কেতকীগন্ধবারিসিক্ত পাখা বীজন করিবার সময় আপন বিদ্যুন্মণিজড়িত কঙ্কণখানি ঝলকিয়া তুলিতেছে।’ ... এই অসাধারণ বর্ণনায় আমরাও কবির সঙ্গে সঙ্গে এসে দাঁড়াই সেই সভাপ্রাঙ্গণে, যেখানে বর্ষা ঋতু রাজাধিরাজরূপে শাসন করে ফেরেন মাটি, আকাশ, বাতাসের দশদিক।
ভারতীয় সঙ্গীতের রাগরাগিণীগুলির মধ্যেও বর্ষার জন্য সুরের পাল্লা যে অনেকখানি ভারি, সে কথা কবি শুধু তার গানগুলির মধ্য দিয়েই বুঝিয়ে দিয়েছেন এমন নয়, শতকণ্ঠে স্বীকার  করেছেন,... ‘সংগীত-শাস্ত্রের মধ্যে সকল ঋতুরই জন্য কিছু কিছু সুরের বরাদ্দ থাকা সম্ভব —কিন্তু সেটা কেবল শাস্ত্রগত। ব্যবহারে দেখিতে পাই বসন্তের জন্য আছে বসন্ত আর বাহার —আর বর্ষার জন্য মেঘ, মল্লার, দেশ, এবং আরো বিস্তর। সংগীতের পাড়ায় ভোট লইলে বর্ষারই হয় জিত।’  
বর্ষার আবহে প্রেম এবং অভিসারের বিশেষ গুরুত্ব আমরা দেখতে পাই কবির লেখনীতে। তবে সম্ভবত, সবার উপরে আছে জায়গা করে নিয়েছে বিরহ। যদিও বিরহ প্রেমেরই অন্য আরেক রূপ, তবুও বর্ষায় গৃহবন্দী হৃদয়ে বিরহকে কবি স্থাপন করেন এক অপূর্ব মহিমায়। বসন্ত এবং বর্ষা এই দুই ঋতুর আবহে কবি বিরহের এক সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করেছেন এবং বিরহের উত্তরণ ঘটেছে এক আধ্যাত্মিক স্তরের দিকে। কবি বলছেন,... ‘বর্ষাকালে বিরহিণীর সমস্ত “আমি” একত্র হয়, সমস্ত “আমি” জাগিয়া উঠে; দেখে যে বিচ্ছিন্ন “আমি”, একক “আমি” অসম্পূর্ণ। সে কাঁদিতে থাকে। সে তাহার নিজের অসম্পূর্ণতা পূর্ণ করিবার জন্য কাহাকেও খুঁজিয়া পায় না। চারি দিকে বৃষ্টি পড়িতেছে, অন্ধকার করিয়াছে; কাহাকেও পাইবার নাই, কিছুই দেখিবার নাই; কেবল বসিয়া বসিয়া অন্তর্দেশের অন্ধকারবাসী একটি অসম্পূর্ণ, সঙ্গীহীন “আমি”র পানে চাহিয়া কাঁদিতে থাকে। ইহাই বর্ষাকালের বিরহ। বসন্তকালে বিরহিণীর জগৎ অসম্পূর্ণ, বর্ষাকালে বিরহিণীর “স্বয়ং” অসম্পূর্ণ। বর্ষাকালে আমি আত্মা চাই, বসন্তকাল আমি সুখ চাই। সুতরাং বর্ষাকালের বিরহ গুরুতর। এ বিরহে যৌবন মদন প্রভৃতি কিছু নাই, ইহা বস্তুগত নহে।’… এরকম তুলনামূলক ভাবনার মধ্য দিয়েই বর্ষার নানা রূপ উদ্ভাসিত হয়েছে।

মেঘের লিখনপত্রে চিরবিরহিণীর অপেক্ষা ভাষা পায়। বর্ষার বারিধারা নেমে এসে ধুয়ে দেয় অশ্রুজল। তবুও জিজ্ঞাসা ফিরে ফিরে আসে সজল বাতাসে,... ‘আমায় কেন বসিয়ে রাখো একা দ্বারের পাশে?’...  বর্ষার বিরহকে সহজ ভাষা দিয়ে বলতে গেলে আবার কবিকে আশ্রয় করে বলি,… ‘চিরদিনরাত্রি যাকে নিয়ে কেটে যাবে, এমন একটি  চিরজীবনের ধন কেউ আছে– তাকে না পেয়েছি-- নাই পেয়েছি, তবু সে আছে, সে আছে– বিরহের সমস্ত বক্ষ ভরে দিয়ে সে আছে…’      

No comments:

Post a Comment

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া