Tuesday, July 24, 2018

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

 সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় - / গৌতম সেন





আজি ঝর ঝর মুখর বাদর দিনে... কবির গানের রেশ নিয়ে কানে চিলেকোঠা তার এবারের ই-ম্যাগ প্রকাশে আবার উদ্যোগী হয়েছে। বর্ষা এসেছে পুরোদস্তুর ভাবে, তার পূর্ণ সম্ভার নিয়ে। মন-প্রাণ স্বভাবতই এখন তৃপ্ত।
গত ৮ই জুলাই, রবিবার আয়োজন করা হয়েছিল প্রতি বছরের মত আমাদের সদস্য-সদস্যাদের সফল ও কৃতি ছেলেমেয়েদের (মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা - ২০১৮) সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানের। তাদের কে উৎসাহ দান করতে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হল উপহার। সকলের উপস্থিতি এই মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানকে সর্বাঙ্গসুন্দর করে তুলেছিল।
এবারে থিম অনুযায়ী যে কটি লেখা এসে পৌঁছেছে, তাদের নিয়েই সেজে উঠেছে এবারের ই-ম্যাগ। প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে, অন্যান্য বারের তুলনায় এবার নিজ নিজ সৃষ্টিকর্ম নিয়ে এগিয়ে আসার হার যেন কিছুটা হলেও কম। আশা রাখি, আগামী মাসে এই অবস্থাটা আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব, আরো বেশি মাত্রায় সদস্য সদস্যারা  এগিয়ে আসবেন, আমাদের নিজস্ব এই ই-ম্যাগকে সম্বৃদ্ধ করে তুলতে।
চিলেকোঠা ই-ম্যাগ তার যা কিছু উৎকর্ষ তা উৎসর্গ করে সমস্ত সদস্য-সদস্যাদের কে। তাঁদের ঐকান্তিক সহযোগিতা ছাড়া এ প্রচেষ্টাকে কেবল এগিয়ে নিয়ে যাওয়া নয়, তার অস্তিত্বকে টিঁকিয়ে রাখা সম্ভব নয় কোনমতেই। তাই আবারও সকল লেখক ও কবি বন্ধুকে আন্তরিক কৃ্তজ্ঞতা জানাচ্ছে চিলেকোঠা। আরো বেশি সংখ্যায় লেখা পাঠান, আরো বেশি সংখ্যায় সকলে এই ই-ম্যাগ পড়ুন – এ আমাদের একান্ত অনুরোধ।
অবশেষে জানাই বরষার মধুর এ সিক্ত পরিবেশ উপভোগ করুন। সুস্থ থাকুন, সাবধানে থাকুন। সঙ্গে থাকুন – চিলেকোঠার প্রগতিকে এগিয়ে নিয়ে চলুন।






ধারাবাহিক / স্বপ্নস্বরূপ – ২০ ন ন্দি নী সে ন গু প্ত




‘যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে
             রইব কত আর’... 
অনেক কিছু হারিয়ে যাচ্ছে এই পৃথিবীর বুকের উপর থেকে প্রতিমুহূর্তে। লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে কোনও না কোনও প্রাণী, উদ্ভিদ, কিংবা কোনও ভাষা, জনগোষ্ঠী। কখনো আবার মানুষেরই হঠকারিতায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সভ্যতা, শিল্প এবং প্রকৃতি। কালের নিয়মে একদিন এই পৃথিবীও ধ্বংস হয়ে যাবে। হয়তো বা মহাপ্রলয়ে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবার অনেক আগেই পৃথিবীর বুক থেকে মুছে যাবে বাংলা ভাষা। তখন আর রবীন্দ্রনাথের ভাষা ধার করে আসন্ন অনাগত দিনের জন্য আশঙ্কা প্রকাশ করে এইকথাটুকুও বলতে পারব না...        
‘আর   পারি নে রাত জাগতে হে নাথ,
             ভাবতে অনিবার।...’

এখন যে মুহূর্তকে ঘিরে বসে রয়েছি, কিছুক্ষণের মধ্যে তা হারিয়ে গিয়ে অতীত হয়ে যাবে। এটাই কালের নিয়ম। হারিয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক, সময়ের এগিয়ে চলার অন্যতম স্বাক্ষর। তবুও আমরা হারিয়ে যাওয়া জিনিস ফিরে পেতে চাই। কিন্তু সত্যিই কি সব হারিয়ে যাওয়া জিনিস ফিরে পেতে চাই? না, শুধুমাত্র প্রিয় জিনিস ফেরত পেতে চাই। অপ্রিয় জিনিস, অপ্রিয় মুহূর্ত যাকে পেছনে ফেলে এসেছি, তাকে আর ফিরে পেতে চাইনা। প্রিয়জন, যিনি হারিয়ে গিয়েছেন জীবন থেকে, ফিরে পেতে চাই তার সান্নিধ্য। রবীন্দ্রনাথের অজস্র গানে কবিতায় দেখতে পাই এই ধরনের ভাবের নিয়ত যাতায়াতস্মৃতিমেদুরতায় আচ্ছন্ন হয়ে কবি বলে ওঠেন,  ‘আমার হারিয়ে-যাওয়া দিন / আর কি খুঁজে পাব তারে/ বাদল-দিনের  আকাশ-পারে/ ছায়ায় হল লীন...’
আবার কখনো কবির ভাষা হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের মনের কথা; যে কেউ হঠাৎ করে গেয়ে ওঠেন, ‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইলো না’...  
এগিয়ে চলা সময়ের নদীর সাথে একই ছন্দে বয়ে যাওয়া, স্বাভাবিক বিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে চলা   কি তবে মানুষ সাধারণভাবে অপছন্দ করে? নাকি একটা বড় অংশের মানুষ অতীতকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়? একটা প্রচলিত ধারণা আছে যে বয়সে অপেক্ষাকৃত প্রবীণ মানুষজন সবসময় বেশি বিলাপ করেন হারিয়ে যাওয়া জিনিসের জন্য। অর্থাৎ যার জীবনে স্মৃতির ভার যত বেশি, তিনি তত বেশি আচ্ছন্ন হতে থাকেন হারিয়ে যাওয়া জিনিসের প্রতি আকর্ষণে। সেইজন্যই প্রবীণতা জরাজীর্ণ অথচ নবীনতা চিরসবুজ। আশিবছরের জীবনে স্মৃতির ভালোমন্দ অজস্র বিচিত্র ভার নিয়েও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এক সবুজ গাছের মত চিরনবীন। সময়ের থেকে অনেকখানি এগিয়ে থাকা মানুষটি হারিয়ে যাওয়া কোনও জিনিসের জন্য পা ছড়িয়ে বিলাপ করবার পক্ষপাতী ছিলেন না। আধুনিকতার পক্ষে সওয়াল করে গিয়েছেন আজীবন। উদাহরণস্বরূপ বলা চলে যে সাহিত্যে আধুনিকতার ধারাকে দুহাত বাড়িয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন, বলেছেন... ‘আজ পর্যন্ত আমাদের সাহিত্যে যদি কবিকঙ্কণ চণ্ডী, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, মনসার ভাসানের পুনরাবৃত্তি নিয়ত চলতে থাকত তা হলে কী হত? পনেরো আনা লোক সাহিত্য পড়া ছেড়েই দিত। বাংলার সকল গল্পই যদি বাসবদত্তা কাদম্বরীর ছাঁচে ঢালা হত তা হলে জাতে ঠেলার ভয় দেখিয়ে সে গল্প পড়াতে হত। কবিকঙ্কণ চণ্ডী, কাদম্বরীর আমি নিন্দা করছিনে। সাহিত্যের শোভাযাত্রার মধ্যে চিরকালই তাদের একটা স্থান আছে কিন্তু যাত্রাপথের সমস্তটা জুড়ে তারাই যদি আড্ডা করে বসে, তা হলে সে  পথটাই মাটি, আর তাদের আসরে কেবল তাকিয়া পড়ে থাকবে, মানুষ থাকবে না।’... এই যে মানুষের কথা ভাবা এবং ভেবে অনড় জগদ্দল পুরানো অবস্থান থেকে সরে আসা, এর থেকে বড় আধুনিকতা আর কিছু হতে পারেনা।
   হারিয়ে যাওয়ার চিন্তা কবির ভাবনায় নানাভাবে প্রকাশিত হয়েছে। পেয়েছে এক অদ্ভুত মহিমা। কোনও জাগতিক বস্তু, প্রিয়মানুষ কিংবা হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির জন্য বিলাসিতা নয়। নিজেকে হারিয়ে ফেলে আবার নতুন করে খুঁজে পাওয়ার খেলা। ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা’... সুরে সুরে যেন এক মন্ত্রের মত দোলা লাগে। হারিয়ে ফেলা দিনের স্মৃতি কিংবা অতীত আগলে রাখার ইচ্ছে সচেতনভাবেই কি কবি বর্জন করেছিলেন, নাকি তা ছিল একেবারেই স্বভাবসিদ্ধ? কখনো তিনি ঘোষণা করেন,... ‘বিধাতা আমাকে মস্ত একটি বর দিয়েছেন, সে হচ্ছে আমার অসামান্য বিস্মরণশক্তি। সংবাদের ভাণ্ডারঘরের জিম্মে তিনি আমার হাতে দেন নি। প্রহরীর কাজ আমার নয়; আমাকে আমার মনিব প্রহরে প্রহরে ভুলে যাবার অধিকার দিয়েছেন।... আমার মনটাকে বিধাতা নাট্যশালা করতে ইচ্ছা করেছেন, তাকে তিনি জাদুঘর বানাতে চান না।’ এক অদ্ভুত বিশ্বাস কাজ করে হয়তো বা, যখন কবি বলে ওঠেন, ‘হারিয়ে যেতে হবে আমায়, ফিরিয়ে পাব তবে।’ এই জায়গায় এসে মনে হয়, তাহলে কি জগতে কিচ্ছুটি হারায় না কোনওদিন?
হ্যাঁ, জগতের পরম নিত্যতার বৈজ্ঞানিক সূত্র কবির ভাষায় প্রকাশ পায়... ‘ফুরায় যা, তা ফুরায় শুধু চোখে/ অন্ধকারের পেরিয়ে দুয়ার যায় চলে আলোকে...’ । আলোকের আধার যিনি, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পরম আলোকময়ের কাছে বেজে ওঠে কবির প্রার্থনা...  ‘তোমাতে রয়েছে কত শশী ভানু,   হারায় না কভু অণু পরমাণু,/ আমারই ক্ষুদ্র হারাধনগুলি রবে না কি তব পায়...’।        
    

পেরিয়ে যায় সময়ের স্টেশন / অনুপম দাশ শর্মা



কীভাবে সময় পেরিয়ে যায়, খুলে যায় স্মৃতির বন্দর
ভোর আসে এখন দেরিতে
চোখ খুললে সামনে ভাসে শিশিরের ক্লান্তি
সেদিনের বিবিধভারতী পড়ে থাকে সিঁড়ির একপাশে
পুরনো বাড়ির রক ভেসে ওঠে মাঝরাতের
ব‍্যাহত ঘোরে
ব‍্যাকুলতাও সময়ের দাস। উপড়ে নেয়
স্থিরতার ধৈর্য্যরাশি
তবু এখনও, অখিলবন্ধুর গানে চোখ ভেজাতে ভালবাসি।


হারাধন রূপকথারা / গৌতম সেন




কে একজন বলেছিল জীয়ন কাঠি মরণ কাঠি মনে পড়ে?

সংক্ষিপ্ত জবাবে বলেছিলাম - বেশ মনে পড়ে!
আর একজন  বলেছিল পক্ষীরাজের কথা মনে পড়ে?
এ প্রশ্নেরও একই উত্তর ছিল আমার।


এমন 'মনে পড়া'-র হিসাব যদি খুলে বসি
শৈশব জীবন্ত হয়ে ওঠে।
দলে দলে রূপকথারা আজও
মিছিল করে আসে বোবা মনের রাজপথে। 
মায়াময় কল্পনার তেপান্তরে।

এমনটা শুনে আবেগে আহ্লাদে
এও বলে কেউ কেউ - আহা সেসব দিন
হারিয়ে গেল কোথায়, আর কি আসবে ফিরে?

তাদের কে আর বলি নি -
হারাবে কোথায়? অবলুপ্ত নয় তারা।

তবে ধীরে ধীরে অপসৃয়মান রূপকথারা
আজ  বড় কষ্টে আছে, 
সেই সব ঠাকুমাদের ঝুলি ধূলিমলিন মাত্র।
রাক্ষস খোক্ষস - দৈত্য দানো 
কিম্বা তেপান্তরের পক্ষীরাজের সওয়ার
রাজকুমার, বন্দিনী নিদ্রিতা রাজকুমারী
এত সহজে হারাবার নয়।

আজ তাদের গল্প শোনাবার মানুষ গেছে কমে
আজ শিশুরা গল্পঘুমে আচ্ছন্ন হয় না আর
ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে
দূরে, বহু দূরে সরিয়ে রাখা হল রূপকথা
কল্পলোকের গল্পকথারা আজ ব্রাত্য।

তারা আর আদরের ঠাকুমার মুখে শোনে না
ঠাকুরমার ঝুলি, নীলকমল লালকমলের
রোমাঞ্চকর জীবন। ঘুম তাদের আসে কেবল
মগজের চাপে । দিগগজানির ক্লান্তির ভারে।

রূপকথারা হারায় না
কল্পলোকের দরজা বন্ধ করে রাখা আছে
তাই স্বপ্নময় ঘুমের জগতে
কল্পনার ফসল ফলে না আর!

দিদা- ঠাম্মীদের গল্প বলা শেষ
ছোটদের ছোট ছোট চোখ বড় করে
গল্প শুনে ঘুমানোর দিন আজ শেষ -
তবু  অযত্ন লালিত রূপকথাদের দল
আছে চুপ করে।  গল্পঘরের গুদাম ঘরে।

বেচারা ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী ভাবে, চুপিচুপি
বলাবলি করে - হায় কেন এমন  হল!


হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি / -অরুণ চট্টোপাধ্যায়



আশি বছরে হাঁটতে ভাল পারত সদাশিব। এমন কি বাইরেও যেতে পারত। এখন এই পঁচাশি বছরের দোরগোড়ায় এসে বিছানা তার প্রায় সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়েছে।
মোবাইলে রিং। কষ্ট করে একটু কাত হয়ে বিছানা থেকে মোবাইলটা নিল সে। শরীরে জোর কমেছে—মনেও। কিন্তু আবেগ একটু বেড়েছে। আর অভিমানও। তাই সন্তুর ছবিটা মোবাইলের স্ক্রীনে ঠিক দেখে নিয়েছে সে। সন্তু তার নাতি। বড় ছেলের ছোটছেলে। ওরা থাকে আমস্টারডামে।
মোবাইল নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তার দিকে। নাতির এই ছবিটা দারুণ হয়েছে। সেদিন ওর জন্মদিনের একটা কেক কাটার ছবি পাঠিয়েছিল বৌমা। আজ হঠাৎ ছবিটা মনে পড়ে গেল।
বড়ছেলে সুধা মানে সুধাকরের সঙ্গে ওর মুখের ভারি মিল। মাঝে মাঝে তো নাতিকে দেখেই ছেলেকে দেখছে বলে ভ্রম হয় তার। এ যে শুধু এই ভ্রমের পঁচাশি বছরে তা নয়। ছেলেটার জন্মের একবছর পর থেকেই।
কানের কাছে বাজছে শাঁখের আওয়াজ। খুব ভাল লাগছে সদাশিবের এই আওয়াজটা। যেন আরামে চোখ বুঝল সে। বুজে যাওয়া চোখের পেছেনে আর একটা চোখ খুলে গেল ঠিক তক্ষুনি।  
বাড়িটা গমগম করছে তখন। সদাশিবের বাবা, মা, জ্যাঠা, জেঠিমা, পিসিমা পিসেমশাই, তার বৌ প্রতিমা, নিজের দুই ভাই অমল আর চঞ্চল। তখন অবশ্য ওদের বিয়ে হয় নি। নিজের দুই বোন জয়ন্তী আর বাসন্তী। জয়ন্তীর বিয়ে হয়ে গেছে। তার বর মানে সদাশিবের জামাইবাবু দীনদয়াল। দুই ভাগ্না আর এক ভাগ্নী। কত আত্নীয়—আনন্দ যেন উথলে পড়ছে।
বড়ছেলে সুধাকরের জন্মদিন আজ। সুধার মেজকাকা মানে তার মেজভাই অঘোর সাতসকালে নিমুগয়লাকে হাঁক পেড়ে ডেকে খাঁটি ফ্যানাওঠা দুধ জোগাড় করেছে। ছোটভাই অসিত জোগাড় করেছে সাধুখাঁর দোকানের কামিনী আতপ আর কিসমিস কাজু।  
--জন্মদিনের পায়েস হল আসল। সেটা তুমিই রেঁধ বৌমা। পায়েসের সঙ্গে যাবে মায়ের আশীর্বাদ। সদাশিবের মা বলেছিলেন, আর বাকি রান্না আমরা সব মেয়েরা ঠিক সামলে নেব।
দুপুর তখন একটা বোধহয়। মাটিতে মায়ের নিজের হাতে সেলাই করা ফুলকাটা আসন পাতা হয়েছে। প্রদীপ জ্বালানো হয়েছে। একটা কাঁসার রেকাবে ধান-দুর্বা। আসনে মুখ নীচে করে হাসিমুখে বসে আছে সুধা। এক এক করে সবাই ধান-দুর্বা দিয়ে আশীর্বাদ সারা হল। প্রথমে তার মা মানে সদাশিবের বৌ প্রতিমার লাল শাড়ী মাথার মাঝে জ্বলজ্বল করছে লাল সিঁদুরের টিপখানা। প্রদীপের শিখায় উজ্জ্বল যেন এক মাতৃমূর্তি। নিজের বৌএর সেই ছবি আজও চোখের সামনে এতটুকু অনুজ্জ্বল হয় নি।
শাঁখ তো বেজেই চলেছে। মনের আনন্দে বাজিয়ে চলেছে মেয়ের দল। বাজাতে বাজাতে খুশির আনন্দে একে অন্যের কাঁধে ঢলে পড়ছে হাসতে হাসতে।
কিছুদিন আগে দাদুভাই ফোনে জানিয়েছিল বাংলার দুর্গাপুজো তার খুব ভাল লাগে। কি সুন্দর সব থিমের পুজো। এবারে সে আসবে দেখতে। দাদু কি জিন্স পরতে পারে? তার মাও এখন ওখানে জিন্স পরে। বলে এইতেই বেশ স্বস্তি। বাবা তো স্যুটেই ধোপদুরস্ত। তবে আউটিং-এর সময় মাঝে মাঝে জিন্স আর গেঞ্জি পরে।
সেদিন সদাশিব বলেছিল, আর দাদুভাই জিন্স পরব কি? এই পঁচাশি বছরে লুঙ্গিটাই তো ভাল করে পরতে পারি না।
এসব কথা শোনে নি সন্তু। পুজোর সময় দাদুকে সে জিন্স পরিয়েই ছাড়বে। নিয়ে যাবে ডিস্কো থ্রেটে। সদাশিব হেসে বলেছিল, তবেই তো হয়েছে দাদু। আমার হাত পা আর গোটা থাকবে না একটাও। সন্তু বলেছিল, আমার তিন বেষ্ট বান্ধবী হয়েছে দাদু অ্যামস্টারডামে। ওরা খুব ভাল ড্যান্স করে। ওদের নিয়ে যাব পুজোয়। ওরা তোমায় ডিস্কো থ্রেটে হেল্প করে দেবে।
শাঁখের আওয়াজ মিলিয়ে গেল। বাইরে কী যেন ধপ ধপ শব্দ করে একটা গাড়ি চলে গেল। পঁচাশি বছরের বৃদ্ধ সদাশিবের কানে কে যেন বাজাতে লাগল ঢাক। একটা ধুনোর গন্ধ। দুর্গাপুজোর প্যান্ডেল। নতুন পোশাক আর সাজ। কী মিষ্টি কলরব। বাতাসে যেন কী মিষ্টি এক রঙ। মাইকে সুন্দর বাংলা গান বাজছে। হেমন্ত, মান্না, শ্যামল, পান্নলাল, ধনঞ্জয়—কত কত নাম। সুর মনে আছে নামগুলো সব হয়ত এখন আবছা হতে শুরু করেছে।  
সেই বিজয়ার দিন। সুধা আর আরও সব ছোটরা তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করছে। সদাশিব বলল, আগে সব ঠাকুর্দা ঠাকুমাদের করে এস। তারপর মাকে তারপর আমাকে।
বিজয়ার মিষ্টি খাওয়ার আগে বড়দের সঙ্গে কোলাকুলি। আজ এখন যেন তেমন পুরোন হয় নি সদাশিবের চোখে। এখন ওরা যে কি একটা ভাষা বার করেছে নস্টালজিয়া না কি? আচ্ছা এই শব্দটা কি সেকালে ছিল কিংবা প্রচলিত ছিল? স্মরণশক্তি কমে গেছে বলেই কি মনে পড়ছে না? হতে পারে।
মোবাইলে আবার রিং হচ্ছে। একটা কী বাজনা দিয়েছে কোম্পানী। নাতি যখন দেশে ছিল তখন দাদুর জন্যে এই মিউজিক সেট করে দিয়েছে। আর অবশ্য তাকে হাতে ধরে মোবাইল চালানোও শিখিয়ে গেছে। বলেছে, জানলে দাদু এখন থেকে আর ল্যান্ড ফোনে কল ধরার জন্যে বিছানা থেকে তোমায় উঠতে হবে না। বিছানায় বসে বসেই তুমি আমার সঙ্গে গল্প বলতে পারবে। যখন খুশি যতবার খুশি।
এর কিছুদিন পরে ল্যান্ডফোন কানেকশন কেটে দিয়েছে সুধা। বলেছে, এসব এখন অবসোলেট। একটা মোবাইল কিনে দিয়েছি বাবা। দেখবে জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ সব হয়ে যাবে এক সঙ্গে।
সেই নস্টালজিয়াটা তাড়া করল সদাশিবকে। এই অবসোলেট ল্যান্ডফোন আনতে কম কাঠখড় পোয়াতে হয়েছিল তাকে? বকুলনগর তখনও খাঁ খাঁ করছে একটা গাঁ। শহরের কল্কে পায় নি। একটা টেলিফোন করতে দৌড়তে হত এক কিলোমিটার দূরে সেই ডাকঘরে।  
আত্মীয় স্বজনের কারোর শরীর খারাপের একটা টেলিফোন ধরতে আসতে হত আধ কিলোমিটার দূরের মিশিরবাবুর বাড়ি। মিশিরবাবু ছিলেন বড়লোক রেশন ডিলার। লোক ভাল ছিলেন। সম্মান করতেন সদাশিবের বাবা জ্যাঠাদের। ছেলেবেলায় পড়েছেন এদের কাছে। খেয়েছেন অনেক কানমোলা। আবার অবশ্য ভাল রেজাল্ট করার জন্যে ভীমানাগের সেই বিখ্যাত রাংতা দেওয়া সন্দেশ। একদিন আগে কোলকাতা থেকে আনিয়ে রাখতেন বাবার আর এক ছাত্র সঞ্জীবকে দিয়ে। সঞ্জীব কোলকাতায় চাকরি করত আর ভীমনাগের সন্দেশ কোলকাতা ছাড়া কোথাও পাওয়া যেত না।
সারা গ্রামের মধ্যে দুটো বাড়িতে টেলিফোন। এক ওই মিশিরবাবু আর এক পোষ্টাফিস। বাবা বললেন, এত বড় পরিবার। এত আত্মীয়স্বজন। একটা টেলিফোন থাকলে ভাল হত না। সেই ইচ্ছেকে সম্মান দিয়ে দরখাস্ত করা হয়েছিল।
পাঁচ বছর পরে সেই কানেকশন লাগে। তাও অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। কিন্তু ফোন তো আছে সে ফোনে ডায়ালটোন কই? মাঝে মাঝে যেন বেড়াতে আসে। তখন সারা দেশে কটাই বা এক্সচেঞ্জ ছিল। আজ তো গন্ডা গন্ডা। ভাড়াও কমেছে আর হয়রানিও।
স্মার্ট ফোনে সদাশিবকে একটা ফেসবুক খুলে দিয়ে গেছে সন্তু। বলেছে, এখানে তো আর এখন কেউ থাকল না তোমার সঙ্গে। কিন্তু দেখবে ফেসবুকে সারা পৃথিবী থেকে তোমার বন্ধু হবে। তোমাকে কত ভালবাসবে। তোমার লোনলিনেস কেটে যাবে দাদু। তুমি আবার চনমনে হয়ে উঠবে। একজন আমস্টারডামের তরুণীর সঙ্গে ফেসবুকে বন্ধুত্ব করিয়ে দিয়েছে নাতি। নাম ক্লারা।   
সেদিন মোবাইল খুলে দেখল তার সেই ঊনিশ বছরের সদ্য হওয়া তরুণী ক্লারা প্রেম নিবেদন করেছে তাকে। বেশ মজা লেগেছিল। দাদুর সঙ্গে নাতনির কল্পিত প্রেমের কথা বেশ বুক বাজিয়ে বলত দাদুরা। সিনেমাতেও এমন গল্পের ছোড়াছড়ি। একালেও এই প্রেম কল্পিত বটে তবে আরও মজার কিংবা বিপজ্জনকও।  
সে কথাটা মনে এল হঠাৎ। মনে এল আর একটা কথা। সেদিন তার দিদি শান্তিকে যেদিন চুলের ঝুঁটি ধরে টানতে টানতে আনা হয়েছিল পুকুরঘাটের এক ঝোপের পাশ থেকে। শ্রীপুরের দাশরথী দাসের সঙ্গে নাকি প্রেম করছিল দিদি। সন্ধেবেলায় গাছের ডালে দুজনে পাশাপাশি বসে পা দোলাতে দোলাতে কুলের আচার খাচ্ছিল। এক অসবর্ণ গোত্র আর দুই, অভিভাবকদের অমত।    
এক মাসের মধ্যে ঘটক ডেকে পাকাপাকি বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল এক সরকারি উঠতি হত্তাকত্তার সঙ্গে। দিদি প্রথমে খুব কেঁদেছিল। তারপর সারাজীবন খুব হেসেছিল।
মেজ ভাই অমল তখন মেদিনীপুরে বদলি হয়ে গিয়েছিল। বাবার হঠাৎ কেমন শরীর খারাপ হতে লাগল। ডাক্তার নিজেই বেশ ভয় পেয়ে গেলেন। তখন এত অমুক পরীক্ষা তমুক পরীক্ষার ফ্যাকড়া ছিল না। আজ যেমন রুগীরা সারা রাত বসে থাকে ডাক্তারের বাড়ির দোরগোড়ায় অথবা হাসপাতাল বা নার্সিং হোমের চত্বরে তখন কিন্তু ডাক্তাররা বসে থাকতেন রুগীর বাড়িতে সারারাত। কি জানি ইমার্জেন্সি যদি কিছু হয়ে যায়।
সদাশিব পরের দিন পড়িমরি করে তিন কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে পোষ্টাফিসে গিয়ে টেলিগ্রাম করিয়ে এল। খটা খট করে মেশিন চালিয়ে কর্মীটি বলল, আর্জেন্ট তো তাই মনে হয়, কাল সকালেই ডেলিভারি হয়ে যাবে।  
জ্যাঠামশাই বললেন, তুই বাবা আর একটা খাম পোষ্টকার্ড কিছু একটা লিখে ফেলে দে। ওই খট খটকে অত বিশ্বাস করি না আমি।
তা সে চিঠি পৌছল তিনদিন পরে। মেজভাই এল চারদিন পরে আর বাবা ঠিক হয়ে যাবার দশদিন পরে যখন সে ফেরত গেল সেদিন সে হাতে পেল সেই আর্জেন্ট টেলিগ্রাম। সেদিনই পৌঁছেছে।  
আগে ছিল ডাকতার বিভাগ মানে ডাক ও তার বিভাগ। লোকে হেসে হেসে বলত ডাক্তার। পোষ্টাফিস ডাক্তারিও করে। এখন সেই ‘তার’ কথাটা চলে গেছে। শুধু ডাকবিভাগ। কেননা ‘তার’ মানে টেলিগ্রাম উঠেই গেছে দেশ থেকে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সদাশিব। নস্টালজিয়া আক্রমণের একটা লক্ষণ বোধহয়।  
অন্যমনস্কভাবে আবার চোখ পড়ে গেল মোবাইলের স্ক্রীনে। দাদুভাইয়ের ছবি। সুন্দর মিউজিক দিয়ে বেজে চলেছে রিং টোন। এই তো কিছুদিন আগেই দাদুভাই বেশ ভাল একটা মেসেজ করেছিল। পঁচিশ বছরের দাদুভাই কি সুন্দর তরতাজা তরুণ হয়েছে। এম-টেক পাশ করতে আর হয়ত মাত্র কয়েকটা মাস। আমস্টারডামে ওর চাকরি একেবারে তৈরি আছে।
কি সুন্দর ঝরঝরে বাংলায় মেসেজ করেছে। ইন্টারনেটের এই একটা সুবিধে। পৃথিবীর সব প্রান্তেই তুমি যে কোনও ভাষা পাবে। যদি খোঁজ। আর লিখেতে পার যদি তোমার ইচ্ছে থাকে তো।
বাড়িতে অবশ্য বাংলা চললেও বাবা কাকার অফিসে ইংরেজি ছাড়া তো গতি ছিল না। সেই বৃটিশ যুগে অফিসের কত ইংরেজ বাবু আসত তাদের বাড়িতে। তাদের সঙ্গে সদাশিবের বাবা কাকা জ্যাঠারা গড় গড় করে ইংরেজি বলতেন। না বলে উপায় ছিল?
একটা পোষ্ট কার্ড আর একটা এনভেলাপ অনেক কষ্টে নিজের একটা পছন্দের পড়ার বইয়ের ফাঁকে গুঁজে রেখেছিলেন। সে হয়ে গেল বেশ কয়েক বছর পোষ্টকার্ড খাম এনভেলাপ এসব হাওয়া। এখন স্মার্ট ফোনে সবাই মেসেজ করে। মেসেঞ্জার আছে, হোয়াটস অ্যাপ আছে। খামের কথা শুনলে সবাই হেসে ফেলে। বলে এখন কোথাও অ্যাপ্লিকেশন পাঠাতেও খাম লাগে না তো এমনি চিঠি পাঠাতে।
যেমন এখন মানুষের সুবিধে হচ্ছে ক্যাসলেস দুনিয়া। মানে পকেটে টাকা নেই তবু জিনিস তুমি কিনছ দেদার। যেন ভূতে তোমার টাকা বয়ে এনে দিচ্ছে দোকানদারের কাছে। ইলেক্ট্রিকের বিল মেটাও বা বৌয়ের শাড়ী কিংবা ছেলে বৌমার সাধ মেটাতে কেনো টাটা ইন্ডিকা—যা থাকার গরবে তোমার পা দুখানি ভারি করলেও নগদ তোমার পকেট ভারি করবে না একটুও। এই হল ক্যাসলেস দুনিয়া।
তেমনি আছে খামলেস দুনিয়া। বদলে আছে শুধু মেসেজ আর মেসেঞ্জার। নিজের স্মার্ট ফোনে একটা খামের আর একটা পোস্ট কার্ডের ছবি ফাইল করে রেখেছে সদাশিব। মাঝে মাঝে খুলে দেখে আর অবাক হয়ে ভাবে পৃথিবীটা যা তাড়াতাড়াই ঘুরছে ছিটকে না পড়তে হয়।
নাতি সেদিন মেসেজ করেছিল দাদুকে, দাদু আমি প্রায় আড়াই হাজার ইউরো জমিয়েছি চাকরি পাবার আগেই। দাদু খুব খুশি হয়ে বলেছিলেন, বাবা বেশ বড় ছিল ভাঁড়টা কী বল?   
নাতি হেসে বলল, দাদু, তূমি এযুগে অচল দাদু।
দাদু থতমত খেয়ে বলল, কেন দাদুভাই?
--আমাদের এ যুগ আর তোমাদের সে যুগে পড়ে নেই। এখন আর ভাঁড়ে কেউ টাকা পয়সা জমায় না। জমায় একাউন্টে। আমার নামে বাবা একটা একাউন্ট খুলে দিয়েছিল। তাতে মা বাবা বা আমি যে যখন খুশি যতবার খুশি টাকা জমিয়েছি। আর এ টাকা ভাঁড় ভেঙ্গে গুনতেও হয় না দাদু। শুধু একাউন্টে ব্যালেন্স দেখতে হয়। আর গোনার কাজটা করে কমপিউটার।
তাই সেকালের একটা মাটির লক্ষ্মীভাড়ের ছবি সে স্মার্ট ফোনে বেশ যত্ন করে রেখে দিয়েছে। এ বাড়িতে এখন তো আর বিশেষ থাকে না। তার ওপরের সবাই চলে গেছে। এমন কী ছোট হওয়া সত্বেও নিজের বৌও। ভায়েরাও সব বাইরে বাড়ি করে নিয়েছে। ভবিষ্যতে যৌথ সংসার নিয়ে যদি কেউ গবেষণা করে তো সেটা শুধু এই ফাঁকা বিশাল মাপের সংস্কারহীন বাড়ীটাকেই দেখতে হবে।
কি সুন্দর করে বাজছে স্মার্ট ফোনটা। কে আবিষ্কার করেছিল তা জানে না সদাশিব। কিন্তু এখন বেশ কৌতূহল হচ্ছে। ছোট্ট একটা মুঠির মধ্যে ধারণযোগ্য যন্ত্র যা দিয়ে নাকি সব কাজ করা যায়। এই যে সেদিন হোয়াটস অ্যাপে ভিডিও চ্যাট করল সদাশিব তার পঁচিশ বছরের নাতির সঙ্গে। ছেলে ছিল না। ছিল তার মা মানে সদাশিবের বৌমা। কেমন স্পষ্ট কথা শোনা যাচ্ছে নাতি আর বৌমার। শুধু কথা বলতে দেখাই নয়, তার মুখের সমস্ত অভিব্যক্তি এমন কি এরা যাকে বলে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ তাও। মনে হচ্ছে যেন পাশে বসে পাঁচ বছরের বাচ্চার মত কলকল করে কথা বলে যাচ্ছে পঁচিশ বছরের নাতি। কে বলবে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে রয়েছে সে?
সেদিন কথা বলতে বলতে কথার ছলে একটা অদ্ভুত কথা বলল দাদুভাই। বলল, দাদু তোমার যখন মন খারাপ হবে তখন আমায় ভিডিও কল করবে। জান অনেকে তো আড্ডা দেয় এই ভিডিও চ্যাট করে।
আড্ডার কথায় হঠাৎ খুব মন খারাপ হয়ে গেল সদাশিবের। এই শব্দগুলোর মধ্যে কি অসাধারণ জোর ছিল তা ভাবাই যায় না। আজ থেকে তিরিশ-চল্লিশ বছর আগেও এমন বাড়ি ছিল না যার সদর ঘরের লাগোয়া একটা রক ছিল। এই রকে ছেলেবয়েসে কত আড্ডা দিয়ে বড়দের কানমলা খেয়েছে সে গুরুজনদের তার ঠিক নেই। আবার বড় বয়েসেও বড়দের সঙ্গে এই রকে বসে দিব্বি আড্ডা জমত। এমন কি সন্ধ্যায় চাপড়ে মশা মারতে মারতে কত রাজা-উজির মেরেছেন তার ঠিক নেই।  
আবার কে যেন বলছিল ফেসবুক হল এক ভার্চুয়াল বুক যা কোনদিন শেষ হবে না। এটা নাকি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ আড্ডাখানা। কোনও সদর ঘর বা রক টক কিছু দরকার নেই। শুধু হাতের মুঠোয় একটা স্মার্ট ফোন থাকলেই হল। আর বিছানা বা সোফা এসব কিছু থাকাটাও খুব জরুরি নয়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এমন কি হাঁটতে হাঁটতেও তুমি যোগ দিতে পার এই আড্ডায়।  
না এখন আর রক টক নেই কোথাও। সব রক ঘিরে সেখানে ঘেরা বারান্দা করে নেওয়া হয়েছে। নিজের চৌহদ্দি আর বাইরের কারোর জন্যে নয়। নিজের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে অন্যের চৌহদ্দিতে পা রাখারও দরকার নেই কারোর।
হঠাৎ চোখ পড়ে গেল মোবাইলের দিকে। রিং তো আর হচ্ছে না? দাদুভায়ের ছবিটাও তো আর নেই। একেবারে কালো হয়ে গেছে স্ক্রীন। বোধহয় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
অন করল মোবাইল। ইস মিসকলের একেবারে ছড়াছড়ি। এক দুই করে গোনার চেষ্টা করতেই ক্লান্তি এল। দূর ছাই। এত মিস হয়েছে একি আর গুণে বার করা যায়? থাক নাতি আবার কল করবে। নতুন ভাবে। নতুন মেজাজে।  
  



মহালয়া / অর্পিতা ভট্টাচার্য




দেখতে দেখতে কত কিছুই তো বদলে গেলো। ছোটোবেলার কথা ভাবতে বসলে কতো কথা মনে পড়ে।
সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে এই সময়টায় যখন আকাশে , বাতাসে একটু একটু করে পূজো পূজো রঙ লাগাতে শুরু করেছে । মহালয়া আর রেডিওর মহিষমর্দিনী আমাদের কাছে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আমরা বলতাম মহালয়া শুনবো। আমাদের স্কুল, কলেজ সব মহালয়ার আগেই ছুটি হয়ে যেতো। মহালয়ার আগের দিন থেকে বাড়িতে সাজো সাজো রব। বাড়িঘর সব ঝকঝকে করে সাজানো। মা কাঠের বাক্স থেকে বের করতেন মা দূর্গার বাঁধানো ফটো। টেবিলে নতুন ঢাকনা পাতা হতো, মায়ের সুন্দর হাতের কাজের। তার উপর মা দূর্গার ছবি। 
রেডিও বস্তুটি তখন দারুন মহার্ঘ । তার গায়েও চাপতো নতুন কভার।
ভোর সাড়ে তিনটের সময় বাবা ঘুম থেকে তুলে দিতেন আমাদের। মুখ, হাত ,পা ধুয়ে রেডিওর সামনে বসে পড়তাম আমরা। মা ওই ভোরে স্নান করে, ধোওয়া জামাকাপড় পড়ে, ঠাকুরের ছবিতে মালা পরিয়ে, ধূপ জ্বালিয়ে দিতেন।
আরেকটা দারুন প্রাপ্তি ছিলো সেই ভোরে। আমরা ছোটরা, যারা অন্যদিন চা খেতে পেতাম না, মহালয়ার ভোরে তাদের সবাইকে চা, বিস্কুট দেওয়া হতো।
গোল হয়ে রেডিও ঘিরে বসে আমরা মহালয়া শুনতাম। প্রতিবছর বাবা প্রতিটি গানের গায়ক, গায়িকার নাম জিজ্ঞেস করতেন। আমরা যথারীতি ভুল বলতাম, আর বাবা ঠিক করে দিতেন।
মহিষমর্দিনীর স্ত্রোত্র পাঠের মধ্যে দিয়ে আমাদের পূজো এসেই যেতো।
মহালয়া শেষ হলে আমরা সবাই সেদিন বেড়াতে যেতাম পটুয়াপাড়ায়, ঠাকুরের চোখ আঁকা দেখতে। কি ভীষন আগ্রহ ও আনন্দ।

এখন মহালয়ার দিনও ছুটি থাকেনা। রেডিও প্রায় নেই বললেই চলে। লোকে যেটুকু রেডিও শোনে তাও মোবাইল ফোনে । পূজোর অনেক আগে থেকেই মাইকে আমাদের সেই মহালয়া( মহিষমর্দিনী ) শোনা যায়।
সেই পূজো পূজো নেশার দিনগুলো কখন যেন থিমের পূজোর জমজমাট আনন্দ গ্রাস করে নিয়েছে। 
অনেক আনন্দ বেড়েছে কিন্তু বড়ো মেকি সেই আনন্দ। নির্ভেজাল, আন্তরিক আনন্দ হারিয়ে যাচ্ছে কখন যেন চুপিসাড়ে প্রগতির কাছে হার মেনে।
বড়ো ইচ্ছে করে সেইদিন গুলো আবার ফিরে পেতে।
বুকের মধ্যে কষ্ট জমা হয়। তবু অজান্তেই "মহালয়া"র জন্য অপেক্ষাটা থেকেই যায়।




লোডশেডিং ও একটি সন্ধ্যা" / রীনা রায়



জানলাটা খুলে বাইরে তাকালো শিবানী। পূর্ণিমার আলোয় চারিদিক ভেসে যাচ্ছে, দুচোখ ভরে এর স্বাদ নিলো শিবানী।
আহ! কতদিন পর,মনে হয় যেন কতকাল পরে সেই পুরোনো দিনে ফিরে গেল।
পাম এভিনিউর এই বিলাসবহুল কমপ্লেক্স লোডশেডিং শব্দটার সাথে দিনযাপন করে না।
এদের স্ট্রং পাওয়ার ব্যাক আপ সিস্টেম,জীবনযাপনের অভ্যেস টাই পাল্টে দিয়েছে।
আজ হঠাৎ করেই ওদের সিস্টেমে প্রবলেম হয়েছে, আর আজ সন্ধ্যাতেই লোডশেডিং!
শিবানীর প্রথমে একটু বিরক্ত লাগছিলো, যতই হোক,মানুষ অভ্যাসের দাস, প্রায় পঁচিশটা বছর যে জীবন সে যাপন করছে, তা তো কম বিলাসবহুল নয়।
এখানে এসেছে সবেমাত্র আটমাস, কিন্তু আগের ফ্ল্যাটেও অটো কাট ইনভার্টার ছিলো, তাই কোনোদিন সেভাবে অসুবিধে হয়নি।
ঘরেতে মোমবাতি আছে হয়তো, কিন্তু এই অন্ধকারে কোথায় খুঁজবে, একটু চিন্তা করে জানলার কাছে এসে, পর্দা সরিয়ে জানলা খুলে দিতেই জ্যোৎস্নার অপার সৌন্দর্য্য দেখে ও পাওয়ার কাট কে ধন্যবাদ জানালো।
ওদের কমপ্লেক্স টা বিশাল, আর শিবানীর এপার্টমেন্টটা যেদিকে তার বাইরের ভিউটা অসাধারণ।
এদিকে একটা পার্ক, তারপরে ফুটবল খেলার মাঠ, তারপর বড় বড় গাছ সারি দিয়ে লাগানো। আজ এই খোলা জানলা দিয়ে লোডশেডিং আর জ্যোৎস্না উপভোগ করতে করতে মন চলে গেল ফেলে আসা দিনগুলোয়।
......
''রিম্পি, হারিকেনটা নিয়ে যা, দাদাকে দিয়ে আয়, আর তুই বইগুলো নিয়ে রান্নাঘরে আমার কাছে আয়...", মায়ের ডাকে ছোট্ট শিবানী একছুটে মায়ের কাছে..... আসলে ও তো মায়ের এই ডাকের অপেক্ষাতেই থাকতো, রোজ নিয়ম করে সন্ধ্যেবেলা কারেন্ট চলে যেত ওদের আধা মফস্বল শহরে, কোনোদিন এক ঘন্টা, কোনোদিন তারও বেশি, মা ডাকলেই একদৌড়ে ও রান্নাঘরে।
মায়ের গায়ের একটা মিষ্টি গন্ধ , সেটা যে কিসের ও বুঝতে পারতোনা।
তেল সাবান, স্নো, পাউডার, মায়ের কাচা শাড়ী, সব মিশিয়ে ওটা ছিলো ওর মায়ের গন্ধ, তার সাথে রান্নার ফোড়নের গন্ধে ও কেমন বিবশ হয়ে যেত, পড়া তো কত হত!
শিবানীর শুধু ইচ্ছে হতো মায়ের সাথে গল্প করতে, মনে আছে, মা হারিকেনের আলোয়, ঘামতে ঘামতে আঁচল দিয়ে মুখ মুছতো, আর একহাতে শিবানীকে একটু একটু পাখার হাওয়াও করে দিতো, তখন গ্যাস ছিলোনা, মা তোলা উনুনে রান্না করতো, মা একটা আলু বেগুনের তরকারি করতো, যার স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে যেন! এখন এত রকমারি খাবার, না চাইতেই চলে আসে, কিন্তু সেই তৃপ্তি, সেই ভালোলাগা যেন কোথায় হারিয়ে গেছে!
আর সমিতদা! লোডশেডিং আর সমিতদা যেন একাকার হয়ে আছে!
আজ অনেকদিন পর হঠাৎ লোডশেডিং সব স্মৃতির দ্বার খুলে ওকে যেন এলোমেলো করে দিলো।
কিশোরী শিবানী, তখন বোধহয় ক্লাস নাইন,টিউশন থেকে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলো। হঠাৎ কারেন্ট চলে গেল, এমনিতে শিবানী খুবই সাহসী,কিন্তু চারিদিকে চাপ চাপ অন্ধকারে সেদিন ওর কেন জানিনা বেশ ভয় করছিলো। হঠাৎ একটা টর্চের আলো ওর মুখে এসে পড়লো, সাথে সাইকেলের ক্রিং ক্রিং!
"তুই রিম্পা না? প্রসূনের বোন.....নে, বোস আমি পৌঁছে দিচ্ছি। ভয় পাসনা, আমি প্রসূনের বন্ধু।"
না, সেই সময়টা এতটাও অবিশ্বাসের সময় ছিলোনা, তখন চেনা পরিচিতরা যেমন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতো, তেমনি ভরসা করাও যেতো তাদের।
"আমি চলে যেতে পারবো"
ওর আপত্তি ধোপে টেকেনি, সেদিন সমিতদার সাইকেলে ও বসতে রাজি না হওয়ায় সমিতদা ওকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলো।
ভালোলাগার সেই শুরু, তারপর মাঝে মাঝেই সমিতদা ওদের বাড়ি আসতো, ওকে নানা বিষয় নিয়ে রাগাতো, কিন্তু তারই মাঝে কখন যেন ওদের মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছিলো।
...
তখন দাদা ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তে কলকাতায়, দাদার সে বছর ফাইনাল ইয়ার, আর শিবানী সবে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে কলেজে ভর্তি হয়েছে।
কলেজের বন্ধুবান্ধব,সমিতদার সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক, শিবানীর নিজেকে একটা রঙিন প্রজাপতির মতো মনে হতো!
মনে হতো ও হাওয়ায় উড়ছে যেন।
সমিতদা তখন গ্র্যাজুয়েশনের পর এটা সেটা পরীক্ষা দিয়ে চাকরির চেষ্টা করছিলো।
সেদিন সকাল থেকে ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছিলো। একটু জ্বর জ্বর মনে হওয়াতে শিবানী সেদিন কলেজ যায়নি। তখন এতো ফোনের রমরমা ছিলোনা, মোবাইল তো অনেক দূরের, ওদের বাড়িতে কোনো ল্যান্ডফোনও ছিলোনা।
ওকে কলেজ যেতে না দেখে সন্ধ্যেবেলায় সমিতদা ওদের বাড়ি খোঁজ নিতে এসে, সোজা ওর ঘরে চলে এসেছিলো।
ঠান্ডা লেগে ওর গা'টা একটু ছ্যাঁক ছ্যাঁক করছিলো, তাই বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটা গল্পের বই পড়ছিলো। আচমকা সমিতদাকে ঘরে ঢুকতে দেখে ও তাড়াতাড়ি উঠতে যাচ্ছিল, সমিতদা ওকে শুয়ে থাকতে দেখে বললো, ''কি রে, অসময়ে শুয়ে আছিস? শরীর খারাপ নাকি?"
তারপর ওর মাথায় হাত দিতেই দেখে গা গরম, ওর বিছানায় ওর পাশে বসে সমিতদা বললো, ''তুই রেস্ট নে, শুয়ে পর'', ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল সমিতদা।
আর ঠিক তখনই সেই নির্ধারিত লোডশেডিং!
অন্ধকার ঘর, চোখ একটু সয়ে যেতেই দেখে বাইরে থেকে পূর্ণিমার আলো এসে ওদের দুজনের ওপর পড়েছে।
সেই অপার্থিব আলো, এতো কাছাকাছি ওরা দুজন... দুজনেই বিহ্বল হয়ে গেছিলো।
কখন যেন দুজোড়া ঠোঁট খুব কাছে এসেছিলো।

এই প্রথম গভীর আবেশে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেছিলো। মা তখন ঠাকুরঘরে সন্ধ্যে প্রদীপ দেখাচ্ছিল, শিবানী একা ঘরে আছে, লোডশেডিং হয়েছে, মা তাড়াতাড়ি আলো নিয়ে ওর ঘরে আসছিলো, বাবাও অফিস থেকে ঠিক সেসময়ই ফিরেছে।
সকালবেলায় ওর জ্বর দেখেই বাবা গেছিলো, তাই অফিস থেকে ফিরেই ওর ঘরে ঢুকেছিলো।
মা বাবা প্রথমে কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেছিলো বোধহয়, তারপর ওই শান্ত মা রাগে ফেটে পড়েছিলো, যাচ্ছেতাই বলে অপমান করেছিলো সমিতদাকে, বাবা একটাও কথা না বলে নিজের ঘরে চলে গেছিলো।
সেই শেষ, সমিতদা একটা চাকরী নিয়ে চলে গেছিলো অনেক দূরে, ওর সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখেনি।
বেল বাজার শব্দে সম্বিৎ ফেরে শিবানীর, স্বামী,শুভময়ের ফেরার সময় হলো।
শিবানী তাকিয়ে দেখে কখন লাইট চলে এসেছে, চারিদিক আলোয় আলো।ভাবনার গভীরে ও এতই তলিয়ে গেছিলো, আলো ফিরে আসাটা খেয়ালই করেনি।
ওর মনে হয়, আশ্চর্য যার কথা ভাবলে এখনো ওর ভেতরটা আলো হয়ে ওঠে, তার সাথে যেন অন্ধকার ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে, আর শুভময়, যে ওর জীবনটা আলোয় ভরিয়ে রেখেছে, সে কোনোদিন ওর অন্তরের আলোর সন্ধান পায়নি!
হয়তো এর নামই জীবনপথের পিছনে ফেলে আসা স্মৃতির মণিকোঠা, যেখানে অন্ধকারে ঢেকে রাখা কত সুখের পরশ ব্যাথা হয়ে শুধুই অপেক্ষায় থাকে--- হ্যারিকেনের ম্লান শিখার একটু আলোর ছোঁয়ার!
এমন সব অতীত বোধহয় ফিরে ফিরে মনের আশ্রয় খোঁজে চির তরে বিলীন হওয়ার আগের মুহূর্তে।


সুসভ্যতার প্লাবন / শমিতা চক্রবর্তী



ট্রেন থেকে নামতেই ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হল উঃ আবার বৃষ্টি -বিরক্ত হল তিস্তা ! শনি -রবি দুটো দিন স্কুল ছুটি আর সোমবার টা ছুটি নিতেই হল তবেই না আসতে পারলো -হালিশহরের বাড়িতে ! সত্যি আজ প্রায় দুবছর বাদে এখানে এলো ভাবা যায় ! সেই এসেছিলো জ্যেঠু মারা যাবার পর !  আজকাল মোটে সময় করে উঠতে পারে না ওর স্কুল , তাতানের স্কুল -অয়নের হসপিটাল সব মিলে ঝড়ের বেগে দিনগুলো কাটছে বাপের বাড়ি ঘুরতে আসা এখন বিলাসিতা --তাও যদি বাবা -মা থাকতো ! 
             এবার আসতেই হল বড়দার জরুরী তলব বাড়ি নিয়ে কিসব কথা বার্তা আছে ! বাপ -মায়ের একমাত্র সন্তান তিস্তার কাছে এই তুতো ভাইরাই তো সব ! বড় জ্যেঠুর ছেলেই ওদের সবার বড়দা --জ্ঞান হয়ে এস্তক সেটাই মেনে এসেছে ! 

                  বাড়ির কাছে রাস্তার মোড়টায় রিক্সাটা আসতেই -বড়দার মেয়ে টিউলিপ দৌড়ে এসে পাকড়াও করলো তিস্তা কে --ও পিসিমণি কতদিন পরে এলে গো --তোমার জন্যই দাঁড়িয়ে আছি --ওমা একদম ভিজে গেছো যে ! একরকম টানতে টানতেই বাড়ি নিয়ে এলো ওকে --কি ছেলেমানুষ আছে এখনও টিউলিপ টা --কে বলবে ও মাস্টার্স করছে ! টিউলিপের হাত ধরে আসতে আসতেই কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগলো বাড়ির সামনে টা !  মেয়েটার তাড়নায় আর ভালো করে বোঝাই গেলো না ব্যাপারটা --তার ওপর এই বৃষ্টির উত্পাত ! 
           
                      বড় বৌদি সেই আগের মতোই আছে সহজ সরল হাসিখুশী ! কত আন্তরিক জড়িয়ে ধরলো তিস্তা কে ! ইস্ ভিজে গেছিস যে এক্কেবারে নে নে আগে ফ্রেশ হয়ে নে শুকনো জামাকাপড় পর আমি আদা দিয়ে চা বসাচ্ছি ! 

                      সন্ধ্যেবেলায় জমজমাট আসর ছোড়দা , ফুল দা , রাঙা দা সব্বাই উপস্থিত --এমনকি ছোটকার ছেলে পিকু সবার আদরের ছোট ভাই সেও  উপস্থিত -সপরিবারে ! ইস্ মনে হচ্ছে সেই আগের মতো !  এই জল ছপছপ সন্ধ্যেয় জমজমাট মুড়ি আর তেলেভাজার আসর বড় বৌদি তাড়া দিলো নাও সব চটপট খেয়ে নাও কুমু দির হাতের গরম গরম পাকোড়া . গলা চড়িয়ে বললো চায়ের জলটা বসাও কুমু দি এরপর কিন্তু চায়ের অর্ডার যাবে !  হাসি ঠাট্টায় মশগুল সবাই ! সবাই তো এসে গেছো দেখছি এবার তাহলে কথাটা বলেই ফেলি বড়দা আসল কথায় এলো দেখো তোমরা সবাই যে যার কাজের জায়গায় থাকছো প্রত্যেকেই নিজেদের ফ্ল্যাট গুছিয়ে নিয়েছো , কিন্তু কথা হচ্ছে এই এত্তো বড় বাড়ি -বাড়ির আশেপাশের জমি সব মিলিয়ে তো দশ /বারো কাঠা হবেই --এসব আমাকে একাই দেখভাল করতে হচ্ছে , ভেবেছিলাম ছেলেটা সাথ দেবে -কিন্তু সেও তো এখন ক্যালিফোর্নিয়ায় এদেশে আর ফিরবে বলে তো মনে হয়না . আমারও বয়স বাড়ছে বাবা -কাকারাও সব একে একে গত হলেন --সব কিছু আগলে রাখা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে বুঝলে ! ঐ যে গো মিশ্র বাড়ির ছেলে -এখন এখানকার একজন বড় প্রোমোটার ,  নেতা -মন্ত্রীদের সঙ্গে এখন তার ওঠাবসা !  তা সেদিন সে বললে --চিনুদা সব ভাইবোন তো আপনাকে ছেড়ে কেটে পড়লো --আপনিই এখন বাড়ি আগলে বসে আছেন --দিন না আমাকে বাড়ি -জমি --ভালো দাম পাবেন -সঙ্গে একটা পুরো ইউনিট ও !  -----ভাবছি প্রস্তাব টা মন্দ নয় --কি বল তোমরা ?  এই তো দেখোনা ---দেবী পিসি -মিহির কাকুদের বাড়িটাও তো ও -ই কিনে  নিলো --ওখানেও একটা মস্ত বড় আবাসন উঠবে নাকি . তিস্তা এবার বুঝলো বাড়ির সামনে টা অমন খাঁ খাঁ লাগছিলো কেন ! দেবী পিসি -মিহিরকাকু দের বাড়িটাই উধাও ---কেমন যেন মন কেমন করে উঠলো --ও তখন খুব ছোট্ট --দেবী পিসির বিয়ে হল --ঐ ওদের ছাদে প্যান্ডেল -খাওয়াদাওয়া --সব মনে আছে !  দেবী পিসি আর নেই --তবু তো সমস্ত বাড়িটা জুড়ে ওদের স্মৃতিমাখা একটা গল্প ছিল --সেটাও নিশ্চিন্হ হয়ে গেল !  এক বুক শূন্যতা অনুভব করলো তিস্তা ! 

                     বড়দার প্রস্তাবে ছোড়দা , রাঙা দা , ফুল দা , পিকু সব হ্যাঁ হ্যাঁ করে রাজী হয়ে গেল --তাই তো আমরা আসতেও পারি না --এরপর টিউলিপের বিয়ে থা হয়ে গেলে তো তুমি আর বৌদি --আর কুমু দি যতদিন আছে আর কি ! --বাকি রইলো তিস্তা --বড়দা ওর সম্মতি পাবার আশায় ব্যকুল হল ! 

                       তিস্তার চোখ ছলছল করে উঠলো --এ বাড়ি ময় তার শৈশব -কৈশোর -সদ্য যৌবনের কত স্মৃতি ছড়ানো ! ঐ যে বসার ঘরের কোণে শ্বেত পাথরের গোল টেবিল --আর তার ওপর বুদ্ধ মূর্তিটা --জন্মের পর থেকেই দেখে আসছে --দাদাই মানে ঠাকুর্দার সংগ্রহ !  ঐ যে ভিতরের বারান্দায় বড় ডাইনিং টেবিল টা --বাবা কিনেছিলো --সেই ওর কোন ছোট্ট বেলায় --বাড়ির এতগুলো সদস্য -বড় টেবিল না হলে চলে !  ঠাম্মি খালি ওটার ছোয়াঁচ বাঁচিয়ে চলতো -আঁশ নিরামিষ এর ব্যাপার তো আছেই !  আর দাদাই -ঠাম্মির বড় ঘর টা -মেহগনি কাঠের মস্ত পালঙ্ক --ঠাম্মির পাশে শোবার জন্য ভাই বোনদের সে কি প্রতিযোগিতা --শেষে লটারী হতো --কে শোবে ঠাম্মির পাশে !  আর ঐ ঘরের মস্ত কাঠের আলমারী টা -যেটায় এখনও বোধহয় ঠাম্মির গায়ের গন্ধ মাখা শাড়িগুলো পাট পাট করে রাখা ! সেই লাল পাড় গরদের শাড়িখানা যেটায় ঠাম্মি কে মা দুগ্গার মতো লাগতো !  
              দক্ষিণের বারান্দাটা কে দেখেও ভীষণ মন কেমন করে উঠলো  তিস্তার সেই গরমকালের সন্ধ্যেগুলো ঐ বারান্দায় সব ভাইবোনদের দুলে দুলে পড়া মুখস্থ করা ছোটকা মাঝে মাঝে এসে দেখে যেতো সত্যিই পড়াশোনা চলছে কি না ! পুকুরের ঠান্ডা হাওয়া এসে জুড়িয়ে দিতো গরমের ভ্যাপসানি !  দক্ষিণের বারান্দা টা আরও একটা কারণে ভারী পছন্দের ছিলো তিস্তার --ঐ বারান্দার জাফরীর আড়াল দিয়েই চলতো বৈদ্য বাড়ির মেয়ে মুকুলের সঙ্গে ওর পড়ার ফাঁকে আড্ডা ! আর দোতলার ঝুল বারান্দা থেকে কতদূর দেখা যেতো স্টেশন বাজার -চৌমাথা মোড় -রেল কোয়াটার্স !  ঐ বারান্দায় দাঁড়ালে কখন সময় পার হয়ে যেতো ! 
                   আর একটা প্রিয় জায়গা এই বাড়িটার চিলেকোঠার ঘর ! মা -র জ্যেঠিমাদের সব বাতিল ট্রাঙ্ক ঐ ঘরে --মা-র ট্রাঙ্কে তিস্তার কত জিনিস ঝিনি পিসির দেওয়া বিদেশী ডল , রান্নাবাটির হাতা -খুন্তি -কড়াই ; কতরকমের ডাক টিকিট , কতরকমের খাম গোলাপী , হলুদ , ফুল ফুল ছাপ ! স্কুলের হাতের কাজের তৈরী রুমালের সেট -আর ও কত কি ! বড় হবার পরে ওগুলো মাঝে মধ্যেই নেড়েচেড়ে দেখতো তিস্তা ! 

         কেমন যেন আবেগশূন্য হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী টা ! এই একান্নের সংসারগুলো সব ভেঙে খান খান হয়ে ছোট ছোট নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি তৈরী হচ্ছে ! সাবেকী বাড়িগুলো সব নিশ্চিন্হ হয়ে যাচ্ছে --সে জায়গায় উঠছে মস্ত মস্ত বহুতল ! সেই বহুতল গুলোর একেকটি ইউনিট যেন একেকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ! সেই দ্বীপগুলির বাসিন্দারা সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত কারো সময় নেই অন্যকে নিয়ে মাথা ঘামানোর ! 
                 আর সাবেকী বাড়িগুলোর সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে কতগুলো পরিচিত জায়গা চিলেকোঠার ঘর , দক্ষিণের বারান্দা , বার উঠোন , তুলসী মঞ্চ আর ও কত কি ! 

                  আনমনা তিস্তা কে সচকিত করে বড়দা বলে উঠলো তা তুই কি বলছিস তিস্তা ? ভেবে বলতে পারিস -চাইলে অয়নের সঙ্গে ও এ ব্যাপারে আলোচনা করে নিতে পারিস . না বড়দা আমি আর আলাদা কি বলবো আর অয়ন ই বা কেন এ ব্যাপারে কথা বলবে বল ! তোমরা যা ভালো বোঝ তাই কর .না না তা বললে হয় তুই হলি গিয়ে আমাদের একমাত্র বোন তোর একটা মতামত তো চাই !ঐ যে বললাম -তোমরা যা বলবে ! 

                 পরদিন খুব সকাল সকাল তিস্তার মোবাইল অনবরত ক্লিক ক্লিক করে গেলো বাড়ির সামনের বড় গেট সেনগুপ্ত ভিলা লেখা ফলক টা , দক্ষিণের বারান্দা , চিলেকোঠার ঘর , তুলসী মঞ্চ , শ্বেত পাথরের টেবিল -বুদ্ধ মূর্তি , বাড়ির পিছনের বাগানে সেই কবেকার জামরুল গাছ টা সবাই ধরা থাকলো ক্যামেরায় ---সুসভ্যতার তুমুল প্লাবনে যারা নিশ্চিত বিলুপ্তির পদধ্বনি শুনছে ! 


যা হারিয়ে যায় - সোমা বসু




গত অর্ধ শতাব্দী ধরে জীবন থেকে হারিয়েছে কত কিছু তা কি বলে শেষ করা যাবে, সে তো একটা দুটো নয় গো নয়... 

সকালবেলা ঘুমভাংগার সংগে কানে ঢুকতো... আকাশবাণী কলকাতা, স্থানীয় সংবাদ পড়ছি নীলিমা সান্যাল...

তারপরে শিল্পীর গাওয়া লাইভ রবীন্দ্র সংগীত ! 
ঘুম থেকে উঠে খাওয়ার টেবিলে থাকত মুচমুচে ব্রেড টোষ্ট আমূল বাটার মাখানো । রান্না মাসীর জলদি হাতে বানিয়ে দেওয়া ঘি এর গন্ধ মাখা সাদা ধবধবে দুধ ঢালা মিষ্টি মিষ্টি কাঁচের প্লেট ভরতি ভাজা সুজি চিনি ছড়ানো । 

চা ছিল দুর্লভ কারণ বয়স ছিল অল্প। এখন কিন্তু পাল্টেছে ধারণা, চা নাকি অনেক রোগের প্রতিষেধক, এমনকি ক্যান্সারের ও। 

হারিয়েছে কাঁধের কাছে আলগোছে দুলতে থাকা একমাথা কালোচুলে মা'র সযত্নে সবল হাতে গড়া মোটাসোটা দুই বিনুনি,... 

চোখে প্রোগ্রেসিভ লেন্স এর হাল ফ্যাশন চশমার সংগে একটু ভারী শরীর আর গুরুগম্ভীর পদে আসীন সেদিনের স্কুলের বাচ্চা মেয়ের দুই বিনুনির দোলন বড়ো বেমানান মানতেই হবে ! 

আর একটু বড়ো যখন সেই মেয়ে... 

কলেজ যাওয়া আসার পথের পাশের ঝুলন্ত ব্যালকনির সুন্দর এক যুবকের সংগে চোখ পাতাপাতির প্রথম নরম মুহূর্ত আজকের সুঠাম সুন্দরী নারী হয়ে ওঠা এই রমণীর কঠিন বাস্তবে পথ খুঁজে পেল না, সেই দুই মন আজও দেখা হলে মনের নিবিড় হারিয়ে যাওয়া ছায়ায় কুসুম কোরক খোঁজে, দুহাত ভরে তুলে আনে সোনালী রোদমাখা বিকেলগুলোর অনাবিল ভালো লাগা ভালোবাসা বাসির মুহূর্তগুলো... জানা গেলো সে এখন দুই কন্যার পিতা, সেই কলেজ যাওয়া কন্যার এখন ঐ বয়সী জিন্স টি শার্ট পরা এক সুন্দর কন্যা আর লম্বা ঋজু সুঠাম লাজুক এক পুত্র... মনের যত আনন্দের উৎস... এক নিমেষপাতে উজান বাওযা দুটি মনের গভীরে ডুব  ! 

সেইসব কলেজ জীবনের রোমাঞ্চ জাগানো সন্ধ্যা গুলো পাশাপাশি বসে অলস গল্পে সময় কাটানোর সূর্যাস্তের আভায় রংগীন, এখন ঐ নদীর ধার ঐ খোলা মাঠে কালবৈশাখীর ঝড় আর কি আসে সব উড়িয়ে নিয়ে সব চাওয়া পাওয়া এলোমেলো করা মনমাতানো ভালো লাগা ফিরিয়ে দিতে ! 

ঝড়ের শেষে অঝোর বৃষ্টিভেজা শরীরী আলিংগনের একমাত্র সাক্ষী গাছের মাথা ছাড়িয়ে উঁচু আধখানা আকাশ জুড়ে উঠে থাকা সাতরংগা বাহারে রামধনুখানা ! 
নিরনিমেষ ...

লজ্জাজডানো চাউনি নেমেছে কপোল বেয়ে উষ্ণ অধীর দুটি অধরোষঠে, স্বাদ পেয়েছে যৌবনের উন্মাদ অধীরতার ! বর্ষা নেমেছে শরীর ছাপিয়ে... 

আজ সব একাকার ! সেই দুর্লভ একান্ত ভালোবাসার রামধনু সব রং হারিয়ে হয়েছে বহু সুলভ, যখন ইচ্ছে পাওয়া যাবে ঝটিতি তার স্বাদ, না ই বা থাকলো তাতে মনের সংযোগ, শরীর তো পাওয়া যাবে ষোল আনার ওপর আঠারো আনা পছন্দমত ! 

আর... সবকিছু হারিয়ে ফেলার আগে চলো পিছিয়ে যাই সেই আঙিনায, সেই মাঠে ঘাটে যেখানে এখনো কিছু উষ্ণ ভালোলাগা ছড়িয়ে আছে পাতায় পাতায় ঘাসে ঘাসে... রঙীন ফুলের আলপনায... 

"কালের সাগর পাড়ি দিয়ে এলেম চলে নিদ্রাবিহীন গগনতলে" 

যেখানে
" তারায তারায দীপ্ত শিখার আগুন জ্বলে" 



সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া