‘আমরা’ মানে মিতিলের দাদা অত্রি, বৌদি সুপ্রিয়া আর পাঁচ বছরের ভাইঝি
মৌলী। ওরা চন্দননগরে এক বন্ধুর মেয়ের অন্নপ্রাশনে গেল। মিতিলকেও যেতে বলেছিল।
কিন্তু মিতিলের ভাল লাগছিল না। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা কিছুদিন হল শেষ হয়েছে।
পরীক্ষা তো নয় যেন ঝড় একটা। তাই বেশ কয়েকটা দিন বিশ্রাম করতে চায় সে। আর একলা হলে
তো বেশ ভাল হয়।
এমনিতে তার বন্ধুর বৃত্ত বিরাট বড় ব্যাসার্ধের নয়। মিশুকে বলে তেমন
কিছু নাম তার নেই। দেখা হলে একটু মিষ্টি করে হেসে দেওয়ার বেশি সে কিছু করতে পারে
না। ব্যতিক্রম এই শোভন। দাদার বন্ধু হলেও তার চেয়ে প্রায় পনের ষোল বছরের ওপর বেশি
বড়। অত্রি বোনের থেকে পনের বছর সাত মাসের বড়। আসলে মিতিল হল তার বাবা মায়ের ভালবাসার
একটি দুর্ঘটনার ফল। ছোট সংসার রাখার পক্ষপাতী ছিল তারা। একটা ছেলে হয়েছে এই
যথেষ্ট। কিন্তু জন্মনিয়ন্ত্রণের পাকাপাকি ব্যবস্থা না করে কম সুখে ছিল না। অতএব
পাকাপাকির দরকারটা কি?
আর সেই ফাঁকে এসে পড়েছিল মিতিল। সেটা অত্রির জন্মের প্রায় পনের
বছর পরে। দুর্ঘটনা হলেও অত্রির বাবা মা মিতিলকে বিসর্জন দেয় নি। এখন বরং বলে আহা
তেমন হলে আমাদের এমন ফুটফুটে পরীর মত মেয়েটাকে আমরা হারাতাম।
মাঝে মাঝে মিতিলের মা গল্প করে এ কথা শোনাতো। বেশ ভাল লাগত মিতিলের। খুব খুশি হত। এখন আর তার
মা বাবা নেই। ভয়ংকর এক দুর্ঘটনার ছোবল তাদের দুজনকেই কেড়ে নিয়েছে। তাই অত্রিই এখন
তার বাবার মত। যদিও বৌদি সুপ্রিয়া তার চেয়ে মাত্র সাত আট বছরের বড় তবু সে কিন্তু মিতিলকে
মায়ের আদর দেয়। আর পাঁচ বছরের পুঁচকে ভাইঝি মৌলী তো তার ভাইঝি নয় যেন বোন।
নিজের এমন ভরা সংসারের জন্যে বাইরের কথা বেশি ভাবত না মিতিল। ফেসবুকে হাতেগোনা কয়েকটা
ফ্রেন্ড আছে বটে তবে সে বেশিক্ষন এটা নিয়ে কাটায় না। বাড়িতে যতক্ষণ থাকে তার কেটে
যায় পুঁচকে ভাইঝিটাকে নিয়ে। তার সঙ্গে খেলা, খুনসুটি এমন কি তার খেলাধুলো বা
পড়াশোনায় সাহায্য করা তো বটেই।
টি-ভি বেশি দেখে না। দেখলেও মৌলীকে সঙ্গে নিয়ে ছোটদের চ্যানেল। গল্পের
বই বিশেষ পড়ে না। আজকাল অবশ্য বাংলা বা ইংরেজি গল্পের বই পড়ার রেওয়াজ এমনিতেই কমে
এসেছে অনেক। সবাই মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ এসব নিয়ে মেতে আছে। মিতিল
অবশ্য ব্যতিক্রম। পড়াশোনায় মন্দের ভাল। সেটা নিয়েই সে বেশ খুশি।
তবে একটা জিনিস তার বেশ ভাল লাগে। এই দাদার বন্ধু শোভনকে। দাদার থেকেও
যেন সুন্দর দেখতে। সুঠাম শরীর। গোলগাল মুখে হাসির একটা ছোঁয়া যেন সর্বদাই লেগে
আছে। মাঝে মাঝেই আসে তাদের বাড়িতে। আসে বৌ শ্রাবণী আর ছেলে ব্রতীনকে নিয়ে। সন্ধের
দিকে আসে। তার দাদা অত্রি অফিস থেকে ফেরার পর। এই দুই পরিবার মিলে যেন সারা
সন্ধ্যেটা স্বর্গসুখ উপভোগ করে।
এই হুল্লোড় দারুন লাগে মিতিলের। অমিশুকে মেয়ে হলেও বেশ উপভোগ
করে। কিন্তু সব চেয়ে ভাল লাগে শোভনকে। কি সুন্দর মাথায় ঘন কোঁকড়া কোঁকড়া চুল। বেশ
বড় সড় একটা মোটা শুঁয়োপোকার মত কালো গোঁফ। আর গালে একটা বেশ বড় আঁচিল। মনের হাত
দিয়ে আঁচিল সরিয়ে শোভনকে দেখেছে অনেকবার। কিন্তু কোনবারই ভাল লাগে নি তার এতটুকু। অনেকের
গায়ের জড়ুল চিহ্ন যেমন তার একটা অলঙ্কার স্বরূপ শোভনের গালের জড়ুলটাও যেন ঠিক
তেমনি। অন্তত মিতিলের কাছে।
অত্রি বৌ মেয়েকে নিয়ে বেরিয়েছে সেই সকালে। মিতিলকে আর জোরাজুরি করে নি
ওরা কেউ। সুপ্রিয়া ওর একার মত রান্না করে দিয়ে বলেছে, ঢাকা দেওয়া রইল রে। মনে করে
ঠিক সময় মত খেয়ে নিস। আর বাইরের গেট অকারণে খুলবি না। বিশেষ ভর দুপুরে। চারদিকে
আজকাল যা হচ্ছে। ফেরিওলাগুলোই কি সব কম পাজি। কখন কি মতলবে ঢোকে আগে থেকে বোঝা
মুশকিল। গেট একেবারে খুলবি না কিন্তু মিতিল। যা কথা সব বারান্দা থেকে বলবি।
নীরবে শুধু ঘাড় নেড়েছে মিতিল। ফেরিওলাকে গেট খুলবে না ছাই। এখন
শুধু বিছানায় পড়ে পড়ে ঘুমোবে। মনে মনে বেশ ক্লান্তি বোধ করল সে। যেন অনেকদিন বাড়ির
সকলের সঙ্গে ধস্তাধস্তি খেলেছে। এখন আর ভাল লাগছে না।
পড়ে পড়ে বেশ বেলা পর্যন্ত ঘুমোল। তারপর উঠে চান খাওয়া করে আবার শুল।
এবার কিন্তু ঘুম এল না। টিভি চালাল। প্রথমে বাচ্চাদের চ্যানেল চালিয়ে কিছুক্ষন
দেখতে দেখতে তার আর ভাল লাগল না। মনে হল এই চ্যানেলগুলো মৌলীর সঙ্গে দেখলেই মজা
পাওয়া যায়।
টিভি বন্ধ করে আবার ঘুমোনর চেষ্টা করল। কিন্তু এবারও ঘুম এল না। মাথার
মধ্যে কি যেন একটা ঘুরপাক খাচ্ছে কিন্তু সে ঠিক বুঝতে পারছে না। আবার টিভি চালাল।
এবার রিমোট নিয়ে খেয়াল খুশিমত বাটন টিপতে টিপতে একটা বিনোদন চ্যানেলে গিয়ে হাজির
হল। একটা গানের অর্থাৎ মিউজিক চ্যানেল। সারাদিন এখানে গানবাজনা আর নাচ হয়। অনেক
সিনেমার জনপ্রিয় সিন দেখান হয়। হট গানের সব সিন। কিন্তু মিতিল তো কোনদিন টিভিতে
এসব চ্যানেল দেখেই না। বন্ধুরা টিভি চ্যানেলের নানা অনুষ্ঠান যেমন সিনেমা, সিরিয়াল
বা রিয়ালিটি শো নিয়ে আলোচনা করলে সে চুপ থাকে। জোরাজুরি করলে বলে, দূর আমার ওসব
ভাল লাগে না একদম।
কিন্তু এখন তার বেশ ভাল লাগছে। মনের মধ্যে যেন একটা কম্পন একটা শিহরণ।
রক্তের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে যেন কিসের একটা তীব্র স্রোত। রোমান্টিক সিনটা অবশ
করে রেখেছে একটা আবেশে। একটা মাধুর্য তাকে এমন পেয়ে বসল যে সামান্য একটু ঘুম এসে
গেল।
ধড়মড়িয়ে উঠে বসে ঘড়ি দেখল। টিভিটা এখনও চলছে আর তাতে বিজ্ঞাপন হচ্ছে।
জানলা দিয়ে দেখল সন্ধ্যে প্রায় হয়ে এসেছে। শোভনদা আসবে হয়ত সাড়ে ছটা কি সাতটা। এখন
বাজে প্রায় ছটা।
অলস স্খলিত পদে সে উঠে গেল সিঁড়ি দিয়ে। দু’চোখে ঘুমের মেজাজ। একতলা
বাড়ির ছাদ বেশ সুন্দরভাবে সাজানো। কারুকাজ করা আলসে। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে রাস্তাটা।
রাস্তাটা খুব একটা সরু নয় তাই মাঝে মধ্যে রিক্সোটিক্সোর সঙ্গে অটো টোটো বা
প্রাইভেট কারেরও আনাগোনা আছে। বেশ কিছুক্ষন আলসের পাশে দাঁড়িয়ে রাস্তাটা দেখল মিতিল।
ছাদে একটা আবছা অন্ধকার। ফুলের টবগুলো বেশ কিছু ফুল আর পাতাবাহারে
সাজানো। মিতিল এসব কিছু না করলেও সুপ্রিয়া করে বেশ যত্নের সঙ্গে। নানা ফুলের চারা
সে সংগ্রহ করে আনে নানা নার্শারি থেকে। ছুটির দিনে মাঝে মাঝে অত্রিকে ডেকে আনে
ওপরে। দুজনে খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে এই ফুলগাছ আর পাতাবাহারের দৃশ্য দেখে। দেখতে দেখতে
মোহিত হয়ে সুপ্রিয়ার দিকে কি সুন্দর মুগ্ধ হয়ে তাকায়। দূর থেকে সেই দৃশ্য দেখে মিতিলের
মনের ভেতর কি যেন একটা পুলক জেগে ওঠে সে ঠিক বুঝতে পারে না। গায়ে যেন একটা কাঁটা
দেবার মত ব্যাপার।
অন্ধকার আর একটু ঘন হচ্ছে। এইবার বোধহয় ছটা বেজে গেছে। শোভনের আসার সময়
হল। একটু অন্যমনস্ক থাকলে হয় কলিং বেল বাজিয়ে ফিরে যাবে। ফিরে এসে দাদা শুনে হবে
অপ্রস্তুত। হয়ত মিতিলকে দিতে পারে ধমকও।
ছাদ থেকে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল সে। সিঁড়ির চাতাল এখন অন্ধকার। সিঁড়ির ঘরের
আলো জ্বালান হয় নি। এইবার জ্বালাবে সে। কিন্তু কেমন যেন ভাল লাগছে না মিতিলের। কি যেন একটা মধুর চিন্তায়
অবশ হয়ে আছে তার মন। এই অন্ধকারের ঘনত্ব তার মনে অন্য একটা চিন্তার ঘনত্ব বাড়িয়ে
তুলছে।
চুপ করে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকতে তার ভাল লাগছে। সিঁড়ির মাঝের চাতালে
একটা হালকা পদশব্দ। সে কি! বাইরের গেট কি সে বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল নাকি? কি যেন
একটা আসছে তার দিকে। একটু ভয় ভয় করতে লাগল। আবার অন্য একটা কথা মাথাতেও এল। তবে কি
শোভন মানে শোভনদাই দরজা খোলা পেয়ে চলে এসেছে ভেতরে?
কিন্তু এমন চোরের মত কেন? নাকি সেটা মিতিলের মনে হচ্ছে? শোভনদা তো
তাদের প্রায় ঘরের লোকের মতই। হয়ত তাই সরাসরি চলে এসেছে। তাই বলে এমনভাবে? একবারও
না ডেকেই? কলিং বেল একবার না বাজিয়েই? আর ড্রয়িং রুমে অপেক্ষা করার বদলে সরাসরি
সিঁড়ি দিয়ে ওপরে? মনের মধ্যে একটা অস্বস্তির খোঁচা। আবার বেশ একটা ভাললাগা ভাব।
একটা গাঢ় অন্ধকার যেন তার দিকেই এগিয়ে আসছে। সেই অন্ধকারেই শোভনের পুরু
গোঁফ আর গালের আঁচিলের অস্তিত্ব টের পেল মিতিল। খুব কাছে এসে পড়েছে
শোভনদা। একেবারে কাছে। তার গায়ের গন্ধ তার নাকে আর তার উত্তপ্ত নিঃশ্বাস তার ঘাড়ে।
--শোভনদা! আবেগরুদ্ধ গলায় ফিসফিস করে ডাকল মিতিল। কিন্তু শোভন কোনও উত্তর
দিল না। পরিবর্তে মিতিলের দুই ঠোঁটে একটা উত্তাপের ছোঁয়া। সেই সঙ্গে একটা চাপ।
সারা শরীরের শিরায় শিরায় শিহরণ। একটু আগে সেই রোমান্টিক সিনের নায়িকা মনে হচ্ছে
নিজেকে। নায়কের মতই সুন্দর সুপুষ্ট চেহারা শোভনদার।
বেশ কিছুক্ষন উপভোগ করার পর হঠাৎ তার মনে হল শোভনদা যে তার চেয়ে অনেক
বড়। তাতে বিবাহিত পুরুষ। একটি সুন্দরী স্ত্রীর স্বামী আর ফুটফুটে বাচ্চার বাবা।
কিন্তু তা হোক। এই পরশ তার এত ভাল লাগছে যা আগে কখনও কল্পনাও করে নি। এখন তার মনে হচ্ছে এই
অজানা অনধ্যুষিত জগতটার সম্পর্কে এত উদাসীন এতকাল সে ছিল কি করে?
কড় কড় করে যেন একটা বাজ পড়ল। নিচে গেটে কলিং বেলের শব্দ। মিতিলের হঠাৎ
এখন মনে হল বেলটা বেজে চলেছে বেশ কিছুক্ষন ধরেই। অন্যমনস্ক থাকার জন্যেই খেয়াল করে
নি। জোর করে সেই আবেশের হাত থেকে মুক্ত করল নিজেকে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত বেগে দুড়
দুড় করে ছুটে নেমে এল সিঁড়ি দিয়ে। কাঁপা পায়ে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। কাঁপা হাতে
দরজা খুলল।
--এ কি মিতিল? তুমি কি এই সন্ধ্যেতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি ভাই? শ্রাবণীর
গলা কলকলিয়ে উঠল ঝরণার মত।
এরা তিনজন এসেছে। একেবারে সামনে পুঁচকে ব্রতীন কেমন ভ্যাবলা ভ্যাবলা
ভাবে তাকিয়ে আছে। পেছনে মিষ্টি হাসিতে মুখ ভরিয়ে কৌতূহলী শ্রাবণী। আর সবার পেছনে শোভন।
অন্ধকারে তার মুখটা ভাল করে দেখা যাচ্ছে না ভাল করে।
গেট খুলে দিল মিতিল। ড্রয়িং রুমে বসাল।
--বসুন শ্রাবণী বৌদি। দাদা আর বৌদি একটু চন্দননগরে গেছে। ওদের একটা
নেমন্তন্ন আছে। শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বলল মিতিল। কিন্তু তাকাতে পারল না
শোভনের দিকে। নিজেকে কেমন যেন অপরাধী মনে হচ্ছে তার। মনে হতে লাগল এই নির্দোষ
মানুষটাকে অশুচি করে দেবে হয়ত তার দৃষ্টি। নিজের মনটা কি সত্যি এত বিষাক্ত হয়ে
গেছে তার যে শোভনদার মত মানুষের সম্পর্কে—কল্পনা হলেও সেটার জন্ম তো তার মনের
মধ্যেই ছিল নাকি?
No comments:
Post a Comment