Friday, January 20, 2017

রম্যরচনা...... গাড়ি কিনলেন পটাইবাবু “””” নারায়ণ রায়।





পটাইবাবুর বাঙ্কে একটিই মাত্র একাউন্ট। সেটা না থাকলেই নয় কারণ ওই একাউন্টেই তার অফিসের বেতনের টাকা জমা হয়, এবং মাসের শেষে তার পাশবুকে নীট ব্যালান্স বড়জোর জমার ঘরে বিশ-পঁচিশ হাজার টাকা। দুনিয়ার আর কোথাও আর কোন বাঙ্কেই তার কোন একাউন্ট নেই। তবুও ভারতের সমস্ত সরকারি এবং বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলি কি করে যে পটাইবাবুর মত অতি সাধারণ ব্যক্তিদের নাম ধাম পেয়ে যায় কে জানে? দিন রাত্রি তারা এই বিশ হাজার টাকার মালিককে ফোন করে করে পাগল করে দেয়। তারা পটাইবাবুকে গাড়ি কেনার জন্য ঋন দিতে প্রস্তুত। বাড়ি করার জন্য ঋন দিতে তৈরী, এমনকি তার বিবাহিত মেয়ের বিয়ের জন্যও ঋন দিতে ব্যস্ত। এই ভারতবর্ষে তারা বোধ হয় কাউকে গরীব থাকতে দেবে না।
সেদিন পটাইবাবু মন দিয়ে অফিসে কাজ করছিলেন এমন সময়ে তার মুঠো ফোনটি বেজে উঠল, “হেললো মে আই টক টু মিস্টার পটাই……” বার বার এই একই প্রশ্ন শুনে শুনে ক্লান্ত পটাইবাবু সেদিন নিতান্ত বিরক্ত হয়েই ও প্রান্তের বক্তাকে তার বক্তব্য শেষ করতে না দিয়েই বলে দিলেন, “ আ হা হা হা ভেরি সরি পটাইবাবু তো জাস্ট গতকাল সন্ধ্যায় মারা গেছেন।
তবু ভবি ভোলবার নয়। ও প্রান্ত থেকে আবার ভেসে এলো। ওহ, ভেরি সরি, ভেরি সরি, স্যার তবু কই বাত নেহি, আপনি কাইন্ডলি ওনার বাড়ির এক্সাক্ট ল্যান্ড মার্কটা একটু দেবেন, আমরা ওনার মিসেসের সঙ্গে একবার দেখা করব, আসলে আমরা একটা নতুন লোন স্কিম লঞ্চ করেছি যেটা শ্রাদ্ধের ক্ষেত্রে খুব কাজে দেবে...এই লোনটা হচ্ছে কোন ব্যক্তি যত বছর বয়সে মারা গেছেন তত হাজার টাকা তক্ষুনি একেবারে স্পট লোন হিসেবে দিয়ে দেয়া হবে। আমাদের লোকেরাই প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্র নিয়ে ওনাকে দিয়ে সই-সাবুদ করিয়ে নেবে। আর ঘাটের দিন গঙ্গার ঘাটে গিয়ে ২০%, শ্রাদ্ধের দিন মৃতব্যক্তির বাড়িতে ৩০% আর নিয়ম ভঙ্গের দিন নির্দ্দিষ্ট অনুষ্ঠান বাড়িতে বাকি ৫০% লোন একেবারে নগদে ওনার স্ত্রীর হাতে দেয়া হবে। প্রয়োজনে আমরা নাপিত, ব্রাহ্মণ এবং ক্যাটারার ইত্যাদির ব্যবস্থাও করে দেব, তার জন্য আলাদা কোন চার্জও দিতে হবে না। আমাদের এই স্কিমের ই এম আই ও খুব সহজ। ওনার মিসেস যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন আস্তে আস্তে শোধ দিতে পারবেন। এমনকি ওনার স্ত্রীর মৃত্যুর পরে আর শোধ না দিলেও চলবে সে ক্ষেত্রে লোনটা আপনা থেকেই পটাইবাবুর স্ত্রীর শ্রাদ্ধের লোন এডভ্যান্স হিসেবে এডজাস্ট করে টাকাটা মরেটরিয়াম লোন করে দেয়া হবে। তাই এই লোনের ক্ষেত্রে পটাইবাবুর স্ত্রী যত তারাতারি মারা যান ততই মঙ্গল।
এই কথা শোনার পর পটাইবাবুর সারা শরীর রাগে রি রি করতে লাগলো এ ব্যাটাদের আমাকে মেরে আমার শ্রাদ্ধ করেও শান্তি নেই আবার আমার জলজ্যান্ত বৌটাকেও পর্যন্ত মেরে ফেলতে চাইছে। তবে এত কথা শোনার পরও পটাইবাবুর মনটা কিঞ্চিত বিগলিত হ, মনে মনে ভাবলেন অন্তত ব্যাঙ্কের নামটা জেনে রাখা ভাল। প্রয়োজনে তার মৃত্যুর পর তার অকর্মন্য ছেলে অন্তত এই ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে তার শ্রাদ্ধটা একটু ধুমধাম করে করতে পারবে। তাই তিনি জিজ্ঞেস করলেন আজ্ঞে আপনার নামটা একটু বলবেন? আর আপনাদের ব্যাঙ্কের নামটা কি যেন বললেন?” ও প্রান্ত থেকে টেলিফোনে জবাব এলো "আজ্ঞে আমার নাম 'ঢোল গবিন্দ গড়গড়ি' আর আমাদের ব্যাঙ্কের নাম R K G P Bank." 
দেখুন আমি ICICI, IDBI, HDFC, বাঙ্কের নাম শুনেছি কিন্তু R K G P Bank? পুরো কথাটা কি বলুন তো?” পটাইবাবু শুধালেন।
আজ্ঞে ঋনং কৃত্বা ঘৃতং পিবেত ব্যাঙ্ক”, ও প্রান্ত থেকে উত্তর ভেসে এল। 
একথা শুনে পটাইবাবু এমন চমকে উঠলেন যে তার হাত থেকে মূঠো ফোনটা ছিটকে পড়ে গেল, তার মাথাটাও কেমন ঝিম ঝিম করতে লাগল। পটাইবাবু চক্ষু বুজে এমন ভাবে ধপাস করে চেয়ার-এ বসে পড়লেন যে তার সহ কর্মীরা সবাই দৌড়ে এসে তার চোখে মুখে জলের ছিটে দিয়ে বাতাস করতে লাগলেন এবং কিছুক্ষন পরে পটাইবাবুর জ্ঞান ফিরে এল।
আর পাঁচটা দিনের মত এদিনও অফিস থেকে ফেরার পথে বাসে পটাইবাবু বসার যায়গা পাননি। সারাদিন অফিস করে ক্লান্ত পটাইবাবু কাধে ব্যাগ নিয়ে দুহাত তুলে রড ধরে যেতে যেতে জানালা দিয়ে দেখেন তার বাসের পাশ দিয়ে হুস হুস করে ঝা চক চকে রঙ বে রঙের গাড়িগুলো ছুটে যাচ্ছে। পটাইবাবু চোখ বুজে ভাবতে থাকেন তাদের ছোটবেলায় শুধু বড়লোকেদের বাড়িতে গাড়ি থাকতো। আর তার সবই এম্বাসাডর এবং মাত্র সামান্য কিছু ছোট ফিয়াট গাড়ি। অল্প কিছু বনেদী বড় লোকেদের বাড়িতে অবশ্য আরও পুরানো দিনের মরিশ কিম্বা অস্টিন গাড়ি দেখা যেত। কিন্তু গাড়িগুলির স্থাপত্যে এত সৌন্দর্য ছিল না। আর দুনিয়ার সকল প্রাইভেট গাড়ির একটাই রঙ ছিল, সেটা হল কালো। পরে অবশ্য কিছু কিছু এম্বাসাডর গাড়ি সাদা রঙের দেখা যেতে লাগলো। কিন্তু এখন গাড়িগুলি স্থাপত্য কত সুন্দর দেখতে। আর কি সুন্দর সব লাল নীল সবুজ হলুদ বিভিন্ন রং-এর বৈচিত্র। হটাৎ একটা ঝাকানিতে পটাইবাবুর তন্দ্রা ভাবটা কেটে যায়। আজ বাসটা যেন বড্ড আস্তে আস্তে যাচ্ছে। পাশ দিয়ে কি সুন্দর সব প্রাইভেট গাড়িগুলি চলে যাচ্ছে। ঝক ঝকে কাঁচের জানালার আড়ালে এই শহরের আমজনতার প্রতি একটা অবজ্ঞার ভাব নিয়ে চলন্ত ঠান্ডা ঘরের আরাম কেদারায় বসে আছেন যেন এক একজন স্বপ্নপুরীর রাজপুত্তুর রাজকন্যেরা।
তখন পটাইবাবুর ব্যাঙ্কের সেই ভদ্রলোকের কথা মনে পড়ে গেল। তিনি মনে মনে হিসেব করতে লাগলেন, তিনি কেটেকুটে হাতে যা পান তার থেকে মাসে চার পাচ হাজার টাকা জমে যায়। আচ্ছা এমনও তো হতে পারে, তার যেহেতু মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, ছেলেও কলেজ পাশ করে গেছে তাই প্রভিডেন্ট ফান্ডের প্রতিমাসের তার প্রদত্ত টাকার পরিমানটা যদি কিছুটা কমিয়ে দেয়া যায়! আর সেই টাকায় মাসে মাসে গাড়ির ই এম আই টা বোধ হয়......। প্রচন্ড গরমে ঘামতে ঘামতে কাধে ব্যাগ, দুই হাত তুলে পটাই বাবু স্বপ্ন দেখতে থাকেন সামনের মাস থেকে তিনি ঐরকম একটি কাঁচের জানালায় আড়ালে এক চলন্ত ঠান্ডা ঘরে বসে অফিস যাচ্ছেন। আর ছুটির দিন গুলতে গিন্নী সুরবালাকে পাশে বসিয়ে আজ ডায়মন্ড হারবার নয় তো কাল টাকি। ইস ভাবতেই তার সারা শরীরে শিহরণ জাগছে। হটাত কন্ডাক্টরের চিৎকারে তার হুশ ফিরলো। 
বাড়ি ফিরে এক কথা দু কথায় গিন্নী সুরবালাকে সে কথা বলতেই সুরবালা তার চার মণ ওজনের দেহটাকে দুলিয়ে চিৎকার করে বললেন, “সে কথা আর আমাকে বলতে হবেনা। আমি কদিন ধরেই লক্ষ করেছি তোমার কথা বার্তা যেন কেমন কেমন! তোমার মতিগতি আমার ভালো ঠেকছে না......নিশ্চই পেটের গ্যাসটা আবার মাথায় চড়েছে, হ্যাগো নিশ্চই বাইরে উলটো পালটা কিছু খেয়েছো। যে লোক বছরে এক বারের যায়গায় দুবার ঈলিশ মাছ কিনতে গেলে সাত বার ভাবে সে কিনবে গাড়ি! সেকথা যদি বলতে হয় তাহলে দেখ পাশের বাড়ির সান্যালবাবুকে। শুধু গাড়ি কেনাই নয়; প্রত্যেক মাসে বউকে নিয়ে আজ দীঘা তো কাল দার্জিলিং ঘুরে আসছে।
একে বলে একেবারে সরাসরি পুরুষ মানুষের আঁতে ঘা। তাই যখন পটাইবাবু কিছুতেই তার ত্রিশ বছরের সহ ধর্মিনীকে বোঝাতে সক্ষম হলেন না যে তিনি সত্যি সত্যি একটি গাড়ি কেনার কথা ভাবছেন, আর ঠিক সেই সময়ে তার স্ত্রী পাশের বাড়ির ঘুষখোর ভদ্রলোকের সঙ্গে তার তুলনা করায় তার পৌরষত্ব দপ করে জ্বলে উঠল।
পরদিন পটাইবাবু অফিসে গিয়ে প্রথমেই ঋণং কৃত্বা বাঙ্কের ঐ নম্বরে ফোন করতেই মিঃ গড়গড়ি এক গাল হেসে বললেন, “গুড মর্নিং স্যার, আমি জানি আপনি আমাকে রিং ব্যাক করবেন স্যার। আমি এক্ষুনি সব কাগজ পত্র দিয়ে আমার লোককে আপনার অফিসে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমার নাম গড়গড়ি, ধরেই নিন গাড়ি আপনি সামনের সপ্তাতেই পেয়ে যাচ্ছেন, আর তারপর নতুন গাড়িতে চেপে গড়গড়িয়ে বেরিয়ে পরুন স্যার।
বাড়ি ফিরেই গাড়ির সকল কাগজ পত্র দেখিয়ে পটাইবাবু তার সহধর্মিনীকে আগের দিনের অপমানের জবাব দিলেন। কি সুন্দর সব রঙ্গীন গাড়ির ছবি! তদোধিক সুন্দর সেইসব গাড়ির সওয়ারিরা। যে সুরবালার সঙ্গে তার জীবনের সকল রোমাঞ্চ বিয়ের মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই শেষ হয়ে গেছে সেই সুরবালা তার বিশাল দেহখানি পটাইবাবুর গায়ে লেপ্টে দিয়ে বড়ই আদরের সুরে বলে ওঠেন, “ হ্যা গো সত্যিই তুমি গাড়ি কিনবে, আমার কেন জানি কিছুতেই বিশ্বাসই হচ্চছে না যে আমি ঐ রকম একটা সুন্দর রঙ্গীন গাড়িতে তোমার পাশে বসে ফুর ফুর করে ঘুরে বেড়াবো ?”
সে যাই হোক সাত দিনের মধ্যে পটাই বাবু একটি নতুন গাড়ির মালিক হলেন। নতুন গাড়ি কিনলে নিজেকে বেশ বড় লোক বড় লোক মনে হয়। একটা রবিবার দেখে পটাইবাবু স্ত্রী সুরবালাকে নিয়ে একটু লং ড্রাইভে বেরবেন ঠিক করলেন। যেমন কথা তেমনি কাজ, পাড়ার ছেলে ভোম্বলের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে যখন যেমন ডাক অড়বে ভোম্বল পটাইবাবুর ড্রাইভারের কাজটি করে দেবে।
সেই অনুযায়ী একটি শুভ দিন দেখে এক রবিবার সাত সকালে কলকাতা থেকে দুজনে নম নম করে বেড়িয়ে পরলেন কলকাতার কাছাকাছি একটা জায়গার উদ্দেশ্যে। গাড়িতে উঠে যেন তার বিশ্বাসই হতে চাইছিল না যে গাড়িটা তার নিজের। নিজেকে যেন অফিসের ডিরেক্টর বলে মনে হতে লাগলো, পটাইবাবুর মনে হল নিজের গাড়িতে বসলে মুখটা একটু গম্ভীর করে রাখতে হয়। পটাইবাবু বাইরে মুখ খানি গম্ভীর করে রাখলেও অন্তরের এক অন্তঃসলিলা আনন্দে ফুর ফুরে হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দিয়ে বহুদিন পরে আজ স্ত্রীর পাশে বসে কোথাও চলেছেন। আজ যেন পটাইবাবু নতুন করে তার স্ত্রীকে আবিষ্কার করলেন। সত্যিই তো পাশে তার স্ত্রী থাকলে যে মনের মধ্যে অমন পুলক জাগে সেটা তো তিনি এতদিন খেয়াল করেননি?
এইভাবে স্ত্রীর কাঁধে হাত রেখে মনের আনন্দে কিছুদুর চলার পর তার ফুর ফুরে মেজাজটা হটাৎ ধাক্কা খেল। একটা জায়গায় এসে দেখলেন একটা বাঁশ আড়া আড়ি করে রাস্তাটা বন্ধ করে দেয়া আছে, কাছা কাছি আসা মাত্র কয়েকজন ছেলে গাড়িটাকে ঘিরে ধরে ড্রাইভারের হাতে একটা চাঁদার বিল ধরিয়ে দিল, ভোম্বলের হাত থেকে সেটি নিজ হাতে নিয়েই পটাইবাবুর তো ভিরমী খাওয়ার মত অবস্থা। "বাবলাতলা শ্রী শ্রী ছিন্নমস্তা মায়ের পূজো উপলক্ষে চাঁদা বাবদ পাঁচ হাজার টাকা ধন্যবাদের সহিত গৃহীত হইল।" পটাইবাবু বাড়ি থেকে মাত্র তিন হাজার টাকা নিয়ে বেরিয়েছেন তার মধ্যে পাঁচ'শ টাকার তেল কিনেছেন হাতে আছে মাত্র আড়াই হাজার টাকা। যাই হোক অনেক তর্কা-তর্কি করে পটাইবাবু যেখানে পাঁচ'শ টাকার উপরে কিছুতেই উঠতে পারবেন না সেখানে বাবলাতলারা নতুন ঝা চক চকে গাড়ি দেখে কিছুতেই চার হাজারের নীচে নামতে পারবে না। যাই হোক অনেক দরা দরি করে দুহাজারে রফা হল, আর পটাইবাবুর হাতে রইল মাত্র পাঁচশ টাকা।
আরও কিছুক্ষন চলার পর পটাইবাবু একটা যায়গায় দেখলেন রাস্তার একধারে লাইন দিয়ে পাট কেচে শুকোতে দেয়া হয়েছে, তারই মধ্যে আবার রাস্তার আর একটি ধার বরাবর ধান শুকোতেও দেয়া হয়েছে। রাস্তার উপর এই ধান ও পাটের সাড়াসী আক্রমণকে মোকাবিলা করার জন্য ড্রাইভার যখন সব কিছুকে বাঁচিয়ে অত্যন্ত সন্তর্পনে গাড়ি চালাবার চেষ্টা করে চলেছে, তখন পটাইবাবু দেখলেন, আর এক বিপত্তি। রাস্তার উপর যত্র তত্র একগাদা হাঁস, মুরগী, ছাগল ও গরু চরে বেড়াচ্ছে।
ঠিক এমন সময়ে গাড়ি জোর ব্রেক করে থেমে যেতেই একটা মুরগী ক্ককর ক্ককর করতে করতে তাদের গাড়ির গা ঘেসে দ্রুত বামদিক থেকে ডান দিকে চলে গেল। ড্রাইভার গাড়ি থেকে নামতেই সঙ্গে পটাইবাবুও নামলেন। তখন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন লোক যার হাতের দড়িতে একটি ছাগল বাঁধা। লোকটি পটাইবাবুকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনারা খুব বাঁচা বেঁচে গেছেন দাদা। পটাইবাবুও বললেন, হ্যা মুরগীটা খুব বাঁচা বেঁচে গেছে। তবুও লোকটি বলল, না না আপনারা খুব বাঁচা বেঁচে গেছেন, অন্তত দু হাজার টাকার ধাক্কা।
ব্যাপারটার অর্থ বোধগম্য না হওয়ায় পটাইবাবু ফের জিজ্ঞেস করলেন, তার মানে ? তখন ঐছাগল হাতে লোকটি তাকে রাস্তা থেকে একটু দূরে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিল। তিনি দেখলেন বেশ কয়েকজন লোক পাঁচটা সাতটা দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন গাছের তলায় বসে বসে তাদের দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে। তিনি আরও জানলেন রাস্তার উপরে যেসব হাঁস মুরগী গরু ছাগল ঘুরে বেরাচ্ছে ঐ লোকগুলিই তাদের মালিক। ইচ্ছা করেই জীবগুলিকে রাস্তার উপর ছেড়ে দিয়েছে এবং কোন গাড়ি এলেই ওরা মনে প্রানে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে তার মনোবাসনা যেন আজ পূর্ন হয়। অর্থাৎ তার হাঁস, মুরগী, ছাগল কিম্বা গরুর একটি অন্তত যেন আজ গাড়ি তলায় চাপা পড়ে।
তাদের এইরকম একটি অদ্ভুত ইচ্ছা কেন একটু পরে সেই ব্যাপারটিও খোলসা হল। এই রাস্তায় কোন মুরগী, হাস, ছাগল বা গরু গাড়ি চাপা পরলে ঐ দূরে বসে থাকা লোকগুলি দৌড়ে এসে গাড়িটিকে ভাংচুর ও যাত্রীদের মারধোর করার ভয় দেখিয়ে তাদের মৃত বা আহত প্রিয় জীবটির জন্য ক্ষতিপুরন দাবি করবে। এবং তাদের দাবি না মানলে তখন মারধোর ও গাড়ি ভাংচুর করতে শুরু করবে অথবা গাড়িটিকে আটকে রেখে যাত্রীদের ছেড়ে দেবে যাতে তারা পরে সময় মত টাকা নিয়ে এসে গাড়িটি ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। আর এই স্বঘোষীত খাপ পঞ্চায়েতের বিচারের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য তাদের বেঁধে দেয়া মূল্য অনুযায়ী প্রতিটি আহত অথবা মৃত মুরগী ২ হাজার, হাঁস ৩ হাজার, ছাগল ২০ হাজার ও গরু ৫০ হাজার টাকা হিসেবে কর দিতে গাড়ির মালিক বাধ্য থাকবে।
এসব কথা শোনার পর পটাইবাবুর মুখটি এবার সত্যি সত্যি বড়োই করুন হয়ে এল। আস্তে আস্তে মাথা নিচু করে গাড়িতে উঠে বসলেন এবং একবার পকেটে হাত বুলিয়ে দেখে নিলেন যে অন্তত পাঁচশো টাকাটি যথাস্থানে আছে। একটু ধাতস্থ হয়ে গাড়িতে উঠে ভোম্বলকে গাড়ি স্টার্ট দিতে বললেন।
ঠিক এক মিনিটও হয়নি গাড়ি স্টার্ট নিয়েছে, অতি সন্তর্পনে চালানো গড়ির গতি তখন কুড়ি কি মি ছাড়ায়নি, এমন সময়ে গাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া সেই ছাগল হাতে লোকটি তার ছাগলটাকে হটাৎ এমন ভাবে ঠেলে দিল যে ভোম্বল সাবধান হওয়র কোন সুযোগই পেল না।
চোক্ষের নিমেষে এলাকার চেহারাটাই পালটে গেল। হৈ হৈ করে চতুর্দিক থেকে সবাই ছুটে আসতে লাগলো। জীবনে এই প্রথম পটাইবাবু এতটুকও ঘাবড়ালেন না। শুধু এইটুকু মনে ছিল যে ছাগল চাপা পড়লে কুড়ি হাজার, আর তার কাছে আছে পাঁচশো টাকা। তিনি কারও সঙ্গে ঝগড়া বা বিবাদে গেলেন না। গাড়িটিকে একজন মুরুব্বি গোছের লোকের হাতে দায়িত্ব দিয়ে শুধু নীরবে গাড়ি থেকে নেমে স্ত্রী এবং ড্রাইভারকে নিয়ে রাস্তার অপর প্রান্তে কলকাতা ফেরার বাসে ওঠার চেষ্টা করতে করতে ভাবতে লাগলেন যে ঋনং কৃত্বা ব্যাঙ্ক গাড়ি কেনার জন্য চার লাখ টাকা লোন দেয় তারা নিশ্চই গাড়িটা ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যও কুড়ি হাজার টাকা লোন দেবে।


No comments:

Post a Comment

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া