ঝুলন টাকে সত্যিই হিংসে
হয় ,না ঝুলন সুন্দরী বলে নয় , পড়াশোনা -নাচ -গান সবেতেই আমাকে হারিয়ে দেয় বলেও নয়
! এমনিতে আমি আর ঝুলন হরিহর আত্মা ! হিংসে টা হয় ওদের বাড়ি টা দেখে -সবাই মিলে কী
সুন্দর হৈ হৈ করে একসাথে থাকে ! আর আমি মা -বাবার একমাত্র সন্তান যেন খাঁ খাঁ
মরুভূমির বাসিন্দা ! আর রাখী দি -ঝুলনের জ্যাঠতুতো দিদি ,তার তো তুলনাই হয়
না ! ঝুলনের সব বিপদের পরিত্রাতা হয়ে দাঁড়ায় ! সুন্দরী ঝুলন অজস্র বার প্রেমে পড়ে |আর তার স্থায়িত্ব ঐ কখনও সপ্তাহ খানেক , কখনও বা মাস খানেক -এর বেশী হয় না !
কেমন করে যেন প্রত্যেকবার ই সে খবর সৌরভ দার কানে পৌঁছে যায়|ব্যস আর যায় কোথায় !
সৌরভ দা ঝুলনের জ্যাঠতুতো দাদা ,ওকে আমরা সব্বাই ভয় পাই ! এতো ব্রিলিয়ান্ট
স্টুডেন্ট তার ওপর আবার ভীষণ রাসভারী ! তা ঝুলনের ঐ ক্ষণস্থায়ী প্রেমের খবর সৌরভ
দার কানে পৌঁছলেই একেবারে ধুন্ধুমার কান্ড ঘটার উপক্রম হয় |কিন্তু রাখী
দি প্রত্যেকবারই পরিত্রাতার ভূমিকা নেয় !
ঝুলন কে হিংসের প্রধান কারণ বোধহয় এটাই -ঝুলনের রাখী দি আছে !
রাখী দি আমাদের সব্বার বড় প্রিয় | মা বলে দেখেছিস রাখী টাকে? কোন ছোট্টবেলা
থেকে কেমন মা -কাকিমার হাতে হাতে সব কাজ করছে --আর তোদের ধিঙ্গীপনা এখনও গেলনা !
জ্যেঠিমা অবশ্য মাঝে মাঝে দুঃখ করেন -এমন ভালো মেয়েটা আমার ,কেউ বুঝলো না শুধু
রূপটাই বুঝি সব ! জ্যেঠিমার আক্ষেপের কারণ --দু -দুটো পাত্রপক্ষ রিজেক্ট করে গেলো
রাখী দিকে --দেখতে তো তেমন ভালো নয় --তার ওপর লেখাপড়া ও তথৈবচ ! ---আমি অবশ্য
বুঝেই পাইনা --রাখী দি কোথায় অসুন্দর !
সৌরভ দা অবশ্য এতে খুব বিরক্ত
হয়েছে ! জ্যেঠিমাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে --মা আমার বোনটা কি ফেলনা নাকি !
এভাবে ওকে বার বার ঐ পাত্রপক্ষের সামনে বসিও না তো ! সৌরভ দার মুখের ওপর কিছু বলেনি
বটে জ্যেঠু -জ্যেঠিমা ,যা রাগী ছেলে ! মনে মনে ভেবেছে কন্যাদায় বড় দায় ,এতো
গুমর দেখালে চলে !
সৌরভ দা যা রাগী ,আমরা ভয়ে তটস্থ |যাদবপুর থেকে
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে এখন একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানী তে কাজ নিয়ে সুদূর
ব্যাঙ্গালোরে এই যা রক্ষে ! কিন্তু সৈকত দা --সৌরভ দার প্রিয় বন্ধু টি এক্কেবারেই
আলাদা --যেমন হাসিখুশী তেমনই হৈ -হুল্লোড়ে ! দুই ব্রিলিয়ান্টের বাস দুটি বিপরীত
মেরুতে ,তবু বন্ধুত্ব একেবারে গলায় গলায় ! সেই কোন ছোট্টবেলা থেকেই
সৈকত দার এ বাড়িতে অবাধ আনাগোনা ! মা -মরা ছেলেটাকে এ বাড়ির
জ্যেঠিমা-কাকিমারা অত্যন্ত স্নেহ করেন |জ্যেঠিমা তো সৌরভ আর সৈকত কে কোনদিন আলাদা
চোখে দেখেন ই নি !
তা সেদিন এ বাড়িতে সবার বেশ মন
খারাপ --রাখী দি তৃতীয় বারের জন্য রিজেক্ট হয়েছে ! আমি আর ঝুলন ভীত মুখে বসে আছি |স্কুলের হাতের কাজে দশ রকমের স্টিচের রুমাল করতে বলা হয়েছে |এ ব্যাপারে আমি আর
ঝুলন এক্কেবারে অষ্টরম্ভা ,রাখী দি ই ভরসা |এ অবস্থায় কি করে বলি ওকে !
সৈকত দা হৈ হৈ করে ঘরে
ঢুকলো তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গী তে ----কেস কি --সবাই এমন জলদগম্ভীর মুখে কেন ?
ঝুলনের বেণী ধরে টেনে দিয়ে বললো কি ব্যাপার শ্রীমতি সংহিতা --স্বাগতা ম্যাডাম কোথায়
? এই এক স্বভাব সৈকত দার --কক্ষনো কাউকে ডাকনামে ডাকবে না ! আমার দিকে ফিরে
বললো আর এই যে সঞ্চারী --বলি ব্যাপার কি --এমন বিমর্ষ কেন ! এরপর তো চেঁচিয়ে
চেঁচিয়ে যেন কাউকে শুনিয়ে বললো ,"বলি এক কাপ চা কি আজ জুটবে না এ বাড়িতে !" রাখী দি কাজের কথা শুনলে আর স্থির থাকতে পারেনা --সঙ্গে সঙ্গে ছুটলো চায়ের
জল চাপাতে ! সৈকত দা দুগালে হাত দিয়ে বিজ্ঞের মতো বললো ,"বুঝে গেছি --আবার সেই
বিউটি কনটেস্ট ছিলো আজ !"
এভাবেই চললো কদিন
--জ্যেঠু -জ্যেঠিমার মন ভার ! রাখী দির অবশ্য কোন হেলদোল নেই ! ঘরের কাজ ,
সেলাইফোঁড়াই নিয়ে বেশ আছে ! জ্যেঠিমা জ্যেঠু কে বললো্এ"ভাবে হাল ছেড়ে দিলে তো
চলবে না |আবার পাত্র দেখতে হবে --মেয়েটাকে তো আর আইবুড়ো রেখে মরতে পারি না
! "
সুতরাং আবার পাত্রী দেখাবার তোড়জোড় চলছে সেদিন |এবার অবশ্য জ্যেঠু বেশ
আঁটঘাট বেঁধেই নেমেছে --পাত্র জ্যেঠু র কোন কলিগের মামাতো শালার ছেলে ! জ্যেঠু
স্পষ্ট বলে দিয়েছে --দেখো বাপু মেয়ে আমার তেমন সুন্দরী নয় -গায়ের রঙ ও বেশ চাপা
--আর ঐ টেনেটুনে বি .এ .টা পাশ করেছে ! তবে একথা বলতে পারি --মেয়ের আমার মন টা
এক্কেবারে খাঁটি সোনা ! আর ঘরকন্নার কাজ বল , সেলাইফোঁড়াই বল এসবে ওর জুড়ি মেলা
ভার ! এতে যদি তোমার শালা রাজী থাকেন তবেই মেয়েকে দেখাবো নচেৎ নয় ! তা এরা মানুষ
ভালো --সব জেনেশুনেই আজ আসছেন ! মা বললো ---রাখী কে হলদে রঙের শাড়ি পরিও দিদি --ঐ
রঙে সব্বাই কে উজ্জ্বল লাগে ! সেইমতো রাখী দি আজ হলুদ রঙের শাড়ি তে কী সুন্দর
লাগছে রাখী দি কে ! আমার চোখে তো রাখী দি আজ সাক্ষাৎ সরস্বতী ! জ্যেঠু -কাকু ভীষণ
ব্যস্ত আজ |সৌরভ দা দূরে থাকে বলে সৈকত দা র ওপর ভীষণ নির্ভর করে জ্যেঠু |ভাগ্যে
সৈকতটা এখানকার কলেজে ই চাকরী টা নিলো ! সৈকত দাও তদারকি তে ব্যস্ত আজ ! অবশেষে
এলেন তাঁরা ,দেখে পছন্দ করে এক্কেবারে আশীর্বাদের দিনক্ষণ ঠিক করে জানাবেন বলেও
গেলেন ! সবই ভালো ,শুধু আমি আর ঝুলন পাত্রের নাদুসনুদুস চেহারা নিয়ে খানিক
হাসাহাসি করলাম |ঝুলনের নাকি ওনাকে দেখেই গণেশ ঠাকুরের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল !
জ্যেঠু -জ্যেঠিমা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেন ! মন্দ তো নয় ,সরকারী চাকুরে পাত্র ,বেশ অভিজাত পরিবার !
ইদানিং একটা
ব্যাপার লক্ষ্য করছিলাম,ঝুলন আর নতুন করে প্রেমে পড়ছে না |পড়াশোনায় গভীর মনোযোগ
! ওমা সেদিন ও বাড়িতে আড্ডা দিচ্ছি ,হঠাত্ দেখি ঝুলন আর সৈকত দা চোখের ইশারায় কথা
চালাচালি করছে ! কি ব্যাপার --শেষে কি না সৈকত দা র সঙ্গে ! সৈকত দা কমপক্ষে দশ
বছরের বড় হবে আমাদের থেকে ! ইস্ -গেলো রে এবার না সৌরভ দা -সৈকত দা র বন্ধুত্ব টাই
ভেঙে যায় ! কি বেহায়া মেয়ে রে বাবা ! সুয়োগ বুঝে পাকড়াও করলাম ঝুলন কে ,"তোর তলে তলে এই !এবার সৈকত দা কে পাকড়েছিস !তোর লজ্জো করে না !" ও বাবা ,সে তো
উত্তরই দিলো না !উল্টে চোখ মটকে কিসের ইঙ্গিত দিলো কে জানে ! মহা বদ মেয়ে !
বিপদে পড়লে বাঁচাবে কে ?এবার তো রাখী দির ও বিয়ে হয়ে যাবে !
নাঃ বিয়েটা হলোনা রাখী
দির ,এ সম্বন্ধ টাও ভেঙে গেলো |জ্যেঠু কে তাঁর কলিগ নাকি জানিয়ে দিয়েছেন ,তাঁর
শালারা নাকি এ বিয়েতে আগ্রহী নয় |কে নাকি চিঠি দিয়ে জানিয়েছে মেয়ের কোন গোপন
রোগ আছে ! কি কান্ড -কে এমন ভাঙচি দিলো কে জানে ! রাখীর সঙ্গে কারই বা
শত্রুতা !
আবার কিছুদিনের মন
খারাপের পর্ব ! এবার আমার বাবা একটি সম্বন্ধ আনলো |ছেলে ভালো ,রেলে চাকরী করে ,তবে বয়স টা একটু বেশী | তা হোক -জ্যেঠু -জ্যেঠিমা রাজী হয়ে গেলো l সুতরাং আবার
সেই আয়োজন |এনারও পাত্রী পছন্দই জানিয়ে গেলেন l
কিন্তু কি অদ্ভুত
ব্যাপার ,সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি| কে নাকি চিঠি দিয়ে জানিয়েছে মেয়ের কোন গোপন
রোগের খবর ! এবারে জ্যেঠুরা সত্যিই হতোদ্যম হয়ে পড়লেন ! জ্যেঠিমার মন খারাপ ,শরীর খারাপ ,সৌরভ দা কে তলব করা হলো !
সৌরভ দা এসেই রাগারাগি
শুরু করলো |তোমরা রাখী টাকে আবার বাজারের আলু পটলের মতো দেখাতে শুরু করলে ! বিয়ে
না হলে ও কি জলে পড়বে ! জ্যেঠিমার শরীর নিয়েও উদ্বিগ্ন হলো সৌরভ দা ,বি পি টা বেশ
বেড়ে গেছে ! এবার যেন সৌরভ দা ও কেমন মুষড়ে পড়েছে মনে হল |সেটা জ্যেঠিমার
শরীরের কারণে না বোনের পাত্রপক্ষের কাছে বার বার প্রত্যাখাত হবার কারণে বোঝা গেলনা
! সেদিন বিকেলের দিকে সৌরভ দা গেলো সৈকত দার বাড়ি l
সৈকত দা নাকি নিজের স্টাডি তে তখন |কাশী দা,ওদের বাড়ির বহু
পুরোনো কাজের লোক জানালো -সোজা দাদাবাবুর এস্টাডি তে চলে যাও ! সৈকত দা তখন
একমনে কি যেন একটা লিখছে ,সৌরভ দার আগমন টেরই পাইনি ! হঠাত্ ই সৌরভ দা কে দেখে চমকে
উঠলো চট্ করে কি যেন একটা লুকিয়ে ফেললো বই খাতার তলায় ! "কি রে ভূত দেখলি নাকি
! আমি এসেছি জানতিস না ? " জানবো না কেন ?এই এক্ষুনি তো তোদের বাড়িই যেতাম !
আয় আয় বোস ,কাশী দা কে চা দিতে বলি ?
"বল ,কিন্তু কি যেন লুকিয়ে ফেললি
মনে হল!কি রে প্রেম পত্র টত্র নাকি ? ফেঁসেছিস কোথাও ?"
"ধূর কি যে বলিস!লুকাবো আবার কি?"
"উঁহু বাবা আমার চোখ কে ফাঁকি দিবি !"এক ঝটকায় খাতাটা
টেনে ফেললো সৌরভ দা|
এটা কি!চিঠিই তো মনে হচ্ছে !
"রাখ রাখ ,ভালো হবে না বলছি
সৌরভ !"
আর এ এতো প্রেম পত্রই!চমকে উঠলো সৌরভ দা ,অবিশ্বাস্য !!তুই রাখী
কে !!!
মাথা নিচু করলো সৈকত দা |"হ্যাঁ আমি রাখী কে -সেই কবে থেকে -তোকে বলতে
পারিনি তুই আমাকে ওর যোগ্য ভাবিস কি না ! তবে ঝুলন টা বুদ্ধিমতী |ধরে ফেলেছে আমায়
-আর সেই থেকে আমাকে ব্ল্যাকমেল করে রোজ ফুচকা -আলুকাবলী সাঁটাচ্ছে ! ঐ
ভাঙচি চিঠিগুলোর জন্য খুব অপরাধ বোধ হচ্ছে রে |তাই ক্ষমা চেয়ে রাখী কে একটা
চিঠি দেবো ভাবছিলাম ! "
সৌরভ দা কি করবে ভেবে পেলোনা খানিকক্ষণ |ঘোর টা কাটলে ছলছল
চোখে জড়িয়ে ধরলো সৈকত দা কে !
এ বাড়িতে এখন
খুশীর বন্যা ! আগামী ফাল্গুনেই শুভ কাজ সম্পন্ন হবে ! সৈকত দার বাবা বলেছেন," যাক্ এই লক্ষ্মীমন্ত মেয়ের পাল্লায় পড়ে আমার বাউন্ডুলে টা যদি একটু মানুষ হয়
! "
আমি আর ঝুলন খুব রাখী
দিকে খুব জ্বালাতন করছি্রাখী দি লজ্জায় মরে যাচ্ছে ! এই ঘটনা টা বোধহয় ও
স্বপ্নেও ভাবেনি !
জ্যেঠু আর জ্যেঠিমাকে
বলতে শুনলাম ,"এতো সৌভাগ্যও লেখা ছিলো -মেয়েটার কপালে !"
No comments:
Post a Comment