স্বপ্নস্বরূপ - ১
নন্দিনী
সেনগুপ্ত
প্রথমেই বলে
রাখি আমি রবীন্দ্র- বিশেষজ্ঞ নই। না, সাহিত্য আমার বিষয় নয়। আর পাঁচটা বাঙ্গালী
মানুষের মত আমার অনুভবে এবং বোধে রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে ফেরার জন্যই হয়ত এই লেখা।
তিনি আছেন। কিভাবে আছেন কি করে বলি? তাকে জানার ব্যাকুলতা আছে, সেটুকুই সম্বল।
এই সবে পৌষ
মাস পড়ল। শিশু বা কিশোরীবেলায় যখনি স্কুলে বা পাড়ায় রবীন্দ্রজয়ন্তী করবার সময়
ঋতুরঙ্গ করা হত, তখন অবধারিতভাবে শীতের জন্য যে গান বাছা হত, সেটা ‘পৌষ তোদের ডাক
দিয়েছে’ অথবা ‘শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন’। শিশুকালে এই দুটি গানে গলা মেলায় নি বা
নৃত্যের তালে হাত-পা দোলায় নি, সাধারণ বাঙালি বাড়িতে এমন মানুষ বোধ হয় পাওয়া
মুস্কিল। কিন্তু আরও মুস্কিল থাকত অন্য জায়গায়। রবীন্দ্র-জয়ন্তী মানেই ত বৈশাখ
মাস। ওইরকম গরমে পৌষমাসের কথা ভেবে গান গাওয়া বা নৃত্য পরিবেশন করা সত্যিই কঠিন
কাজ বলে আমার মনে হয়। নেহাত শিশুরা অত বুঝে উঠতে পারেনা, অতএব বিদ্রোহ করে না।
বড়রা যেরকম শিখিয়ে দেন বা করতে বলেন তারাও সেটাই করে থাকে। বেশ উৎসব-উৎসব একটা
ব্যাপার চলতে থাকে সবাইকে ঘিরে। আসলে ওই দুটি গানের মধ্যে কবিও যে উৎসবের ভাবটিই
ধরবার চেষ্টা করেছেন। অঘ্রাণের শেষের
সুপক্ক ফসলে পরিপূর্ণ মাঠের কথা, কিংবা শিরশির করে একযোগে গাছগুলির পাতা খসিয়ে
দেওয়া, এসব কিছুই যেন এক উৎসবের অঙ্গ। প্রকৃতির ঋতুবদলের উৎসবে মানুষকে সামিল করে
নেওয়া যেন এই দুটি গানের অবশ্যম্ভাবী ব্যাপার। শীতের শীতলতার মাঝে প্রকৃতি এবং
মানুষের সেতুবন্ধন এবং উৎসবের মাঝে একে অপরকে আপন করে নিয়ে উষ্ণতা খুঁজে ফেরবার
ইচ্ছেগুলোই ব্যক্ত হয়ে ওঠে এইধরনের সঙ্গীতে।
কিন্তু শীত
মানেই যে শুধু উৎসব নয়। তিনি কবি, সত্যদ্রষ্টা, তাই তার গানে শীতের রিক্ত রূপের
বর্ণনা থাকবে না, এ অসম্ভব। যখন শুনতে পাই... ‘শীতের বনে কোন ষে কঠিন আসবে বলে,
শিউলিগুলি ভয়ে মলিন’, তখন বুঝি সেই নিষ্ঠুর ঋতুর রূপ। কবি ছাড়া আর কে পারবেন এই
অনুভবের গভীরতা বুঝিয়ে দিতে? পাতায়-ঘাসে কোনও চঞ্চলতা যে আর তার সয় না, সে কথা যে
তিনি না বললে জানতে পারতাম না! তিনি তার লেখায়, গানে বারে বারে যেন চোখে আঙ্গুল
দিয়ে দেখিয়ে দেন, কিভাবে বুঝে নিতে হয় প্রকৃতির হৃদয়ের কথাখানি। শীতের আগমনে
হাওয়ায় ভেসে বিলীন হয়ে যায় কাশের গুচ্ছের উচ্ছ্বসিত হাসি, কথা দিয়ে এমন ছবি তিনি ছাড়া আর কে পারেন আঁকতে?
কবির বিলেতবাসের
প্রথমদিকের স্মৃতিতে দেখতে পাই তার সতেরো বছর বয়সে শীতের এক অদ্ভুত রূপ প্রত্যক্ষ করার কথা। কবি
বলছেন, “... বাহিরে গিয়া দেখিলাম, কনকনে
শীত, আকাশে শুভ্র জ্যোৎস্না এবং পৃথিবী সাদা
বরফে ঢাকিয়া গিয়াছে। চিরদিন পৃথিবীর যে মূর্তি দেখিয়াছি, এ সে নয় - এ যেন
একটা স্বপ্ন, যেন
আর কিছু — সমস্ত
কাছের জিনিস যেন দূরে গিয়া পড়িয়াছে, শুভ্রকায় নিশ্চল তপস্বী যেন
গভীর ধ্যানের আবরণে আবৃত। অকস্মাৎ ঘরের
বাহির হইয়াই এমন আশ্চর্য বিরাট সৌন্দর্য আর কখনো দেখি নাই।”
কবি তার জীবনে পরবর্তীকালে বহুবার নানা দেশে ভ্রমণ করেছেন,
দেখেছেন বিভিন্ন দেশে শীতঋতুর বিচিত্র রূপ, কিন্তু প্রথম দেখা এই বরফপাত যে তাঁকে
বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছিল, তাতে সন্দেহ নেই।
মানুষের সমস্ত জীবন যেমন শেষ বেলায় বার্ধক্যে এসে পূর্ণতা
পায়, কবির অনুভবে শীতও যেন তেমন ধ্যানগম্ভীর। সবকিছু ভরিয়ে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে নিজে হয় শূন্য,
রিক্ত। কবির বেশ কিছু লেখায় দেখি এই ঋতু
যেন সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীর মত নিজেকে সরিয়ে রেখেছে দূরে; হয়ত মানুষে মানুষে
উষ্ণতার বন্ধন খুঁজে নেবার দিচ্ছে এক সুযোগ, সে নিজেও জানে একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে
তার এই জরাগ্রস্ত শরীর। বসন্তের জন্য স্থান ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে হবে তাকে।
বেশ লেখাটি...
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ!
Deleteশীতের শীতলতার মাঝে প্রকৃতি এবং মানুষের সেতুবন্ধন...
ReplyDelete...
অনেক ধন্যবাদ!
Deleteনন্দিনীর সুন্দর লেখার মধ্য দিয়ে কবির দৃষ্টিতে শীতকে নতুন ভাবে দেখলাম। খুব ভাল লাগল।
ReplyDeleteপ্রকৃৃ্তি ও মানুষ...বর্ষ শেষের ঋতু আর মানুষের বার্ধক্য...কবির দৃষ্টি ও নন্দিনীর লেখনী......খুব সুন্দর ভাবে আমাদের কাছে পৌঁছলো
ReplyDelete