ছোট্ট রিনি বুঝতে
পারেনা , কেন অন্য বন্ধুর বাবাদের মতো, তার বাপি তার সাথে সবসময় থাকেনা। বন্ধুরা
ওদের বাবাদের সাথে কতো মজা করে, বেড়াতে যায়। ওদের বাবারা কতো কি খাওয়ার জিনিস,
খেলনা কিনে দেয়।
আর তার বাপি কতোদিন
পরপর আসে। অবশ্য যখন থাকে , তখন রিনি একটুও বাপিকে ছাড়েনা। বাপিও ওর সাথে কতো মজা
করে, আদর করে, খাইয়ে দেয়, গল্প বলে ঘুম পাড়ায়। তারপর কিছুদিন থেকেই আবার চলে
যায়। রিনির খুব কান্না পায়। বাড়িতে তখন শুধু ঠাম্মা, মা আর রিনি।
রিনি মনখারাপ করলে মা
বলে , তার বাপি নাকি দেশকে রক্ষা করে, দেশের সব মানুষের নিরাপত্তার ভার নিয়েছে।
ওতো কঠিন কথা বোঝেনা রিনি। ও শুধু ভাবে কেন তার বাপিকেই এসব করতে হবে? ধুর তার
বাপি যদি আর সবার বাবার মতো বাড়িতে থাকতো কতো ভালো হতো। ওর বাপি ওর কাছে থাকেনা
বলেই তো ওর বন্ধুরা কতো সময় বেশি বেশি করে ওদের বাবার গল্প করে। ওর তেমন কিছুই
বলার থাকেনা। ছোট্ট রিনি তখন সবার কাছ থেকে পালিয়ে এসে ঠাম্মার কোলে মুখ লুকিয়ে
কাঁদে।
সেদিন সারা গ্রামের
মানুষ তাদের বাড়িতে হাজির হলো। সবাই বলছে তার বাপি নাকি মস্ত বড়ো কাজ করেছে। তার
বাপি নাকি দেশের জন্যে "শহীদ" হয়েছে।
এই শহীদ হলে কি হয় রিনি
জানেনা কিন্তু এটা বুঝতে পারে , শহীদ হওয়া মানে খুব ভালো কিছু করা। সবাই
বলে বাপি আজ বাড়ি আসছে। রিনির খুব আনন্দ হয়। শুধু ঠাম্মা যে কেন কেঁদে যাচ্ছে।
তাহলে বোধহয় ঠাম্মা আনন্দে কাঁদছে। আর মা কেমন চুপ করে বসে আছে। মার বুঝি রিনির
মতো আনন্দ হচ্ছে না ? ওঃ বাপি এতোদিন আসেনি বলে মা রাগ করেছে। রিনি মাকে বলে, বাপি
এলে খুব বকে দেবে।
একটা বড়ো গাড়ি এসে
দাঁড়ায় বাড়ির সামনে। অনেক গুলো লোক মিলে একটা ভারতের পতাকা দিয়ে
সাজানো, বাক্স নিয়ে আসছে।
ভারতের পতাকা রিনি
চেনে। তার বাপী চিনিয়েছে তাকে। বাপী বলে ওই পতাকাই নাকি বাপির ভগবান।
সবার মধ্যে ও বাপিকে
খোঁজে। বলে "আমার বাপি কোথায়" ? রিনির মামা এসে রিনিকে জড়িয়ে ধরে।
বাক্সটার ঢাকনা খুলতেই
রিনি দেখে বাপি বাক্সের মধ্যে কেমন চুপ করে শুয়ে আছে। মামা বলে বাপি ঘুমাচ্ছে।
তাহলে ঠাম্মি বাপিকে জড়িয়ে কাঁদছে কেন ? রিনি তার ছোট্ট দুটো হাত দিয়ে
বাপিকে ঝাঁকাতে থাকে আর বলে "ও বাপি, তুমি চোখ খোলো, ওঠো। আমার সাথে খেলবে
চলো "। বাপি ওঠেনা। ঠাম্মি আরও জোড়ে কেঁদে ওঠে। এবার রিনিও ভয় পেয়ে কেঁদে
ওঠে। মা এসে রিনিকে কোলে নিয়ে বলে "তোমার বাপি আর কোনদিন কথা বলবে না। কিন্তু
সবাই তোমার বাপির কথা বলবে। তোমার বাপি শহীদ হয়েছেন।" "শহীদ হলে বুঝি
এমন হয় ? তাহলে শহীদ হওয়া খুব খারাপ" রিনি বলতে বলতে খুব জোড়ে কাঁদে। মা
কঠিন গলায় বলে "তুমি শহীদের মেয়ে, তুমি একদম কাঁদবে না। তুমি শুধু গর্ব
করবে। দেখছো না আমি কাঁদছি না।" তার নরম সরম মাকে, কেমন অচেনা লাগে রিনির।
সবাই বাপিকে নিয়ে চলে
যায়। রিনিকে শক্ত করে চেপে ধরে মা বলে ওঠে "বন্দেমাতরম"। রিনি দেখে তার
বাপিকে সবাই প্রনাম করছে। দলে দলে লোক সাথে যাচ্ছে "বন্দেমাতরম",
"শহীদ অমর রহে" বলতে বলতে। রিনির বাপি আর রিনির নয়। সে এখন অনেক অনেক বড়ো
মানুষ, সে এখন "শহীদ"।
বাপির জন্য রিনির খুব
গর্ব হয়। দু হাতে চোখ মুছে ,
ছোট্ট রিনিও এবার তার
কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ওঠে "বন্দেমাতরম"। "শহীদ অমর রহে।"
No comments:
Post a Comment