ব্যানার্জী বাড়ির হরিমন্দির থেকে ঘন্টাধ্বনি শোনা যাচ্ছে, রাস্তা দিয়ে রাধু বোষ্টমী খঞ্জনী বাজিয়ে হরিনাম সংকীর্তন করতে করতে পেরিয়ে গেল, প্রতিদিন ঠিক ভোর সাড়ে চারটেয় এই শব্দে মৃণ্ময়ীদেবীর ঘুম ভাঙে।
কাল সারারাত বিছানায় শুয়ে শুধু এপাশ ওপাশ করেছেন, কিছুতেই দুটো চোখের পাতা এক করতে পারেননি।
আজকাল ঘুম কতটুকুই বা হয়,কিন্তু কাল নন্দিতার মুখে খবরটা শোনা ইস্তক মনটা বড় বিমর্ষ হয়ে আছে, একটা অজানা আশঙ্কায় মনের দোলাচল কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না।
অনেক অনেকক্ষণ চুপ করে শুয়ে থেকে বিছানার ওপর উঠে বসলেন মৃন্ময়ী দেবী। একটা সিদ্ধান্ত তো নিতেই হবে, এইভাবে অবিশ্বাস নিয়ে চলা যায়না।
---
প্রায় পনেরো বছর হতে চললো স্বামী অমলেন্দু ইহজগতের মায়া কাটিয়ে পরলোকগমন করেছেন।
তখন ইন্দ্রর বয়েস আর কত --আঠারো,উনিশ হবে, সবে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। কোনো আগাম আভাস না দিয়ে সুস্থ মানুষটা হঠাৎ রাত্রে বুকে ব্যথা, তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো।
মাত্র সাতদিন,মানুষটাকে যখন একটু সুস্থ মনে হচ্ছিলো, তখনই আবার একটা মেজর অ্যাটাক, আর বাঁচানো গেলোনা, মানুষটা কোনো কিছু না বলেই মৃণ্ময়ীকে বড্ড একা করে চলে গেলো।
অবশ্য স্বামীর অফিসে একটা চাকরি তিনি পেয়েছিলেন, তাই অভাবের মুখোমুখি হতে হয়নি কোনোদিন।
তখন, ইন্দ্র আর মৃন্ময়ী দুজন দুজনকে আঁকড়ে বেঁচেছেন।
ছেলেই হয়ে উঠেছিলো মৃন্ময়ীর ধ্যান জ্ঞান।
আজ ছেলে সুপ্রতিষ্ঠিত, বৌমাটিও বড্ড ভালো।
সবকিছুই ঠিক আছে, কিন্তু নন্দিতার বলা ঘটনাগুলো মনকে ভীষণ নাড়া দিয়ে গেছে।
প্রথম ঘটনাটি ওর এক বন্ধুর নিজের দিদির সাথে ঘটেছে।
স্বামী মারা যাওয়ার পর ছেলের সংসারেই থাকতেন ওই ভদ্রমহিলা, শিক্ষিত ছেলে মাকে বিদেশে তার কর্মস্থলে নিয়ে যাওয়ার নাম করে, সব সম্পত্তি বিক্রি করে মাকে এয়ারপোর্টে একা নিঃসম্বল অবস্থায় ফেলে রেখে নিজে বিদেশ পাড়ি দিয়েছে।
ভদ্রমহিলা প্রথমে কিছু বুঝতেই পারেননি, তারপর কেমন যেন বোবা হয়ে যান, এবং কিছুদিন পর একরাতে বুকে প্রচন্ড ব্যথা ও শ্বাস কষ্ট হয় এবং তিনি মারা যান, আত্মীয়রা ছেলেকে খবর দিলেও সে আসেনি!
আর একটি ঘটনা, ছেলে মাকে গুরুদেবকে প্রণাম করাতে যাওয়ার নাম করে মাকে নিয়ে বেরোয়, নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে, একটা ফাঁকা রাস্তায় মাকে মিষ্টি কিনতে পাঠিয়ে নিজে গাড়ি নিয়ে চলে যায়, মা অপেক্ষায় থাকতে থাকতে একসময় বোধহয় নার্ভাস ব্রেকডাউন থেকেই জ্ঞান হারায়, একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ভদ্রমহিলাকে আশ্রয় দেয়, কিন্তু তিনি আর ছেলের সাথে যোগাযোগ করতে চাননি। এই ঘটনা টা অবশ্য নন্দিতা টিভি তে দেখেছে।
.......
রাত এগারোটা বাজে, বৌমা মোবাইল নিয়ে খুটখাট করছে, আর টিভিটাও চলছে। ছেলের ঘরে উঁকি দিয়ে মৃন্ময়ী দেবী দেখলেন, ইন্দ্র একমনে ল্যাপটপে কাজ করছে, পাশে নাতিসাহেব অঘোরে ঘুমুচ্ছে।
পা টিপে ঢুকলেন ওঘরে। নাতির মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ছেলের মাথায় আলতো করে বিলি কেটে দিলেন।
ইন্দ্র একবার মুখ তুলে তাকালো, 'কিছু বলবে মা?' তারপর কি মনে হওয়াতে ল্যাপটপ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো, 'দাও তো মা, একটু হাত বুলিয়ে, কতদিন ঘুম পাড়িয়ে দাওনি', মৃন্ময়ী দেবীর চোখে জল এসে গেল।
এই ছেলে তার সাথে কখনো অমন অমানবিক আচরণ করবেনা, কিন্তু ওই বৃদ্ধারাও তো নিজের ছেলেকে এভাবেই বিশ্বাস করতেন, কোনোদিন কি ওঁরাও ভেবেছিলেন যে নিজের ছেলে সর্বস্বান্ত করে এভাবে রাস্তায় ফেলে চলে যাবে? ছেলের অবহেলা যে কিছুতেই তিনি সহ্য করতে পারবেন না।
ছেলের সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে মৃণ্ময়য়ীদেবীর মনের মেঘ কেটে যাচ্ছিলো, তবু নিজের সিদ্ধান্তে তিনি অবিচল রইলেন।
নিজের ঘরে ফিরে,ঘরের দরজা বন্ধ করে খুব সামান্য জিনিস, কটা জামাকাপড়, টুকিটাকি কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় একটা ছোটো ব্যাগে ভরে রাখলেন, ভোর হলে সবাই উঠে পড়ার আগেই বেরিয়ে পড়তে হবে। সব তো ঠিক করাই আছে, রিকশায়ালাকেও বলা আছে, তারপর তো বাসস্ট্যান্ড পৌঁছলেই অনেক বাস পেয়ে যাবেন।
আর রাধু বোষ্টমির গানই তো তার এতদিনের এলার্ম ক্লক হয়ে গেছে।
.......
মৃণ্ময়ীদেবী নিজে চাকরি করেছেন, স্বামীর টাকাও তার নামেই আছে, ছেলে ভালো চাকরি করে, চাকরি পাওয়ার পর থেকে,তার টাকায় ছেলে কখনো হাত দেয়নি, তবু তিনি নাতির নামে বেশ কিছু টাকা আলাদা রেখে দিয়েছেন।
এই কদিনে নিজের একাউন্ট এর টাকা থেকেই যাবতীয় ফর্মালিটিস কমপ্লিট করেছেন।
তাকে বারবার বেরোতে দেখে বৌমা তুলি জানতে চেয়েছে, "এই রোদে কোথায় যাচ্ছো বলো তো? শরীর খারাপ হবে যে, যা কাজ তোমার ছেলেকে বললেই তো পারো।"
উত্তরে তিনি কখনো বলেছেন, ''মন্দিরে যাচ্ছি", "কখনো "ব্যাংকে একটু কাজ আছে রে" আবার কখনো বলেছেন, "এই একটু নন্দিতার সাথে দেখা করে আসি!"
আসলে তিনি উকিলের কাছে গেছেন, নিউজপেপার দেখে বৃদ্ধাশ্রম খুঁজে বের করে সেগুলো দেখে এসেছেন।
এই বৃদ্ধাশ্রমটি ভারী পছন্দ হয়েছে, আধুনিক সব ব্যবস্থা আছে, কিন্তু প্রচুর গাছপালা দিয়ে ঘেরা জায়গাটি ভারী মনোরম, ব্যবস্থাপনাও বেশ ভালো শুনেছে। তাছাড়া এখানে দুজন আবাসিক ডাক্তার ছাড়াও এদের নিজেদেরও চব্বিশ ঘন্টার ডাক্তার আছে।
কিছু টাকা এককালীন দিতে হবে, তারপর প্রতি মাসে কিছু করে, মৃণ্ময়ীদেবী আপাততঃ এককালীন টাকাটা দিয়ে দোতলায় নিজের জন্য একটা ঘর বুক করে রেখেছেন।
প্রতি মাসে যে টাকাটা দিতে হবে তিনি হিসেব করে দেখেছেন, ওটা পেনশন থেকেই দিতে পারবেন।
এখানে অনেকরকম ঘর আছে, সিঙ্গল রুম, ডাবল শেয়ারিং, ডরমিটরি ইত্যাদি।
স্বাভাবিকভাবেই সিঙ্গল রুমের জন্য বেশি টাকা লাগে, কিন্তু বেশি লাগলেও মৃণ্ময়ীদেবীর রুম শেয়ারিং এ থাকা পছন্দ হলোনা, সকাল বিকেল অন্যদের সাথে সময় কাটালেও নিজের ঘরে একজন অপরিচিত মানুষের সাথে এই বয়েসে এসে থাকতে আর মন সায় দিলোনা।
সব ব্যবস্থা করে এখানে আসার প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করে রাখলেও মনের মধ্যের খচখচানি টা কিছুতেই যাচ্ছে না।ইন্দ্র, তার একমাত্র সন্তান ব্যাপারটা কিভাবে নেবে!
......
কাল সারারাত ঘুম আসেনি, আজ রাধু বোষ্টমির সংকীর্তন শোনার আগেই বিছানা ছাড়লেন। ঘড়িতে চারটে বাজে। বাথরুম গিয়ে স্নান করে ফ্রেশ হয়ে নিলেন। বৌমা তুলি সাড়ে পাঁচটায় উঠে পড়ে, ছেলের স্কুল, ইন্দ্রর অফিস থাকে তাই ওকে উঠতেই হয়, তার আগেই বেরিয়ে যেতে হবে।
ঠিক পাঁচটার সময় নিজের ছোট্ট ব্যাগ টা হাতে নিয়ে তিনি দরজা খুলে বেরোলেন।
ইন্দ্রর ঘরের দিকে তাকালেন, দরজা ভেজানো আছে, একটা দীর্ঘশ্বাস অজান্তেই বেরিয়ে এলো। ঠাকুরঘরে গিয়ে প্রণাম করলেন, তারপর বেরিয়ে এলেন।
বাইরের ছোটো গেটটা খুলতে গিয়ে তালা দেখে মনে পড়লো, চাবিটা বারান্দাতেই ঝোলানো থাকে, ওটা আনা হয়নি, চাবি নেওয়ার জন্য পিছন ফিরতেই তিনি দেখলেন, ইন্দ্র, তুলি, এমনকি ছোট্ট তাতানও সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে, সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
মৃণ্ময়ীদেবী একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন, ইশ আর একটু আগে বেরোনো উচিত ছিলো!
"চাবিটা আমার কাছে মা, আর তুমি যত আগেই বেরোতে, আমরা ঠিক এইভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতাম"
মৃণ্ময়ীদেবী বুঝতে পারছিলেন না, ইন্দ্র ঠিক কি বলতে চাইছে...
ঠিক সেইসময় তাতান দৌড়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বললো,"ঠাম্মা, তুমি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে? আমার যে কান্না পাবে"
তুলিও ছুটে এসে ওর হাত থেকে ব্যাগটা নামিয়ে রেখে বললো, "এতদিনেও আমাকে মেয়ে ভাবতে পারলেনা মা?"
ইন্দ্র দুচোখে জল নিয়ে অভিমান করে দাঁড়িয়ে আছে।
আস্তে আস্তে বললো, "জানো মা, সেই ছোটবেলায় তুমি একদিন বড়মার সাথে সিনেমা দেখতে গেছিলে, আমি জানতাম তুমি সন্ধ্যে ছটার মধ্যে ফিরবে, কিন্তু তোমরা বোধহয় কারুর একটা বাড়ি গেছিলে, ফিরতে দেরি হচ্ছিলো, আমি তখন খুব ছোটোও নয়, সেভেন কি এইটে পড়ি, আমার মনে হচ্ছিলো, আমার পৃথিবীটা শুন্য, কষ্টে আমার বুকটা কেমন হচ্ছিলো, মনে হচ্ছিলো, আমি মরেই যাবো।"
মৃণ্ময়ীদেবী উঠে এসে ছেলের মাথাটা টেনে নিলেন।
ইন্দ্র মাকে জড়িয়ে ধরে সেই সেদিনের মতোই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।বহুবছর আগের সেই দিনটা মৃণ্ময়ীদেবীর চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
মৃণ্ময়ীদেবীকে রোজ বেরোতে দেখে তুলিই নাকি ইন্দ্রকে সব বলেছিলো, ইন্দ্র মায়ের প্রাণের বন্ধু নন্দিতা মাসিকে একটু জেরা করতেই মাসি সব গড়গড় করে বলে দেয়। আর তারপর মা যেখানে গেছে, ইন্দ্র প্রতিদিন পিছু নিয়েছে, এমনকি বৃদ্ধাশ্রম "গোধূলির শেষে" তেও।
সেদিন মা চলে আসার পর ম্যানেজারের সাথে কথা বলে, সব প্রমান দেখিয়ে টাকাও ফিরিয়ে নেয়।
তুলি বললো, "মা জানোতো, সেদিন ও যখন ফিরে এলো, ওকে একজন হেরে যাওয়া মানুষ মনে হচ্ছিলো, খালি বলছিলো,'মা আমাকে এই ভাবে? মা কি করে ভাবলো?"
মৃণ্ময়ীদেবী দুচোখ ভরা জল নিয়ে, তার ভালোবাসার মানুষগুলোকে দেখতে দেখতে ভাবলেন,আমিও কি কষ্ট কম পেতাম!
আস্তে আস্তে পূবাকাশে আলো দেখা দিচ্ছে, রাতের আঁধার সরিয়ে নতুন দিনের শুরু হলো, পাখিদের কিচিরমিচির এ বাতাস মুখরিত হতে থাকলো।
মৃণ্ময়ীদেবী নিজের ছেলের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন, 'তোর মতো ছেলে যেন সব মা বাবা পায়!
No comments:
Post a Comment