Monday, January 23, 2017

স্বপ্নস্বরূপ - ২ নন্দিনী সেনগুপ্ত



এই ত সেদিন, একটা বইয়ের দোকানে বই কিনতে গিয়েছিলাম। খুব সুন্দর করে সাজানো পুস্তক বিপণী। দোতলায় আবার চা-কফি খাবার জায়গা। সেখানে গিয়ে দুই চেনা মুখের সঙ্গে দেখা। হাসি- মজা- সেলফি- ছবি তোলা এসব শেষ করে বই কিনে বেরিয়ে আসবো, হঠাৎ মনে হল আমার ভীষণ চেনা, ভীষণ পরিচিত   একজনের চোখে চোখ পড়ল। মনে হল সে আমাকে পেছন থেকে ডাকছে। হ্যাঁ, সেই চোখ। এই ছবিটাই ত আজন্মকাল দেখে আসছি আমার মায়ের ঘরে। সেই যে, গোঁফদাঁড়ির ফাঁকে ফাঁকে মনে হচ্ছে একটু কৌতুক  নিহিত আছে। যেন বলছেন, ‘আমি কি তোর চেনা নই?’ কি করে বলি, ভীষণ চেনা! তাঁকে চেনা কি সহজ ব্যাপার?  আমি ত আমার মত করে চিনে নিতে চাই। ‘জানি জানি আমার চেনা, কোনও কালেই ফুরাবে না’। অচেনাকে চেনবার ইচ্ছে তিনি জাগিয়ে দিচ্ছেন বারে বারে, আবার তিনিই রাশ টেনে ধরে বলছেন...   
কেউ যে কারে চিনি নাকো        সেটা মস্ত বাঁচন । 
তা না হলে নাচিয়ে দিত            বিষম তুর্কি -নাচন ।‘ ...    
চেনা-অচেনার এই বিষম দ্বন্দ্ব শিশুকাল থেকে তিনিই হয়ত বা জাগিয়ে দিয়েছেন মনের মধ্যে। বলেছেন,
ছাদের কোণে পুকুরপারে         জানব নিত্য-অজানারে
                   মিশিয়ে রবে অচেনা আর চেনা;
জমিয়ে ধুলো সাজিয়ে ঢেলা             তৈরি হবে আমার খেলা,
পরম চেনা পরিসরেও যে কতকিছু অজানা, অচেনা সেকথা ত তিনিই শিখিয়ে দিচ্ছেন। মনে হয় যেন চেপে  ধরে আছি তাঁর হাত। হ্যাঁ, ওই আলখাল্লার হাতাটিও যেন আমার চেনা। স্বপ্নে এসে চিনিয়ে দিতে চান স্বরূপ। ঘিরে আছেন প্রতি পদক্ষেপে, অথচ চেনা হয়ে ওঠেনা। কি এক অন্ধতার আবরণে বারে বারে সরে যাই তাঁর ভাবনা থেকে।      
যারা কবিতা লেখেন, উপমা হিসেবে খুব স্বাভাবিক কারণেই চেনা জিনিস বেছে নেন। অচেনা জিনিস দিয়ে কবি উপমা তৈরি করবেন কিভাবে? হ্যাঁ, পারবেন, তবে তাকে সেই জিনিসটি আগে চিনিয়ে দিতে হবে পাঠক- পাঠিকাদের। তিনি সেই কঠিন কাজটিই করেছেন তার সারা জীবনের লেখায়। সেই অর্থে কবি যেন  একজন যাত্রী। বেরিয়ে পড়েছেন অচেনা নিরুদ্দেশের পথে। সঙ্গী করে নিয়েছেন আমাদের কি অনায়াস দক্ষতায়। পথের প্রতি বাঁক চিনিয়ে দিচ্ছেন এমন ভঙ্গীতে যেন তিনিও প্রথম দেখছেন অচেনাকে। বিস্মিত হচ্ছেন আমাদের মতই। না, কোনও জ্ঞান দেওয়ার ভঙ্গী নেই। আমরা তাকে বসিয়েছি গুরুদেবের আসনে, কিন্তু তিনি যে বারে বারে পথের ধূলায় নেমে এসে ধরছেন হাত। আর পাঁচটা গড়পড়তা বাঙ্গালী মানসিকতার থেকে তিনি ঠিক এইখানেই আলাদা। কোনওদিন চাননি গুরুমশাইগিরি করে নিজেকে সব্বার থেকে সরিয়ে রাখতে। ‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’ প্রবন্ধে বলছেন,...  
যিনি জাত-শিক্ষক ছেলেদের ডাক পেলেই তাঁর আপন ভিতরকার আদিম ছেলেটা আপনি ছুটে আসে। মোটা গলার ভিতর থেকে উচ্ছ্বসিত হয় প্রাণে-ভরা কাঁচা হাসি। ছেলেরা যদি কোনো দিক থেকেই তাঁকে স্বশ্রেণীর জীব বলে চিনতে না পারে, যদি মনে করে লোকটা যেন প্রাগৈতিহাসিক মহাকায় প্রাণী, তবে থাকার আড়ম্বর দেখে নির্ভয়ে সে তাঁর কাছে হাত বাড়াতেই পারবে না। সাধারণত আমাদের গুরুরা প্রবীণতা সপ্রমাণ করতেই চান, প্রায়ই ওটা শস্তায় কর্তৃত্ব করবার প্রলোভনে, ছেলেদের আঙিনায় চোপদার না নিয়ে এগোলে সম্ভ্রম নষ্ট হবার ভয়ে তাঁরা সতর্ক। তাই পাকা শাখায় কচি শাখায় ফুল ফোটাবার ফল ফলাবার মর্মগত সহযোগ রুদ্ধ হয়ে থাকে।
কখনও তিনি চান নি প্রবীণ গুরুদেব হয়ে উঠতে। সত্যদ্রষ্টা কবির প্রাণ সতত জেগে ছিল বিস্ময়ে।  বিস্ময়, যা অতি প্রয়োজনীয় গুণ- অচেনা যে কোনও জিনিসের মুখোমুখি হবার জন্য, সেই ‘বিস্ময়’ যাতে   কখনও মরে না যায়, সেই আবেদন দেখতে পাই তার লেখার প্রতি শব্দে। অচেনাকে চিনিয়ে দিতে দিতে তিনি গুরুমশাই নন, বরং চিরচেনা পরানসখা হয়ে ওঠেন আপামর বাঙ্গালীর।   
(চলবে)        



No comments:

Post a Comment

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া