Monday, April 24, 2017

গল্প / এলেম / -অরুণ চট্টোপাধ্যায়



--ভগবানই ভরসা, সমরবাবু ভাবছিলেন মনে মনে। অটোর পেছনের সীটে একটা ছেলে আর দুটো পূর্ণবয়স্ক মহিলার মাঝে চিঁড়ে চ্যাপ্টা হয়ে ভাবছিলেন কথাটা। সামনের সীটে ড্রাইভারের বাঁদিকে একটি সুঠাম সুন্দরী আর তার বাঁদিকে এক প্রৌঢ়। তাঁর অর্ধেক প্রায় মাটিতে ঝুলছে। তার ডাইনে মানে ড্রাইভারের ডাইনে আর একজন যুবক।
পাশের ভদ্রমহিলার সঙ্গে প্রায় মাখামাখি সমরবাবুর। বেশি চাপ দিতেও পারছেন না আবার বেশি চাপ নিতেও পারছেন না নিজে। বয়েস এখন আটষট্টি। বয়েস কালের উন্মাদনাটা নাহয় গেছে কিন্তু সংকোচ?
অটোতে এইভাবেই যাচ্ছে সবাই। এটাই হয়ে গেছে একালের দস্তুর। এটা যুগাবতারের ফ্যাসান হয়ত। পরিবহণ সমস্যার তুলিতে আঁকা ফ্যাসান। অটো স্টার্ট দিতে যাচ্ছে সেই অন্তিম লগ্নে আবার একটা মেয়ে এসেছিল, একটা সীট হবে নাকি? ড্রাইভার তাকে এক নজর দেখে বলল, হবে।
 সমরবাবু ভাবছিলেন মেয়েটি বসবে কোথায়? পেছনের সীটে চারজন। বসার কোনও সীনই নেই। সামনের সীটে ড্রাইভারকে নিয়েও চারজন। সব মিলিয়ে আট।
ড্রাইভারের টুসকিতে ম্যাজিক। বাঁদিকের মেয়েটিকে আর একটু চেপে ডানদিকের পুরুষ মানুষটি আর নিজের মধ্যে ইঞ্চি খানেক জায়গা বানিয়ে বলল, বসুন। মেয়েটিকে ইতস্তত করতে দেখে ড্রাইভারের আর একটা টুসকি, তবে পরেরটায় আসুন। আধঘন্টা পরেই ছাড়বে।
ড্রাইভারের দৃষ্টিতে মেয়েটির প্রতি একটা কৌতুক ছাড়াও ছিল একটা উপেক্ষার ভাব। মেয়েটা কী উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছিল না। সমরবাবুর মনে হল সত্যিই হয়ত বেচারির তাড়াতাড়ি যাবার খুব দরকার ছিল নাহলে এমন অসম্ভব দাবি করত না।  
অটো স্টার্ট হল। গিয়ারের হাতল উঠল পড়ল। আর সেটা ওঠার সময় তার ধাক্কা থেকে বাঁচতে বাঁ দিকের মেয়েটি ঝুলন্ত প্রৌঢ়ের ঘাড়ের ওপর পড়ল। রাস্তায় এখানে নাকি একটা গর্ত আছে বড়। ড্রাইভার একবার মেয়েটির দিকে চেয়ে মুচকি হাসল। এর অর্থ, কেমন ঝুঁকিটা অনায়াসে সামলে নিলাম দেখলে? এ রুটে অটো বড় কম আর রিক্সাওলারা সব আগের জন্মে কশাই ছিল বলে সমরবাবুর ধারণা। এরা এমন হাঁকে যে তাঁর মনে হল রিক্সা চালানোর থেকে এরা বোধহয় রিক্সায় বসে মানুষজন দেখতেই বেশি পছন্দ করে।
সামনের আয়নায় সামনে বসা সুঠাম সুন্দরীর মুখটা নজর পড়ল সমরবাবুর। ভারি মিষ্টি মুখখানা মেয়েটির। তার বৌমা মানে ছেলের বৌয়ের মত একেবারে বসান মুখ। কিন্তু সে মুখে আনন্দ নেই এক ফোঁটা। যেন কি একটা ভয় তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে অটোতে ওঠা ইস্তক। মনে পড়ল সেদিন বৌমার কথাটা।
--খুব ভাল হত না বাবা যদি আমাদের একটা গাড়ি থাকত?
সমরবাবু মনে মনে বেশ রেগে গিয়েছিলেন বৌমার ওপর। ছেলে তো একটা প্রাইমারি স্কুলের টিচার। এই গাড়ির স্বপ্ন কী তার বৌকে মানায়? সমরবাবু বেশ শান্তশিষ্ট লোক। রেগে গেলেও বোঝা দায়। মৃদু হেসে বললেন, কেন বৌমা হঠাৎ গাড়ির শখ কেন?
--শখ নয় বাবা প্রয়োজন। রোজ অটোতে আপনার নাতিকে নিয়ে স্কুলে দিয়ে আসতে হয়। সেদিন তো একেবারে
থেমে গিয়েছিল বৌমা। কিন্তু তার চোখেমুখে এমন একটা ভীতির চিহ্ন দেখেছিলেন সমরবাবু। ঠিক যেমন চিহ্ন আজ এই সুঠাম সুন্দরীর চোখেমুখে দেখছেন। সেদিন বৌমার চোখমুখের ভাষা পুরোটা পড়তে পারেন নি। আজ যেন সম্পূর্ণ হল সেই পড়া।
সামনের সুঠাম সুন্দরীর দিকে নজর করতে গিয়ে নজর হঠাৎ ড্রাইভারের দিকে পড়ে গেল সমরবাবুর। তার দুই হাত অটোর হ্যান্ডেলে। বাঁ কাঁধটা একটা মোবাইলকে আটকে রেখেছে তার কানের সঙ্গে। কথা চালিয়ে যাচ্ছে সে দিব্বি। ঠিক যেমনভাবে মোটর সাইকেলের ড্রাইভার কথা বলে মোবাইলে।  
কালের হাওয়া---ভাবলেন সমরবাবু। আজকাল এ ফ্যাসানটা দিব্বি খাচ্ছে সবাই। ট্রেন, বাস, লরি, মোটর, মোটর সাইকেল সবাই এমন কায়দাতে দিব্বি অভ্যস্ত হতে হয়েছে। সমরবাবু ভাবছিলেন, নিশ্চয় এটা সিনেমার কোনও পরিচালক কি চিত্রনাট্যকারের মাথা থেকে বেরিয়েছে। নায়ক কি ভিলেনকে ঘ্যাম স্মার্ট করে বক্স অফিস জিন্দাবাদ করার জন্যে। সেই কায়দা ইনফেকশন হয়ে ছড়িয়েছে চারিদিকে। অফিসের বসও নিশ্চয় বাঁ হাতে ফাইল সামলে ডান হাতে সই করতে করতে বাঁ কাঁধে মোবাইল রেখে এমনিভাবেই কথা বলছেন। এমনকি বাড়ীর গিন্নীও কি তবে তেলের কড়ায় মাছ ভাজতে ভাজতে এমনি ভাবে মোবাইলে গল্প করে নাকি? সেবার হাতের তেলের ছিটেয় ফোস্কাটা কি তবে এই থেকে? কিন্তু সেবার যে বলেছিল কাঁচা তেলে মাছ দিয়ে ফেলায় খুন্তিতে আটকে তেল ছিটকে এই দশা? তার মানে একটা গুল ঝেড়ে দিয়েছে দিব্বি?
অটোর ছেলেটা অনেকক্ষণ থেকে কথা বলে যাচ্ছে। একভাবে তাকে দেখছিলেন সমরবাবু। বাঃ ছেলেটিকে তো বেশ হীরো হীরো লাগছে? আশপাশটা তাকিয়ে দেখলেন সুঠাম সুন্দরীর চোখও সেই দিকে। পলক আর পড়ছে না। আগের সেই ভয়ের চিহ্ন মুছে গিয়ে চোখে বেশ একটা মুগ্ধতা। এক কথায় অটোর টি-আর-পি বেড়ে গেছে। কে জানে এই অটোয় যদি আবার বসে থাকে কোনও চিত্রনাট্যকার কি পরিচালক তো এই ড্রাইভারকে দেখে শুরু হয়ে যেতে পারে এক নতুন ভাবনার। উদ্ভব হতে পারে নতুন এক ফ্যাশানের চিত্রনাট্য
নায়কের ফোনালাপের দিকে একটু মন দিলেন তিনি। দরকারি ফোন নাকি বাড়ির? সমরবাবুর মনে হল সংলাপগুলো কেমন যেন মিষ্টি মিষ্টি। বয়েস আটষট্টি হলেও ফুল আর মধুকরের বাক্যবিনিময়ের ঢং কি আর ভুলে মেরে দিয়েছেন নাকি? নিজের বৌকে এমন কত মিঠা মিঠা বাত বলতেন সে সব কি গুলে মেরে দিয়েছেন নাকি
এবার একটু পাশের দিকে নিজের অপাঙ্গ নজরকে বিস্তৃত করলেন। পেছনের একটি মেয়ের মুখে একটু উদ্বেগএদিক ওদিক থেকে আসা বেয়াড়া গাড়িগুলোকে বিশ্বাস নেই এতটুকু। অথবা তার খুব তাড়া আছে গন্তব্যে পৌছবার। কিন্তু বাকি সবাই নিঃস্পৃহ, নিশ্চিন্ত আর নিরুত্তর। হয়ত তাদের তাড়া নেই অথবা এমন ঘটনাটাই স্বাভাবিক সেটাই ধরে নিয়েছে।  
উল্টোদিক থেকে একটা অটো। হঠাৎ আচমকা। হ্যান্ডেল বোধহয় একটু কাঁপল ড্রাইভারের। ছেলেবেলার জ্যামিতিক জ্ঞান সমরবাবুকে বলে দিল সামান্য কৌণিক বিচ্যুতি দৈর্ঘের কতটা হেরফের ঘটাতে পারে। আর জ্যামিতির সেই নিয়মেই অনেক ডানদিকে চলে এসেছে তাঁদের অটো। ওদিকের অটোর প্রায় মুখোমুখি হবার জোগাড়।   
সবাইয়ের বুক কাঁপছে। চোখ স্থির। দুর্ঘটনা থেকে মাত্র একচুল দূরে ছিল সবাই। কিন্তু ড্রাইভার তার হাতের কৌশলে কাটিয়ে নিয়ে চলে এল বাঁ দিকে। ভগবানকে ধন্যবাদ দিল সবাই। ড্রাইভার বাদে। সে বোধহয় নিজেকেই ধন্যবাদ দিচ্ছিল মনে মনে। তারিফ করছিল নিজের হাতের কৌশলের। তার শেষ রাত্রের ওস্তাদের মারদেখাবার জন্যে এতগুলো সওয়ারি পেয়ে গেছে এই আনন্দে একেবারে ডগমগ।
মোবাইলটা কিন্তু তখনও তেমনভাবেই কাঁধে ধরা আছে ড্রাইভারের। সেই অদ্ভুত নায়কোচিত কায়দায়। যেমনভাবে নায়কের ঠোঁটের কোণে ধরা থাকে জ্বলন্ত সিগারেট। খলনায়ককে বেধড়ক পেটানোর পরেও। নায়ক যেমন এরপর পলায়মান খলনায়কের দিকে উপেক্ষার দৃষ্টিতে তাকিয়ে সিগারেটে একটা টান দিয়ে ধোঁয়ার রিং তৈরি করে তেমন সেই ড্রাইভারও পলায়মান দুর্ঘটনার সম্ভাবনাকে উপেক্ষার নজরে তাকিয়ে একের পর এক সাজিয়ে যাচ্ছে তার মিষ্টি কথার মালা। হয় তার মিষ্টি বৌ বা মিষ্টি প্রেমিকার সঙ্গে।   
--আরে না না তুমিই এস আজ। ভাবছি ট্রিপ বন্ধ করে ইভিনিং শোতে যাব দুজনে?—দিদি? আরে ধুস। ও তো একেবারে বুড়ি হয়ে গেছে। বলে খুব হেসে উঠল ছেলেটি, কথায় বলে না আধা ঘরওয়ালি? আরে না না জোক করছি। আমি তিনটে টিকিটই কাটছি। তা তুমি
শালি! মনে মনে দাঁত কামড়ে ধরেছেন সমরবাবু। আর সময় পেলি না জামাইবাবুর সঙ্গে প্রেম করার? নাকি দিদি এখন ঘরে আর জাম্বু বাইরে তাই রসটা ভাল পাকবে বলে ধরে নিয়েছে?
আর একটা ফাঁড়া পার করে দিল ছেলেটি। একটা ভীতু ট্রাক তার অটোর তুড়ুক গতিতে ঘাবড়ে কোনদিকে যাবে ভেবে পাচ্ছিল না। কিন্তু ছেলেটির হাতে ম্যাজিক আছে না? ম্যাজিসিয়ানরা কেউ মরে না মারে? তাই ট্রাকের চাকা এক ইঞ্চি দূর দিয়ে যেতে বাধ্য। এক ইঞ্চি কী কম নাকি? এক ইঞ্চি একটা পেরেক ফুটুক দেখি কারোর পায়ে? প্রতি ইঞ্চিতে বুঝিয়ে দেবে যন্ত্রণাটা।
সবাই মুগ্ধ। একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ। সমরবাবু যেন তুড়ুক নাচ নাচতে পারলে বর্তে যান, তোমার এলেম আছে ভায়া। কি হাতের কাজ। বাম হাতের একটা আঙ্গুল তুলে সঙ্গে সঙ্গে নাড়ল ড্রাইভার। বুঝিয়ে দিল এটা তার বাঁ হাতের খেল।
কয়েক গজ মাত্র এগিয়েছে অটোটা সামনের দিকে হুস হুস করেহঠাৎ পেছনে একটা বিশাল শব্দ। বিশাল চীৎকার আর কান্নাকাটি। উল্টোদিকের অটোটা ঠিক সামলাতে পারে নি। একটা লরির সঙ্গে মুখদর্শন। সমরবাবুদের অটো তখন বেরিয়ে গেছে বিপদ সীমা ছেড়ে। এলেমদার ড্রাইভার বলল, দিন দুপুরে অত বোতল টানলে হয়? অটো চালানো কি হাতের মোয়া নাকি?
সেই সুঠাম সুন্দরীর মুখে পর্যন্ত যেন একটা গর্বের হাসি। কিন্তু পেছনের সেই অল্পবয়সী  মেয়েটির চোখে একটা বেয়াড়া প্রশ্ন ঝুলছে মনে হল সমরবাবুর।   
মাঝে মধ্যে অটোতে চাপতে হয় অবশ্য সমরবাবুকে। দিন সাতেক পরে আবার একবার অটোতে উঠতে হল। এ অঞ্চলে অটো বিশেষ নেই। ভাবলেন তাঁর সেই এলেমদার ড্রাইভারটিকেই হয়ত পাবেন। কিন্তু এদিক ওদিক খোঁজ করেও পেলেন না। অগত্যা চালককেই প্রশ্নটা করলেন।
-ও আপনি ভোদাইয়ের কথা বলছেন? সে তো এখন হাসপাতালে।
দিন তিনেক আগে রাত বারোটায় বাড়ি ফেরার সময় একটা লরির সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কা। খুব হাতের কৌশল দেখাতে ইচ্ছে করছিল তখন তার চোলাইয়ে গলা ভেজানো মনটা। কিন্তু বাঁ হাতের খেল, ডান হাতের খেল কোনও কিছুই তাকে বাঁচাতে পারে নি। এখন হাসপাতালের বেডে ডাক্তারদের হাতের খেলে যদি বেঁচে ফেরে তবে রক্ষে।
--সিভিয়ার অ্যাক্সিডেন্ট দাদা, এই ড্রাইভার বলল, ইনজুরি যা হয়েছে তাতে বাঁচাটা একটা লাখ টাকার প্রশ্ন।  
রাস্তার ধারে কৌতূহলী চোখ চলে গেল সবার। একটা ভাঙ্গাচোরা অটো কাত হয়ে পড়ে আছে। দুমড়ে মুচড়ে একেবারে যা তা। ড্রাইভার বেঁচে ফিরলেও এটার তো পোষ্ট মর্টেম হবেই। দুর্ঘটনার কারণ জানতে হবে তো?

সঙ্গে সঙ্গে সব সওয়ারি চমকে উঠে বলে ফেলল, আহারে! ছেলেটা কিন্তু বেশ ভালই চালাতো। সমরবাবু শুধু চুপ করে ছিলেন। কিছু হয়ত ভাবছিলেন। 

No comments:

Post a Comment

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া