এই ত সবে ফেব্রুয়ারি মাস পড়ল। চারিদিকে বেশ
‘ভ্যালেনটাইন’ আবহ। না, রবীন্দ্রনাথের সময়ে ত এমনটি ছিল না। প্রেম নিয়ে এত ভাবনা
তথা বিপণন কোনটাই জীবনযাপনের অন্তর্ভুক্ত ছিলনা। তবুও রবীন্দ্রনাথের গানে বা কবিতায় আমরা দেখতে পাই নিরবচ্ছিন্ন
প্রেমের ভাবনা। না, আমি কিন্তু ঈশ্বরপ্রেমের প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। বহু রবীন্দ্রগানে বা কবিতায়
এই উত্তরণ আছে, যেখানে তিনি প্রিয়কে ‘দেবতা’ অথবা প্রিয়াকে ‘দেবী’র আসনে বসিয়েছেন।
কিন্তু সেসব কিছুর বাইরে যে জাগতিক প্রেম, সেই বিশেষ প্রবাহকে রবীন্দ্র-রচনার
মধ্যে বারে বারে দেখতে পাই। যা সুন্দর, তা প্রেমময়। বারে বারে এই বার্তা আমরা পাই তার
লেখায়, তার গানে।
সুন্দরকে আমরা কিভাবে অনুভব
করি? অবশ্যই জাগতিক জিনিসের মধ্যে। প্রিয়দর্শনে মনে যেমন উৎফুল্ল ভাব আসে, সুন্দর
ফুল, সুন্দর দৃশ্য দেখলেও যে তেমনটিই হয়, একথা হয়ত বা তিনিই ভাবিয়ে তুলেছিলেন
বাঙ্গালী জাতিকে। কোনও সন্দেহ নেই এই ভাবনায় পাশ্চাত্যশিক্ষার বিশেষ প্রভাব আছে, কিন্তু
সংসারের আঙিনার বাইরে নারী-পুরুষের স্বাধীন প্রেমের কথা হয়ত বা তিনিই প্রথম
বলেছিলেন। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে রাধা পূজিতা হলেও ‘কলঙ্কিনী’। কিন্তু তার লেখার
নারীচরিত্রেরা অনেকখানি স্বাধীন। তার
লেখায় প্রেমকে চিরকালীন এক মহিমার আসনে বসিয়েছেন, কখনও লাঞ্ছনা করে নামিয়ে
আনেন নি নর্দমার পাঁকে। কখনও কখনও অবশ্য তার লেখায় প্রেমের প্রকাশ অবাস্তব বলে মনে
হয়, মনে হয় সত্যিই কি জাগতিক জীবনে প্রেমের এতখানি মর্যাদা? ঠিক এই জায়গাতেই কবি
জিতে যান। এই আশাবাদকে জিতিয়ে দিতে চাওয়া এক অদম্য মনোভাবে কবি জীবনের অতি তুচ্ছ,
সাধারণ জিনিসের মধ্য দিয়েও প্রেমকে চিরনশ্বর করে তোলেন। না, প্রেমের পাত্রপাত্রী নয়, প্রেম নিজেই
হয়ে ওঠে আনন্দস্বরূপ। ঈশ্বরবিশ্বাসীদের কাছে যেভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অমলিন,
প্রেমের ক্ষেত্রেও তাই। শুধু তফাতটা এই, যে কবি অবিশ্বাসীদেরও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে
জানেন।
বৈষ্ণব ধর্মে যে প্রেম
রাধা-কৃষ্ণের প্রণয় থেকে শুরু হয়ে লীন হয়ে যায় চরম আধ্যাত্মিকতায়, কবি ঠিক সেইখান
থেকে আবার শুরু করেন যাত্রা। সেই মধুর ভাবটিই সতত দেখতে পাই তার রচনায়। রূপ-
অরূপের দ্বন্দ্ব, প্রেম বিষয়ে নারী-পুরুষের ভিন্ন ভিন্ন ভাবনা সবকিছুই যেন
‘বিরহ-মিলন মিলে গেল আজ সমান সাজে’।
‘কড়ি ও কোমল’ কাব্যগ্রন্থের
অনেক কবিতায় আমরা দেখি জাগতিক প্রেমের এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাস। মনে হয় সময়ের থেকে
অনেকখানি এগিয়ে ছিলেন কবি। সেসময়ে অনেক সমালোচকদের- এমনকি কবির অনুরাগীদেরও বলতে
শোনা গিয়েছিল, ‘কবি ওইধরনের কবিতাগুলি না লিখলেও পারতেন’। কিন্তু তিনি যে
জীবনশিল্পী, তাই মানবজীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যে জাগতিক এবং শরীরী প্রেম,
তা বর্জিত হয় নি তার লেখনীতে।
প্রেম ব্যতীত যে স্ত্রী বা পুরুষ কোনওভাবেই
সম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পারে না, একথা শুধু সঙ্গীত বা কবিতার মাধ্যমে নয়- তিনি এমনকি
দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে যান তার প্রবন্ধাবলীর মধ্যেও। তিনি বলেন...
‘আমাদের দেশে
পরিবার আছে, কিন্তু সমাজ নাই তাহার এক
প্রধান কারণ স্ত্রীলোকেরা পরিবারের মধ্যে বদ্ধ, সমাজের মধ্যে ব্যাপ্ত নহে। স্ত্রীলোকের প্রভাব কেবলমাত্র পরিবারের পরিধির মধ্যেই
পর্যাপ্ত। পরিবারের বাহিরে আর মানব সমাজ নাই, কেবল পুরুষ সমাজ আছে। কেবল পুরুষে পুরুষ গড়িতে পারে না। এমন-কি পুরুষ প্রকৃতি গড়িয়া তুলিতে স্ত্রীলোকেরই বিশেষ আবশ্যক। কারণ, স্ত্রীলোকেই চাহে, পুরুষ পরিপূর্ণ রূপে পুরুষ হউক। পুরুষের উন্নত আদর্শ স্ত্রীলোকের হৃদয়েই বিরাজ
করিতে পারে। স্ত্রীলোকের জন্যই পুরুষদিগকে বিশেষরূপে পুরুষ হওয়া আবশ্যক।... ‘
একটু ভেবে দেখলে
দেখতে পাই, পরিস্থিতির কিছুটা বদল হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। নারীমানুষের ব্যাপ্তি
ক্রমেই পরিবারের সীমা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে
সমাজের বিভিন্ন স্তরে। কিন্তু কবির কল্পনায় তিনি পুরুষের যে রূপ দেখে গিয়েছেন, তা কবে সাধিত হবে? হয়তো এক অনির্বচনীয়
প্রেম এসে কোনও একদিন বদলে দেবে সমাজের গঠন, কবির কল্পনামাফিক আমরা পাবো নতুন পথের
সন্ধান। কবি আবার উচ্চারণ করবেন... ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি... ‘
"এক অনির্বচনীয় প্রেম এসে কোনও একদিন বদলে দেবে সমাজের গঠন, কবির কল্পনামাফিক আমরা পাবো নতুন পথের সন্ধান।"... অপেক্ষায় রইলাম.........ভীষণ
ReplyDeleteভাল লাগছে তোমার এই ধারাবাহিক রচনা ।
অনেক ধন্যবাদ!
Deleteখুব ভালো লাগলো পড়ে
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ!
Deleteভালো লাগল।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ!
Delete