মরিয়মকে আমি প্রথম দেখি মিসৌরির সেন্ট লুইস- এ, ম্যালর্ডস ওয়ে স্ট্রিটের পাশেই একটা কফিশপে আমি বসেছিলাম। সেটা ছিলো জুনের শেষদিক, তারিখটা আজও মনে আছে পঁচিশে জুন, ওখানে রেনি সিজন তখনও শুরু হয়নি, হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামলো। সাইকেল নিয়ে মরিয়ম যাচ্ছিলো, দুধসাদা ড্রেস, সোনালি চুলে মরিয়মকে মনে হচ্ছিলো ফেয়ারী টেলের পাতা থেকে উঠে এসেছে , সাইকেলের সামনের ক্যারিয়ারে বেশ কিছু বই, বোধহয় লাইব্রেরি বা ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরছে।
পরে অবশ্য জেনেছিলাম ও 'সেন্ট লুইস ইউনিভার্সিটি'তে পুরাতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করছে।
হঠাৎ বৃষ্টি আসাতে মরিয়ম কফিশপে এসে দাঁড়ালো। সাইকেলটা শেডের নিচে রেখে মরিয়ম আমার কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে আমার টেবিলেই বসলো, আস্তে আস্তে দুজনের মধ্যে আলাপ জমে উঠলো।
আমার কোম্পানি দুমাসের একটা প্রজেক্ট দিয়ে আমাকে সেদেশে পাঠিয়েছিল, সেই দুমাস শেষ হতে সাতদিন বাকি ছিলো, কিন্তু প্রজেক্টের কাজ সময়ের আগেই শেষ হয়ে যাওয়ায় ওই সাতদিন আমি নিজের মতো কাটানোর সুযোগ পেয়েছিলাম, ঠিক এইরকম সময়েই মরিয়মের সাথে পরিচয়, সেদিন কেন যে ও আমার টেবিলেই এসে বসেছিল, সবই বোধহয় পূর্বনির্দিষ্ট...যাইহোক, আমার দেশ নিয়ে ওর প্রবল আগ্রহ ছিলো, আমরা সেই নিয়েই কথা বলছিলাম, লক্ষ্য করলাম, আমি নিজের দেশের পুরাতত্ত্ব নিয়ে যেটুকু জানি, তার থেকে অনেক বেশি ও জানে।
ওর জ্ঞানের গভীরতা আমাকে মুগ্ধ করছিলো, কেন জানিনা আমি ওর প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করছিলাম, ও আমাকে ওর বাড়িতে ইনভাইট করলো, বাড়িতে শুধু ওর মা ছিলেন, ওর পাঁচ বছর বয়েসেই ওর বাবা মাযের সেপারেশন হয়ে গেছিলো, বাবার সাথে ওদের আর কোনো যোগাযোগ নেই।
আমার ছুটির সেই সাতদিন দিনের অনেকটা সময় শুধু নয়, অনেক রাত পর্যন্ত আমরা পরস্পরের সান্নিধ্য উপভোগ করেছি।
মরিয়ম আমাকে সমস্ত দ্রষ্টব্য স্থানে নিয়ে ঘুরেছে, আর আমরা দুজন কখন যেন দুজনের খুব কাছে চলে এসেছিলাম, আমার দেশে ফেরার আগের দিন মরিয়ম আমাকে জানালো ও আমাকে ভালোবাসে, কিন্তু আমার বাড়ির গোঁড়া কালচার যে কোনোদিন ওকে মেনে নেবেনা, সেটা ও জানতো, তাই সেদিন এক অদ্ভুত বায়না করলো আমার কাছে, অন্তত এক রাতের জন্য ওকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে, আমিও ওকে ভালোবেসে ছিলাম, তাই আমার দিক থেকেও কোনো দ্বিধা ছিলোনা।
পরের দিন এয়ারপোর্টে ও আমাকে সি অফ করতে এসেছিলো, ওর মুখে এক অদ্ভুত তৃপ্তি দেখেছিলাম, ব্যাস, সেই ওর সাথে আমার শেষ দেখা।
এরপর আমি অনেকবার ওদেশে গেছি, কিন্তু ওকে আর খুঁজে পাইনি।
......
পেরিয়ে গেছে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর, অসুস্থ মায়ের কথায় বাধ্য হয়েছিলাম বিয়ে করতে, একটি কন্যা সন্তানের পিতাও আমি, আমার স্ত্রী ও খুবই ভালো মনের মানুষ, তবু এমন একটা দিন মনে করতে পারিনা যেদিন মরিয়মকে আমার মনে পড়েনি, আমি তো প্রতিদিন ওকে মনে করে সেই ভাবনায় ডুবে থাকতেই চেয়েছি।
ঈশ্বরের কাছে বারবার একটাই প্রার্থনা করছি, মৃত্যুর আগে একবার যেন তার সাথে আমার দেখা হয়।
জুনের মাঝামাঝি, বসে বসে পছন্দের গান শুনছি, "তোমায় পড়েছে মনে, আবার শ্রাবণ দিনে একলা বসে নিরালায়....", মনে মনে মরিয়মকেই ভাবছিলাম।
চাকরি থেকে রিটায়ার করার পর এই গান আর ল্যাপটপ যেন আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে উঠেছে!
গান শুনতে শুনতে ল্যাপটপ অন করলাম, মেল চেক করতে গিয়ে দেখলাম, ক্লারা নামের এক বিদেশিনীর মেল!
----
আজ পঁচিশে জুন, মরিয়ম আসছে আমার কাছে, দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পর!
কর্কট রোগে আক্রান্ত মরিয়মের শেষ ইচ্ছে ছিলো, একবার তার স্বামীর দেশে পা রাখার, আর আমার তাকে দেওয়া তার জীবনের সবশ্রেষ্ট উপহার ,আমাদের মেয়ে ক্লারাকে আমার সাথে পরিচয় করানো।
অসুস্থ শরীর নিয়ে সে এতটা পথ আসবে জেনে, আমিই তার কাছে সেদেশে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমাকে বাধা দিয়ে ক্লারা জানালো, মায়ের শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে সে মাকে এদেশেই নিয়ে আসতে চায়।
প্রতীক্ষায় আমি দিন গুনেছি, আমার মরিয়মকে আমি আবার এ জীবনে দেখতে পাবো ভাবিনি। আর আমার কন্যা, ক্লারা তাকে দেখবো কিনা তার জীবনের অর্ধেক পথ পেরিয়ে যাবার পর!
রাগ হলো মরিয়মের ওপর, কেন সে আমাকে জানায়নি আমার মেয়ের কথা? আমি তো তাকে অনেক খুঁজেছি, তাকে পাইনি, তার মানে সে ইচ্ছে করেই নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিল, হয়তো আমি বিবাহিত জেনে আমার সংসারের শান্তি নষ্ট করতে চায়নি!
আমার স্ত্রীকে আমি মরিয়মের ব্যাপারে সব সত্যি বলেছিলাম, তার দিক থেকে এ বিষয়ে কোনো অনুযোগ ছিলোনা, হয়তো বহুদূরের সে মহিলা তার সংসারে কোনো ছায়া ফেলবেনা বুঝেই সে কোনো অভিযোগ করেনি, কিন্তু আজ যখন মরিয়ম আমার কাছে আসছে, আমার স্ত্রী রুমার রিঅ্যাকশন কি হবে, সে ব্যাপারে আমি বেশ চিন্তিত ছিলাম।
সময় যত এগিয়ে আসছে, আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছিলো, আমি যেন সেই আঠাশের যুবক, তরুণী প্রেমিকার প্রতীক্ষায়!
এয়ারপোর্টে আমি একাই ওদের আনতে গেছিলাম...
ওই যে, আমার মরিয়ম আসছে, হুইল চেয়ারে বসে, বার্ধক্য, কর্কট রোগ ওর শরীরে থাবা ফেললেও ও এলে এখনো চারপাশ আলো হয়ে ওঠে! আমি নিস্পলকে তাকিয়ে ছিলাম, আর ক্লারা যেন তরুণী মরিয়মের প্রতিরূপ, সঙ্গের ওই সুপুরুষ প্রৌঢ় বোধহয় ক্লারার হাসব্যান্ড।
ওরা আমাকে এতটাই চেনে যে আমাকে এগিয়ে গিয়ে পরিচয় করতে হলোনা, ক্লারা দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, "বাআবা, আমি ক্লারা, টুমার মেয়ে!"
মেয়ে এসে বাবাকে নিজের পরিচয় দিচ্ছে, এমন দৃশ্য কি কেউ কখনো দেখেছে?
আমার দুচোখে জল, আমি নির্বাক, ক্লারার হাত দুটো ধরে আমি মরিয়মের দিকে এগিয়ে গেলাম।
নির্বাক দুজনে, দুজনকে দেখে যাচ্ছি, চোখ দিয়ে জল ঝরছে, কে কি ভাবলো আমাদের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।
ক্লারা আমাদের দুজনের চোখের জল মুছিয়ে দিতে আমরা সচেতন হলাম।
মরিয়মের শরীরের কথা ভেবে আমরা বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। রাস্তায় যেতে যেতে শুধু ভাবছিলাম, রুমা ওকে কিভাবে গ্রহণ করবে!
---
মরিয়ম আজ চলে গেল, সব মায়া কাটিয়ে, যেন আমাকে দেখার জন্যই ওর প্রাণবায়ু বেরোতে পারেনি! হয়তো, এতটা জার্নির ধকল ওর শরীর নিতে পারেনি, হয়তো আরো কটা দিন বাঁচতো, কিন্তু ওর শেষ ইচ্ছে তো পূরণ হলো, স্বামীর দেশে, স্বামীর ভিটেতে তো সে পা রাখলো, সেদিন রুমা ওকে বরণ করে নিয়েছিলো, আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো রুমার কাছে, কোনোরকম অসুয়া না দেখিয়ে এই তিনটে দিন নিজের স্বামীর জীবনে অন্য নারীকে সহ্য করেছে!
তিনদিন, মাত্র তিনটে দিন আমার জীবনে তাকে আবার পেলাম, এই কদিন রুমা পরম আদরে তাকে বুকে টেনে নিয়েছিলো,মরিয়মের ভাঙা বাংলা উচ্চারনে ওর কাছে ক্ষমা চাওয়া, আমার স্ত্রীর আন্তরিক ব্যবহার ,কখন যেন ওদের কাছে এনে দিয়েছিল।
ক্লারা রুমাকে মা ডাকে, ও ফিরে যাবে কদিন পরেই, আমার আর রুমার মেয়ে ব্রততীর সাথেও ওর খুব ভাব হয়ে গেছে।
কথা দিলো, ছেলে মেয়ে নিয়ে ওরা মাঝেমাঝেই বাড়ি আসবে, হ্যাঁ, এটা যেমন ব্রততীর বাড়ি, তেমন ক্লারারও বাড়ি!
মরিয়ম নেই, এটা ভীষণ সত্য, কিন্তু শেষ সময়ে সে এসে আমাকে যেন তার সারাজীবনের না থাকাটা পুষিয়ে দিয়ে গেল!
আজও বাইরে অকালশ্রাবন, ঠিক সেদিনের হঠাৎ বৃষ্টির মতোই!
No comments:
Post a Comment