‘আমায় তুমি করবে দাতা
আপনি
ভিক্ষু হবে,
বিশ্বভুবন মাতল যে তাই
হাসির
কলরবে।
তুমি রইবে না
ওই রথে,
নামবে
ধুলাপথে,
যুগযুগান্ত আমার সাথে
চলবে
হেঁটে হেঁটে’... কোনটি শ্রেয়? দাতা? না
কি দান? ভাবিয়ে তোলেন রবীন্দ্রনাথ।
স্বার্থহীন দান দুর্লভ হয়ে আসা এই পৃথিবীতে, মূল্যবোধ বদলে যাওয়া পারিপার্শ্বিক
সবকিছুর মধ্যে দাঁড়িয়ে এখনও কি মনের তন্ত্রীতে কোনো অনুরণন তোলেনা এই কথা...
‘তোমায় কেন দিইনি আমার সকল শূন্য করে?’ -অবশ্য যা দেওয়া যায়, তাইই ফিরে আসে সোনার
কণা হয়ে-- পঙক্তিতে এই বিশ্বাস জাগিয়ে তোলেন কবি। আসলে তিনি যে শুধুই মনের কথা মন
ভুলিয়ে আর ছন্দ মিলিয়ে লেখা কবি নন, তিনি ঈশ্বরের বার্তা ছড়িয়ে দেন কবিতায় গানে।
তিনি বলেন ‘অসীম ধন’এ ধনী হয়েও যিনি ‘চিরভিখারি’- সেই মহিমাময়ের কথা। বলে ওঠেন ঠিক
কখন দানের চেয়েও শ্রেয় হয়ে ওঠে দাতার স্পর্শ,... ‘কেন রে তোর দু হাত পাতা—/ দান তো না চাই, চাই যে দাতা,...’। কবি মনে করিয়ে দেন যে অজস্র দান পেয়েও আমরা হেলায়
হারাই, কারণ সহজ সাদা দৃষ্টিতে সে দান চোখে পড়েনা।
সতর্ক করে দিচ্ছেন তিনি,
‘সহজ হবি সহজ হবি ওরে মন, সহজ হবি—
আপন বচন -রচন হতে বাহির হয়ে আয় রে কবি।’ কবি যেন উর্ণনাভের
মত জড়িয়ে না পড়েন আপন জালে, তাই কি এই সতর্কতাবাণী? মনে করিয়ে দেওয়া অহর্নিশ, যা
পেয়েছ, সে তোমার নিজের নয়। অন্য কারো দান। যে হাতে তিনি দিয়েছেন, হয়তো অন্য হাতে
অন্য কোনো মুহূর্তে কেড়ে নেবেন তিনি। তাই কবি যেন জড়িয়ে না পড়েন নিজের পঙক্তির
মায়াজালে।
ঐশ্বরিক দান ছাড়াও মানুষ
মানুষের সঙ্গে জুড়ে থাকতে পারে আত্মিক আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে। যখনই এই আদান-প্রদান
বন্ধ হয়ে যায়, সেই জায়গায় মানুষ বড় একা। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আদায়ের সংকট তিনি
প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং বুঝতে পেরেছিলেন যে পারস্পরিক আদান-প্রদান বন্ধ হয়ে
ভারতবর্ষ এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত একা এবং এই সংকটকে তার স্বরাজের থেকেও বেশি গুরুতর
বলে মনে হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা
সকলের থেকে দূরে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিদ্যার নির্জন কারাবাসে রুদ্ধ হয়ে থাকতে চাই। কারারক্ষী
যা দয়া করে খেতে দেবে তাই নিয়ে টিঁকে থাকবার মতলব করেছি। এই বিচ্ছিন্নতার থেকে ভারতবর্ষকে
মুক্তিদান করা সহজ ব্যাপার নয়। সেবা করবার ও সেবা আদায় করবার, দান করবার ও দান গ্রহণ
করবার সম্বন্ধকে আমাদের তৈরি করে তুলতে হবে। বিশ্বের জ্ঞানজগৎ থেকে ভারতবর্ষ একঘরে
হয়ে আছে, তাকে শিক্ষার ছিটে-ফোঁটা দিয়ে চিরকেলে পাঠশালার পোড়ো করে রাখা হয়েছে। আমরা
পৃথিবীর জ্ঞানধারার সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিগত অবমাননা থেকে মুক্তি
পেতে চাই।’ এই সংকট থেকে ভারতবর্ষ এখনও মুক্ত
হতে পারেনি। স্বরাজ এলেও সেই ‘একঘরে’ অবস্থা থেকে ভারতবর্ষ কতখানি বেরিয়ে আসতে
পেরেছে? এই না পারার অন্যতম কারণ হল আত্মিক আদান- প্রদানে সদিচ্ছার বিশেষ
অভাব।
ঐশ্বরিক এবং আত্মিক
দানের প্রসঙ্গ ছাড়াও, সবরকম দেওয়ানেওয়ার ব্যাপারে দেখতে পাই তার এক বিশেষ মত। তিনি
সমাজবেত্তাও বটে। বলেন, ‘বাইরে যেখানে দাবি সত্য হয়,
অন্তরে সেখানেই দানের শক্তি উদ্বোধিত হয়ে ওঠে। দানের সামগ্রী আমাদের থাকলেও আমরা দিতে
পারি নে, সমাজে যতক্ষণ প্রত্যাশা না সজীব হয়ে ওঠে।’ জাগতিক দান এবং
সমাজের মঙ্গলসাধন- এইসব ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের
নিজস্ব কিছু মত ছিল এবং আশ্চর্যজনকভাবে দেখতে পাই পাশ্চাত্যসমাজের মত দল বেঁধে
চাঁদা তুলে দান করবার বিপদের ব্যাপারে তিনি সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তার মনে হয়েছিল
যে এতে মঙ্গল কিংবা হিতচিন্তার চেয়ে শ্লাঘা প্রদর্শন বেশি গুরুত্ব পাবে। তিনি
বলেছিলেন, ‘চারি দিকেই দল বাঁধিয়া উঠিতেছে, কিছুই নিভৃত এবং কেহই গোপন থাকিতেছে
না। নিজের কীর্তির মধ্যেই নিজেকে কৃতার্থ করা, নিজের মঙ্গলচেষ্টার মধ্যেই নিজেকে পুরস্কৃত
করা, এখন আর টেকে না। শুভকর্ম এখন আর সহজ এবং আত্মবিস্মৃত নহে, এখন তাহা সর্বদাই উত্তেজনার
অপেক্ষা রাখে। যে-সকল ভালো কাজ ধ্বনিত হইয়া উঠে না আমাদের কাছে তাহার মূল্য প্রতিদিন
কমিয়া আসিতেছে…’— অর্থাৎ তিনি সেই যুগসন্ধিক্ষণের সাক্ষী ছিলেন যেখানে মানুষ ভুলতে
বসেছিল এই আপ্তবাক্য যে, কারো ডানহাত দান করলে সে খবর বামহাত অবধি পৌঁছাবেনা। মানুষ
শুধুই নিজের আত্মিক উন্নতির জন্য এবং অপরের মঙ্গলের জন্য দান করেনা, এ জিনিস তিনি পাশ্চাত্যে
দেখেছিলেন, এবং সেই হাওয়া তখন প্রাচ্যেও এসে লেগেছিল এবং সেই হতাশা তিনি গোপন করতে
পারেননি। যদিও অন্তর্নিহিত বিশ্বাস ছিল যে একদিন ভারতবর্ষ মঙ্গলচিন্তার পথে, হিতচিন্তার
মূল পথে ফিরে আসবে।
দান বড়, নাকি দাতা, এই বিতর্কে
প্রবেশ না করেও একটা কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে ভারতবর্ষ তথা বিশ্বকে রবীন্দ্রনাথ
যে সম্পদ দান করে গিয়েছেন, তার মূল্য নির্ধারণ করা এককথায় অসম্ভব। তারই কথায় বলতে পারি…
-- ‘তবু কি ছিল না তব সুখদুঃখ যত,
আশা নৈরাশ্যের দ্বন্দ্ব আমাদেরি মতো,
হে অমর কবি! ছিল না কি অনুক্ষণ
রাজসভা-ষড়্চক্র, আঘাত গোপন?
কখনো কি সহ নাই অপমানভার,
অনাদর, অবিশ্বাস, অন্যায় বিচার …
… জীবনমন্থনবিষ নিজে করি পান
অমৃত যা উঠেছিল করে গেছ দান।’
No comments:
Post a Comment