Monday, January 23, 2017

ছোট গল্প.........অর্কিড স্বপ্ন ...... শ্যামশ্রী চাকী



চাঁদের বুড়ি চরকা কেটে ওই তুলোর দানা গুলো যেই কোনে ফেলে, সেখানেই জন্ম পরগাছা সমেত কার্পাস গাছটার। জায়গাটা কেমন
যেন! শুধু স্বপ্নের ছড়াছড়ি। সূর্যির কড়া তাত নেই, ওম নেই, ঝমঝম বৃষ্টিতে কাক ভেজা নেই, শীতে জড়োসড়ো হয়ে পাতা খসানো নেই 
আছে শুধু জ্যোৎস্না আর জ্যোৎস্না।  দূরে একমনে সাদাচুলোবুড়ি গুড়্গুড় গুড়্গুড় করে স্বপ্ন বুনে যাচ্ছে! স্বপ্ন গুলো ছড়িয়ে দিচ্ছে আকাশে
বাতাসেগুঁড়ো গুঁড়ো স্বপ্ন দিগন্ত ছাড়িয়ে হোমোস্ফিয়ার, টপোস্ফিয়ার, ওজন লেয়ার ভেদ করে  ছড়িয়ে যায় ওই দূরের পৃথিবীর মাঠ,
পাথর, কাঁচের দেওয়ালে। হাঁ করে তাকিয়ে থাকে কার্পাস গাছটা।সারা শরীর বেয়ে স্বপ্ন চুইয়ে চুইয়ে পরে। স্বপ্ন রেণু মাখা পাতা গুলো খুব
ভারী, আর ভারী পরগাছাগুলো।ঠিক ভাবে চোখ মেলতে পারেনা গাছটা
শিলতোর্ষায় নৌকা বাওয়ার মত ঝামেলার কাজ কিচ্ছুটি নেই। ব্রিজটা উঠেগেলে খেয়াঘাটটা বন্ধ হয়ে যাবে। হাইরোডের ধারে জংলা
ফুলের দোকান দেবে রতন। আজকাল হেভভি ডিম্যান্ডকলকাতার বাবুরা এত্ত টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে যায়। অর্কিড না কি যেন বলে
বেশিরভাগই বাঁচেনা। হায় রে!! বাপ ঠাকুরদা পানা বনষ্পতির কোলে যে শিশু দোল খায় যে কি কথা কইবে ওই ইঁট পাথরের দেওয়ালে?
দূরে দাঁড়িয়ে টিয়াপাখি নাক বেঁকায় লক্ষ্মী। সাথে রতনের জানে জিগর একরত্তি পটলা। লাল কমলা চুড়ির বাক্সটা হাতে তুলে দেয় লক্ষ্মীর
পটলার জন্য চাবিদেওয়া মটরগাড়ি।  মুহূর্তে রাগ গলে জল বড়ো ভালো মনের মেয়ে লক্ষ্মী রাগ পুষে রাখতে পারেনা আর ভালোবাসাও।
রাতে অঝোরে বৃষ্টিনামে।  বাজের ঝলকানিতে লক্ষ্মীর তৃপ্ত শরীরটা আবার জড়িয়ে ধরে রতনকে।

'
গাড়ি  এই ফেরিতে যাবেনা। আপনারা খেয়ায় বসুন আমরা আলাদা লঞ্চে পার করে দেব।' দেহাতি মানুষগুলোর ঘামের গন্ধে নাকে
রুমাল চাপা দেয় পর্ণা। সাথে বছর দশেকের অর্চিস।আজ বছর পনেরো দেশ ছাড়া পর্ণা কিসের টানে ছুটে এসেছে হারিয়ে যাওয়া সবুজ
দেশে।

স্বামী পুত্র নিয়ে এক নিটোল বিলাসবহুল সংসারে অভ্যস্ত পর্ণা ভুলেই জেগে স্বেদাক্ত নোনা গন্ধ,পাথুতে হাতের স্পর্শ, শীতেফাটা ওষ্ঠের
স্বাদ। হঠাৎ চোখ পড়ে নীল ফতুয়াধারী মাঝির চোখে। কেঁপে ওঠে পর্ণা, বিদেহী বাতাসে টাল মাটাল হলুদ পাতা যেন। সেই কত কাল
আগে শীতভোরে কুয়াশা মাখা জলপথে সহচর।  ভেসে যেত স্বপ্নের তরী নাম নাজানা চরে দুজনেই মাতাল হত মাটির গন্ধে বনফুল সুবাসে
সবুজাভ স্বাদে দৃঢ় আলিঙ্গনে। মিশে যেত পর্ণা পেশিবহুল বাহুডোরে।  আদরে চুলে গুঁজে দিত সেই স্বপ্নের ঘী-রঙা জংলা ফুল
অর্কিড।ওদের ফিরে আসতে হত এক সময়ক্লান্ত শরীরে কিশোর মাঝির নির্মেদ সুঠাম দেহ গ্রীক ভাষ্কর্যের কথা মনে করিয়ে দিত।
তারপর লোক জানাজানি,রুপোলী পরবাসী  আপাত সুখী পর্ণা।

চমক রতনের দু চোখ জুড়ে। সেই একাকী ভোর গহীন জলপথ প্রথম আলিঙ্গন ফিরে আসে এক লহমায়। এক সময় নৌকো থামে অর্চিসকে
কোলে তুলে সযত্নে ঘাটে নামায় সামনে পটলা মুঠোভরা  জংলালতা, অর্কিড কুঁড়ি। পটলা একটা লতা হাতে তুলে দেয় অর্চিসের কিছুদিন
টাটকা থাকবে হয়ত ফুল গুলো কিন্তু কাঁচের দেওয়ালে আস্তে আস্তে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে গাছটার স্বপ্ন দেখা ভুলে যাবে আর স্বপ্ন ছাড়া
গাছ বাঁচেনা
কার্পাস গাছটার আছে শুধু তুলো কিন্তু পরগাছাগুলো ফুলে ফুলে ভরা, গাছটার গুঁড়িবেয়ে অজস্র জংলা লতা,ওদের নাম অর্কিড। ঘী-রঙা
অর্কিড  ফুলের ভেতরটা হলুদ আর খয়েরী। এখানে গাছের পাতা ঝরেনা,ডাল কাঁপে না,সারাবছর ফুল ফল ঝেঁপে আসে। এদেশে
কোনকিছুর বাড়াবাড়ি নেই, কুয়াশা মাখা শীত নেই,নোনা ঘামের গ্রীষ্ম নেই,কড়কড় শব্দে মেঘডাকা নেই,টলটলে শরৎ নেই শুধু বসন্ত
আর বসন্ত। একটু শিশিরের জন্য প্রাণ হাঁকপাক করে গাছটার। রোজ একবার করে চাঁদের আলোয় ছড়িয়ে দেয় পেঁজা তুলো,সেগুলো মেঘ
 হয়ে ভাসতে ভাসতে নীচে নামে। অবাক চোখে তাকিয়ে ক্লান্ত গাছটা একটা ছেঁড়া স্বপ্ন মুড়িদিয়ে বুঁদ হয়ে থাকে।

বলানেই কওয়া নেই একদিন এক ঝোড়ো বাতাসএসে গাছটার শেকড় সুদ্ধ নাড়িয়ে দিল। দাপুটে হাওয়াটা প্রথমে পুরোনো জং ধরা স্বপ্ন
গুলোকে চড়চড় করে ছাল চামড়া সমেত টেনে ছিঁড়ে ছুড়ে ফেললো অন্ধকার কোনে। এক ছুটে সরিয়েদিল জ্যোৎস্নার পর্দা তাজা রোদ
 উঠলো রঙধনু মাখা নীচের আকাশটায় আর শ্যাওলা ধরা আদ্দিকালের স্বপ্ন গুলো কোথায় যে মুখ লুকোলো কে জানে। সুযোগ বুঝে
কার্পাস গাছটা কটা পুরোনো পাতা ঝরিয়ে ফেলল। আর টপাটপ কটা ঘীরঙা অর্কিডফুল ছিঁড়ে উড়িয়ে দিল সেই নীল সবুজ ঘাসবনের
দেশেটার দিকে। ঝোড়ো হাওয়ার কানে কানে ফিসিফিস করে শিখিয়ে দিল ফুলগুলো যেন গাংশালিক আর শিল-তোর্ষার দেশেই যায়।
 চাঁদের বুড়ি কিছু দেখেও দেখল না শুনেও শুনলনা শুধু পরগাছায় হাতবুলিয়ে কটা ঝরাপাতা কুড়িয়ে নিয়ে গুঁজল তার দুধসাদা চুলে,
আবার জ্যোৎস্নার পর্দা টেনে নিয়ে স্বপ্ন বুনতে বসল। এক অদ্ভুত পান্নাসবুজ স্বপ্ন বুনে পাঠিয়ে দিল ফুলের পিছুপিছু। খুব শীত করতে
লাগল  কার্পাস গাছটার। এক অচেনা জ্বর এল স্বপ্নহীন পরগাছা সমেত গাছটার শিরার ধমনীতে
একটা বিচ্ছিরি স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল পর্ণার।  ধ্রুবতারার ঠিক পাশদিয়ে মিল্কিওয়েটা নেমে এসেছে ওদের ছাদে, ঝরঝর শব্দে
স্ফটিকবিন্দু ঝরে পড়ছে    এক পদ্মগন্ধা সুবাসে আচ্ছন্ন মন। বাঁশির শব্দ শুনতে পাচ্ছে পর্ণা। হাজারটা ঘী রঙা অদ্ভুত পারিজাত তার
মাথার ওপড়ে গোল হয়ে চক্কর কাটছে।একসময় আকাশগঙ্গা স্তব্ধ হয়ে যায়থেমে যায় বাঁশি, শান্ত গহীন গাঙে এক একলা নৌকো।
 নৌকোটা মকরমুখী কোন যাত্রী নেই পর্ণা একা! দূরে অস্পষ্ট কে যেন নৌকা বাইছে খুব চেনা কিন্তু ঠাহরানো যাচ্ছেনা। কুয়াশা গ্রাস করে
 নদীকে আর নদী গ্রাস করে নৌকাকে। সুগন্ধি জলে ডোবে পায়েরপাতা, গোড়ালি, হাঁটু আস্তে আস্তে বুকজলএবারে জল নাকের কাছে
বৈঠা ফেলে কাছে আসে, অস্পষ্ট অবয়ব পর্ণাকে তুলে নেয় জলথেকে মুখটা কিছুতেই স্পষ্ট হয়না।একটা খুব চেনা ঘাম ঘাম গন্ধ টের পায়
পর্ণা। ঘামে জবজবে পোশাকটা বদলে চোখেমুখে ভাল করে জল ছেটায় পর্ণা। বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। পূব আকাশে শুকতারা জ্বলজ্বল
করছে, শেষ বর্ষার হিমেল হাওয়ায় ভোরের আলো ফুটব ফুটব। জলভরা শিউলিগাছটার থেকে টুপটাপ ঝরে পরছে কমলাবৃন্তের শুভ্রত্ব।
  গেটের কাছে একটা টুং শব্দ! চমকে তাকিয়ে দেখে সেই অস্পষ্ট আলো আঁধারিয়া মাঝি হাতে সেই ঘীরঙা পারিজাত। একটা ঘোরের
ভেতর দরজা খোলে পর্ণা, গ্রিলটা  খুলে হাতবাড়িয়ে দেয়, একগোছা স্বর্গীয় ফুল দুহাত ভরে। ফুলের বুক জুড়ে এতদিনের কালচে লাল
জমাট রক্তক্ষরণ।  টুপ টুপ করে গলেপড়ে রক্ত, পর্ণার দুহাত বেয়ে। আধফোটা আলোয় মাঝির হাত ধরে শীলতোর্ষার নৌকোয় ওঠে পর্ণা।
 ছলাৎছলাৎ বৈঠা বায় বিনোদ।  নৌকোদূরে মিলিয়েযায়। সূর্যটা আজ অনেক দেরী করে উঠেছে। গাংশালিকের দল অবাক চোখে
তাকিয়ে দেখে মাঝনদীতে একরাশ অর্কিড ফুলের নৌকোয় দুটো মানুষ একে অপরের চোখে  স্বপ্ন মাখিয়ে ঘুমিয়ে আছে


2 comments:

  1. মন ভালো হয়ে গেল । খুব সুন্দর লেখা ।
    - শুভ্রা

    ReplyDelete

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া