২৫শে বৈশাখ থেকে ২২শে শ্রাবণ। দূরত্ব কতটা? ক্যালেন্ডারের হিসেবে
যাই হোক,
পথটা কিন্তু মাত্র কয়েকটা মাসের নয়। মাত্র একটি বছরের মধ্যে
এক বিশাল
প্রতিভাকে সীমাবদ্ধ করে রাখা যায় নি। লেগেছে প্রায় সুদীর্ঘ
আশিটা বছর। প্রায়
একটি শতাব্দী।
“আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে—
তুমি জান না, আমি তোমারে পেয়েছি অজানা সাধনে।।
সে সাধনায় মিশিয়া যায় বকুলগন্ধ,
সে সাধনায় মিলিয়া যায় কবির ছন্দ—
তুমি জান না, ঢেকে রেখেছি তোমার নাম
রঙ্গীন ছায়ার আচ্ছাদনে।।“
বাইশে শ্রাবণের এক মন খারাপ করা ‘ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে’ একমনে
কবির কথা
ভাবুন। ভুলে যাবেন ২২শে শ্রাবণের কথা। মনে এসে যাবে ২৫শে বৈশাখের
সেই ‘ক্ষণ’
মুহূর্ত। নিদাঘ দিনের ঘাম ঝরাণ খটখটে মহাপ্লাবণের এক দিনের
কথা। সেই দিনটাও
ছিল এক ‘‘ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিন’। তবে সেদিন আকাশ থেকে ঝরে
পড়েছিল
প্রতিভার এক ‘স্নিগ্ধবারি’। সুদীর্ঘ আশি বছর ধরে সে ঝরেছে আর
আমাদের হৃদয় আর
মনকে করেছে স্নিগ্ধ। করেছে সিঞ্চিত।
প্রতিভার শুরু আছে শেষ নেই। কেননা শেষ হলেও যে তার রেশ থেকে
যায় জন্ম থেকে
জন্মান্তরে। ১৯৪১ সালটা গড়াতে গড়াতে ২০৪১ সালের দিকে চলল। আর
চলবে আর
চলবেই। তার গড়িয়ে যাওয়ার পথে খুঁজে পাওয়া যাবে না কোথাও কিন্তু
বাইশে শ্রাবণের
অস্তিত্ব। দেখা যাবে সর্বত্রই শুধু ২৫শে বৈশাখ গান করে চলেছে।
জীবনের গান,
হৃদয়ের গান, মানুষের গান, প্রকৃতির গান---এই মহাবিশ্বের গান।
“ আকাশভরা সূর্য- তারা, বিশ্বভরা প্রাণ,
তাহারই মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান ।“
প্রকৃতিই হল জীবজগতে মহা উৎস। আর তাই কবি গেয়েছেন সারা বিশ্বকে।
বন্দনা
করেছেন এই সীমাহীন ব্রহ্মান্ডের। এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের কাছে
তিনি কৃতজ্ঞ আর
তাই অবাক হয়ে ভেবেছেন বিশাল এই বিশ্বের মাঝে একটি মানুষের কতই
না ক্ষুদ্র এক
অবস্থান। কিন্তু যত ক্ষুদ্রই হোক বিশ্ব কিন্তু ফেলে দেয় নি
এই ক্ষুদ্র
ব্যক্তিসত্বাকে। স্বীকার করেছে তার অস্তিত্বকে আর পালন আর পোষণ
করেই
চলেছে।
বিশ্বের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে হবে আমাদের। করে নিতে হবে একাত্ম।
তাই কবি লিখলেনঃ
“আজ সবার রঙে রঙ মিশাতে হবে।
ওগো আমার প্রিয়, তোমার রঙিন উত্তরীয়
পরো পরো পরো তবে।।“
কবি ছিলেন সাংঘাতিক প্রকৃতিপ্রেমী। ছটি ঋতুর সুন্দর সুন্দর
বর্ণনা তাঁর অসংখ্য
গানের মধ্যে দিয়ে পাওয়া যায়। তিনি এমন সুন্দর বিজ্ঞান সম্মত
ভাবে রূপগুলিকে
ব্যাখ্যা করেছেন গানের মাধ্যমে যে তা সত্যিই অতুলনীয়।
বৈশাখের তাপঝরা পৃথিবী যখন তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছে প্রবলভাবে তখন
কবি লিখলেনঃ
“চক্ষে আমার তৃষ্ণা ওগো, তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে।
আমি বৃষ্টিবিহীন বৈশাখী দিন, সন্তাপে প্রাণ যায় যে পুড়ে।।“
বৈশাখের খর তাপ যখন অসহ্য হয়ে ওঠে তখন বর্ষা সেই তপ্ত পৃথিবীতে
ঈশ্বরের
একটা আশীর্বাদ স্বরূপ। কবি তাই বর্ষাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন
এই ভাষায়ঃ
“এসো শ্যামল সুন্দর
আনো তব তাপহারা তৃষাহারা সঙ্গসুধা।
বিরহিনী চাহিয়া আছে আকাশে।।
সে যে ব্যথিত হৃদয় আছে বিছায়ে
তমালকুঞ্জপথে সজল ছায়াতে,
নয়নে জাগিছে করুণ রাগিনী।।“
বরষা তাপদগ্ধ ধরার বুকে একটা ভরসাও বটে। কবির মুগ্ধ কলম লিখল
আত্মহারা
কালিতেঃ
“এসেছে বরষা, এসেছে নবীন বরষা,
গগন ভরিয়া এসেছে ভুবনভরসা।
দুলিছে পবনে সনসন বনবীথিকা,
গীতময় তরুলতিকা।“
কিংবা আবার কখনও বলছেনঃ
“তৃষ্ণার শান্তি, সুন্দরকান্তি,
তুমি এলে নিখিলের সন্তাপভঞ্জন।।“
বর্ষা যেমন আশ্বাস তেমনি তার আধিক্য মানুষের জীবনযাত্রাকে সাময়িকভাবে
স্তব্ধও করে দেয়। এই বাস্তববোধ কবিরও আছে। তাই তিনি গাইলেনঃ
“ঝরঝর বরিষে বারিধারা
হায় পথবাসী, হায় গতিহীন, হায় গৃহহারা।।“
বর্ষা যেমন সুন্দর, বর্ষা যেমন মনোহর, যেমন সে প্রয়োজনীয়, তেমনি
সে উপহার দেয়
এক একটি অলস কর্মহীন দিনকেও। অন্যদিনের সব কর্মচাঞ্চল্ল ঢেকে
যায়
বর্ষণমুখর একটি দিনের নিরবচ্ছিন্ন বারিপাতে।
“আষাঢ়সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, গেল রে দিন বয়ে।
বাঁধনহারা বৃষ্টিধারা ঝরছে রয়ে রয়ে।।
একলা বসে ঘরের কোণে কী ভাবি যে আপন-মনে,
সজল হাওয়া যূথীর বনে কী কথা যায় কয়ে।“
বজ্রপাত বর্ষার শুধু অনুষঙ্গই নয় তার একটি অলংকারও বটে। মেঘে
মেঘে যখন ঘটে
শব্দের অনুরণন, আলোর স্ফুলিঙ্গ যখন খেলা করতে থাকে তখন বর্ষার
রূপ
প্রলয়ংকর বলে মনে হয়। তবু তার মধ্যেও কবির হৃদয় যেন মাদলের
শব্দের তালে তালে
দুলতে থাকে। প্রকৃতির এই নৃত্যসঙ্গীতানুষ্ঠান কবির কাছে বেশ
উপভোগ্য হয়ে ওঠেঃ
“বাদল-মেঘে মাদল বাজে গুরুগুরু গগন-মাঝে।।
তারি গভীর রোলে আমার হৃদয় দোলে,
আপন সুরে আপনি ভোলে।।“
বর্ষার আকাশ। বাদল মেঘে ভরা কালিঢালা কালো এক আকাশ। মাঝে মাঝে
দামিনীর
স্ফুলিঙ্গ। চোখের সামনে মণিমানিক্য যেমন ঝলমল করে ওঠে তেমনই
মনে হয়েছে
কবির। আত্মহারা কবি লিখলেনঃ
“বজ্রমাণিক দিয়ে গাঁথা, আষাঢ় তোমার মালা।
তোমার শ্যামল শোভার বুকে বিদ্যুতেরই জ্বালা।।“
আষাঢ়ের বর্ষা ভীষণ দামাল, ঝড়-ঝঞ্ঝ্বা, বজ্রপাত আর এলোমেলো হাওয়ায়
ভরা।তুলনায় শ্রাবণের বর্ষা শান্ত তবে বর্ষণের আধিক্যে ভরা। তখন ঝড়-ঝঞ্ঝ্বা নেই,নেই
বিশেষ দামাল হাওয়াও। বজ্রপাতকমে এসেছে। আকাশের সেই কালিমাওঅনুপস্থিত। পরিবর্তে রয়েছে
নিরবচ্ছিন্ন ধারাপাত। মন হারানো, মন উদাস করা এক একটা বর্ষণসম্পৃক্ত দিন।
“আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে
জানি নে, জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না।“
বর্ষার রূপে কবি কতটা মোহিত তা বোঝা যায় কবির এই লাইন কটি থেকেঃ
“হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মত নাচে রে।
শত বরণের ভাব-উচ্ছ্বাস কলাপের মত করেছে বিকাশ,
আকুল পরান আকাশে চাহিয়া উল্লাসে কারে যাচে রে।।“
আনন্দের আর সীমা পরিসীমা নেই কবির। কবির কলম তাই গেয়েই চললঃ
“মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো,
দোলে মন দোলে অকারণ হরষে।
হৃদয়গগনে সজল ঘন নবীন মেঘে
রবীন্দ্র-কাব্যে বর্ষা
রসের ধারা বরষে।।“
বর্ষার একঘেয়েমিতে কবিও খানিক বিরক্ত। তাই মেঘে কেটে গিয়ে তার
ভেতর থেকে
যখন উঁকি পাড়তে থাকে অসহায় সূর্যরশ্মি তখন চপল শিশুর সারল্য
আর বালকের
চাঞ্চল্ল ফুটে ওঠে কবির কলমে। কবি লেখেনঃ
“মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি। আহা, হাহা, হা।
আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি। আহা, হাহা, হা।
কী করি আজ ভেবে না পাই, পথ হারিয়ে কোন বনে যাই,
কোন মাঠে যে ছুটে বেড়াই সকল ছেলে জুটি। আহা হাহা হা।
কেয়া-পাতার নৌকো গড়ে সাজিয়ে দেব ফুলে—
তালদিঘিতে ভাসিয়ে দেব, চলবে দুলে দুলে।
রাখাল ছেলের সঙ্গে ধেনু চরাব আজ বাজিয়ে বেণু,
মাখব গায়ে ফুলের রেণু চাঁপার বনে লুটি। আহা হা-হা হা।।“
এক সময়ে ধারাপাতের পর্ব কমে কমে ক্রমে শেষ হতে থাকে। বর্ষার
রূপে মুগ্ধ কবির
কলমও তোলে বিষাদের সুরঃ
“বাদল-ধারা হল সারা, বাজে বিদায়-সুর।
গানের পালা শেষ করে দে রে, যাবি অনেক দূর।
ছাড়ল খেয়া ও পার হতে ভাদ্রদিনের ভরা স্রোতে রে,
দুলছে তরী নদীর পথে তরংগবন্ধুর।।“
মাটিতে এবার কাশফুলে। বাতাসে শিউলির গন্ধ। বর্ষাশেষের আকাশেও
তাই সাদা পেঁজাতুলোর মত ভাসমান মেঘ। যার পরতে পরেতে শরতের সোনালী রোদের উঁকি ঝুঁকি।
শান্ত
বাতাসে উড়ে চলা সেই মেঘ-বলাকার দিকে চেয়ে উদাস কবি লিখলেনঃ
“মন মোর মেঘের সঙ্গী,
উড়ে চলে দিগ দিগন্তের পানে
নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণবর্ষণসঙ্গীতে
রিমঝিম রিমঝিম রিমঝিম।।“
আমাদেরও মন উড়ে চলুক আজ নীলিমার বুকে ভেসে চলা মেঘ-বলাকার পিঠে
চড়ে বিশাল
রবীন্দ্রকাব্যের মহাকাশে। জানি আমাদের সামান্য শ্রদ্ধা কবির
আকশচুম্বী প্রতিভার
পাদস্পর্শ করতে পারবে কিনা তবু শ্রদ্ধা থাকুক নিরন্তর।
No comments:
Post a Comment