বাঁকুড়া জেলার একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম পলাশ ডাঙ্গা, আর সেই গ্রামের ছোট্ট একটি ছেলে গঙ্গাপ্রসাদ মুখার্জি। দামোদরের একদিকে বাঁকুড়ার পলাশডাঙ্গা আর অপর প্রান্তে বধর্মান জেলার কাঁকসা। গঙ্গা বড়দের কাছে শুনেছে দামোদর নদ পার হয়ে ওপারে গিয়ে ঐ কাঁকসা থেকে রেল গাড়ি চেপেই যাওয়া যায় কলকাতায়। তখনও বিদ্যুৎ চালিত ট্রেন চালু হয়নি। বাষ্প ওড়াতে ওড়াতে সে ট্রেন যন্ত্রের সাহায্যে ছুটে চলে। সেটা বিংশ শতাব্দীর মাঝা মাঝি। তখন ভারত সবে স্বাধীন হয়েছে।
গঙ্গাপ্রসাদের গ্রামের যারা কলকাতায় থাকে তাদের মুখে সে শুনেছে যে কলকাতায় নাকি হাওয়ায় টাকা ওড়ে শুধু ধরে নিতে জানতে হয়।
সেই কলকাতায় যাওয়ার জন্য গঙ্গা প্রসাদের যেন আর তর সয় না । গঙ্গা প্রসাদ তার সমবয়সী বন্ধুদের বলে, “জানিস একদিন আমি ওই নদ পার হয়ে কলকাতায় চলে যাব। তারপর অনেক অনেক টাকা রোজগার করব।” তবে তার এই কথায় সমবয়সী ইয়ার বন্ধুরা কেউ তেমন উৎসাহ দেয় না। বরং সবাই তাকে উপহাস আর বিদ্রূপের করে; তবে কথাটি যখন তার খেলার সাথী দশ বছর বয়সের সুলতাকে বলল, তখন সুলতা বলল, “সেই ভা্ল, তবে আমাকে কলকাতায় নিয়ে যাবে তো?” গঙ্গা গম্ভীর মুখে বলে, “দূর বোকা কলকাতায় মেয়েরা যায় না সেখানে শুধু পুরুষ মানুষরা যায়।” বারো বছর বয়সের গঙ্গা-র মুখে পুরুষ মানুষ শব্দটা শুনে সুলতারও কেমন যেন হাসি পেল। সুলতার মা তার বাবা-কে বলে, ‘পুরুষ মানুষ সারাদিন বাড়িতে বসে থাকতে লজ্জা করে না’? বাইরে বেরিয়ে কিছু কাজ কর্ম তো করলে পার? কিন্তু সুলতার দাদাকে তো কোনদিন ওর মা পুরুষ মানুষ বলে না ? তাকে বলে ‘ছেলেরা সংসারে কত কাজ করে আর তুই সারাদিন শুধু ঘুরে ঘুরে বেড়াস’?
সেই গঙ্গা একদিন আরো বড় হল, গ্রামের পাঠশালার পাঠ শেষ করে বাবার কাছে কিম্বা খুড়োর কাছে তাদের পৈত্রিক চাষ বাস সংক্রান্ত কাজকর্ম শিখে নিলো এখন সে ষোল বছরের তরতাজা কিশোর। কিন্তু এখনও সে মাথায় সযত্নে দুটি জিনিস পোষন করে চলেছে। এক নম্বর হচ্ছে যত দিন যাচ্ছে সুলতা যেন তার মাথায় আরও বেশী করে চেপে বসছে। এমন কোনদিন নেই ওর মাথায় সুলতার মুখ-টা ভেসে ওঠে না। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে কলকাতা যাওয়ার সেই সুপ্ত বাসনা, এবং দিন দিন দুটি বাসনাই যেন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। ইতিমধ্যে সুলতার বয়স চোদ্দ বছর হল, সেই যুগে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ঐ বয়সের পরেও কুমারী রাখা আর সমাজে একঘরে হয়ে যাওয়া প্রায় সমার্থক। শেষে একদিন গঙ্গা ঠিক করেই ফেলল, আপাতত সে কলকাতাতেই চলে যাবে এবং কিছু পয়সা উপার্জ্জন করে গ্রামে ফিরে আসবে। গঙ্গা প্রভুত অর্থের মালিক হলে সুলতা নিশ্চই সব কিছু মেনে নেবে। সুলতারাও ব্রাহ্মণ, দেখতে ভাল ওর বাবার গ্রামে বেশ প্রতিপত্তি আছে তাই গঙ্গার আশা দুই পরিবারের তরফ থেকে কোন রকম বাধা আসবে না। শুধু একটা বছর কোনরকমে সুলতার বিয়েটা আটকে রাখা।
একদিন গঙ্গার মনের কথা সুলতাকে বলতেই, সুলতা চোখের জলে তাকে একটাই উত্তর দিল..., “তুমি আমাকে কেনার জন্য কত টাকা দেবে গঙ্গা-দা ?” গঙ্গা উত্তেজিত হয়ে বলে, “ছি! সুলতা, এ কথা তুই কি করে বললি ? তোকে কি আমি টাকা দিয়ে কিনব বলেছি? তুই কি জানিস কোন মেয়েরা টাকার বিনিময়ে বিক্রী হয় ?” সুলতা তার উত্তরে খুব শান্ত ভাবেই বলল, “বিলক্ষন জানি, আর জানি বলেই তো আমার মনে এত শঙ্কা। তোমরা ছেলেরা প্রেম, ভালবাসার সঙ্গে টাকাকে বড্ড গুলিয়ে ফেলো। তোমাদের কাছে প্রেম ভালবাসা মানে শুধুই টাকা আর শরীর।”
একথা শুনে আরও উত্তেজিত হয়ে গঙ্গা বলল, “ছি সুলতা ছি ! তোর এত অবনতি? তুই কি বলতে চাস যে আমি তোর শরীরটা একদিন পাব সেই আসায় প্রতিদিন তোর কাছে আসি?” হঠাৎ উত্তেজিত গঙ্গা কাঁপতে কাঁপতে বলল, “একমাত্র বেবুশ্যে মেয়েরাই এই ধরনের কথা বলে, তা এই ব্যবসা তুই কতদিন হল শুরু করেছিস?” কথাটা মুখ থেকে বেরিয়ে যাবার পরই গঙ্গাপ্রসাদ বুঝতে পারল কি মারাত্মক কথা ওর মুখ থেকে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু তার উত্তরে সুলতা এতটুকুও উত্তেজিত না হয়ে বলল, “এখনও শুরু করিনি তবে যদি কোনদিন শুরু করি , জানবে সেদিন তুমিই হবে আমার প্রথম খদ্দের।”
সারা রাত এক সুতীব্র অনুশোচনা যেন গঙ্গা প্রসাদের শরীর ও মনকে জ্বালিয়ে দিতে থাকল। সারা রাত্রি এক ফোঁটা ঘুম হল না। অন্ধকার থাকতেই ভোর বেলায় সবার অলক্ষে গঙ্গা কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। তখন ভারত সবে স্বাধীন হয়েছে, ।সীমিত ক্ষমতার মধ্যেই সরকার দেশ গঠনের দিকে বিশেষ নজর দিয়েছে। তার উপর ওপার বাংলা থেকে এসেছে লক্ষ লক্ষ শরনার্থী, তাদের পুনর্বাসন দরকার। বিভিন্ন উদবাস্তু ক্যাম্প গুলোতেও প্রচুর কাজ হচ্ছে। এক কথায় ঠিকাদার দের তখন পোয়াবারো। গঙ্গা তেমনই একটি ঠিকাদার সংস্থায় সামান্য বেতনের চাকরিতে ঢুকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বেশ কয়েক বছর চাকুরিতে রত থেকে বেশ কিছু অর্থের মালিক হল।
মনের জোরে ইচ্ছে করেই এত দিন গ্রামে ফেরেনি। সে সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা মোটেও ভাল ছিল না, গ্রামে তার পিতা মাতা এবং গ্রামের অন্যান্য সকলে গঙ্গা চিরকালের জন্য নিরুদ্দেশ ধরে নিয়েই তার প্রত্যাবর্তের আশা ত্যাগ করে দেয়। শুধু সুলতা বিবাহের পরেও আজও প্রতিদিন গঙ্গা নাম জপ করে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে চলেছে। তবে কলকাতা শহরে সে নিজেকে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত করে প্রায় পাঁচ বছর পরে প্রথম বার বাঁকুড়ায় নিজের গ্রামে ফিরল এবং আত্মীয় পরিজন দের সঙ্গে সাক্ষাত করে সুলতার বিবাহের খবর শুনে কিছুদিনের মধ্যেই আবার কলকাতায় ফিরে এল। এবার যেন আরও বেশী করে কাজকর্মে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং স্বীয় ক্ষমতায় অল্পদিনে নিজেই একটি ঐরূপ একটি ঠিকাদরি সংস্থা খুলে ফেলল। কিছুদিনের মধ্যেই প্রচুর টাকা উপার্জ্জন করে সে কলকাতা উচ্চবিত্ত সমাজে তার স্থান পাকা করে নিল। কলকাতা শহরে তার তখন তিনটে বাড়ি দুটি গাড়ি।
এই ভাবে চলতে চলতে একদিন মধ্য চল্লিশের গঙ্গা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লক্ষ করল তার মাথার চুলে পাক ধরেছে । চোখের কোনে শরীরের উপর অত্যাচারের লক্ষণ স্পষ্ট। অত্যাচার বলতে শুধু কাজ আর কাজ, আর সন্ধ্যায় ইয়ার বন্ধুদের সঙ্গে বসে একটু মদ্যপান। পলাশ ডাঙ্গার সেই কিশোর গঙ্গাপ্রসাদ আজ অনেক পরিণত। সারাদিন পরিশ্রম করে কোম্পানীর সকল কাজ এখন নিজে একাই দেখাশোনা করে। সেই সুবাদে বড় সাহেবদের সঙ্গে মেলামেশা করে ইংরাজীটাও এখন মোটামুটি ভালই শিখেছে।
সারাদিন খাটা খাটনির পর অবিবাহিত গঙ্গা ইয়ার বন্ধুদের সঙ্গে মদ্যপান করতে বসে, তবে ইদানিং সে একটা জিনিস লক্ষ করেছে, মনে মনে সে যেন কারও সঙ্গ কামনা করে। তার মনে এখনও কি সুলতার সেই নিষ্পাপ মুখটাই উকি দেয় ? বন্ধুদের কাছে এ কথা বলতেই তারা উপদেশ দিল...... মনের আর দোষ কি? এই বয়সে শরীর ও মন দুই ই তো সঙ্গ কামনা করবে...... আর সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু তবুও গঙ্গা যেন সবাইকে ব্যাপারটা বোঝাতে পারে না। এ সঙ্গ ঠিক সেই সঙ্গ নয়। এটা ঠিক স্ত্রীর সঙ্গ নয়। কোন নারী সঙ্গ নয়। এ যেন সারাদিন খাটা খাটনির পর বাড়ির কোন আপনজনের সঙ্গ। যা থেকে গঙ্গা আজ দীর্ঘদিন বঞ্চিত।
তবু বন্ধুরা তাকে বোঝায় সারাদিন খাটা খাটনির পর সন্ধ্যাবেলায় একটু নাচ গানের আসরে গেলে মনটা দুদিনে অনেক হাল্কা হয়ে যাবে। কথায় বলে যেখানে টাকা ওড়ে, সেখানেই সুন্দরীরা ঘোরে। কিছুদিনের মধ্যেই গঙ্গার এক ঘনিষ্ট বন্ধু কানাই খবর দিল বউবাজারে একজন বাঙ্গালী বাইজী এসেছে, তার যেমন রূপ তেমন-ই গানের গলা। বন্ধুদের পরামর্শে পরদিন সদলবলে গঙ্গা সেখানে গিয়ে হাজির। অত্যন্ত সুদৃশ্য এবং সুসজ্জিত একটি ঘরে গঙ্গা সবান্ধব বসল। গঙ্গার একটু অস্বস্তি হচ্ছে। এই প্রথম সে এই রকম একটা পরিবেশে এসেছে। সঙ্গীতের বাজনদাররা যে যার নিজের নিজের জায়গায় এসে বসল। সুসজ্জিত রেকাবে ও পানপাত্রে অতিথিদের খাদ্য এবং পানীও পরিবেশন করা হল। আর তার সামান্য পরেই এক পরমা সুন্দরী তার দুই সখীকে নিয়ে ওই ঘরে প্রবেশ করল। অষ্টাদশী পরমা সুন্দরী মেয়েটি ঠিক গঙ্গার মুখো-মুখি বসতেই গঙ্গার নজর গিয়ে পড়ল তার মুখের উপর। সঙ্গে সঙ্গে গঙ্গার সমস্ত শরীরে যেন এক বিদ্যুৎ তরঙ্গ প্রবাহিত হয়ে গেল। সেই মুখ, সেই চোখ, এমনকি গলার স্বরও ঠিক তার মত। কিন্তু তা কি করে সম্ভব? এর বয়স খুব বেশী হলে আঠারো-কুড়ি বছর হবে আর সে তো......। গঙ্গা কৌতুহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, “মা তোমার নাম কি?” বন্ধুরা অবাক... একজন বাইজিকে মা বলে সম্বোধন ? উত্তরে বাইজিটি বলল, “হুজুর বোধ হয় এই লাইনে প্রথম, হুজুরের জানা নেই যে বাইজীদের আসল নাম পরিচয় জিজ্ঞেস করতে নেই?” গঙ্গা সবাইকে আরও অবাক করে দিয়ে বলল, “আমার শরীর খারাপ লাগছে আমি এখন-ই বাড়ি যাবো।” বাড়িতে ফিরে গঙ্গা তার চব্বিশ ঘন্টার কাজের লোক কানাই-কে বলল, “যে করেই হোক, যত টাকা লাগে লাগুক ... মেয়েটির আসল পরিচয় খুজে বের করতেই হবে। যতদিন না ওর আসল পরিচয় জানা যাচ্ছে ততদিন ও কোন কাজ করবে না। মেয়েটি বাইজী হিসেবে প্রতিদিন যে টাকা রোজগার করে সেটা ওকে আমি-ই দেব।
দুইদিনের মধ্যেই কানাই খবর নিয়ে এল, মেয়েটির আসল নাম বিজয়া, বাবার নাম যাদব ভট্টাচায্য বাড়ি বাঁকুড়ার সোনামুখি গ্রামে। বাবাটি বড়ই চরিত্রহীন । স্ত্রী কন্যার প্রতি তার কোন নজর নেই। গঙ্গা উত্তেজনায় কাপতে কাপতে চিৎকার করতে থাকে ...। “নিকুচি করেছে ওর বাবার নাম ঠিকানায়...। ওর মায়ের নাম কি? মামার বাড়ি কোথায় সেই খবর নিয়ে এস।” কানাই বলল, “আমি তাও এনেছি, ওর মামার বাড়ি পলাশডাঙ্গা, আর মা সুলতা সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন।” একথা শুনেই গঙ্গা পাগলের মত হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। বাড়ির যত পরিচারক, পরিচারিকারা তঠস্থ হয়ে এ ওর মুখ চাওয়া চায়ি করতে লাগল।
পরদিন সক্কালে উঠে গঙ্গা একাই দৌড়ে গেল সেই বাইজী বাড়িতে। উদভ্রান্তের মত ছোটা ছুটি করে খুঁজে বের করল বাড়ির মালকিন মাসীকে। বলল, “কোথায় তোমার বিজয়া? আমার এখন-ই ওকে চাই।” মালকীন ভালো করে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার হাতে এক টাকা দু টাকা নয় দশ হাজার টাকা গুজে দিয়ে বলল, “বিজয়াকে এখন-ই আমার চাই।” মাসী জীবনে একশো টাকার বেশী কখনো দেখেনি। সেই যুগে দশ হাজার টাকায় একটা ছোটখাটো দোতলা বাড়ি হয়ে যেত। এত গুলো টাকা হাতে পেয়ে কেমন যেন ভয় পেয়ে গিয়ে তখনই সাজিয়ে গুজিয়ে বিজয়াকে গঙ্গার হাতে তুলে দিল। গঙ্গা বিজয়াকে বুকে টেনে নিয়ে বলল, “কিরে আমাকে চিনতে পারিসনি তো? আমি গঙ্গা মুখুজ্জে, পলাশডাঙ্গার গঙ্গা। আমার একার সংসারে এত সম্পত্তি কে দেখবে বলতো? চল তাই তোকে নিতে এলাম...পারবি না তোর এই বুড়ো ছেলেটাকে শাসন করে সংসারের হাল ধরতে ? আর এই সারাদিন খাটা খাটনি, আর মদ মাংস এসব আর ভাল লাগে না রে ? চল আমি তোকে নিয়ে যেতে গাড়ি নিয়ে এসেছি। তাড়াতাড়ি চল আমরা মা আর বেটায় মিলে নতুন করে সংসারটা শুরু করি।” বিজয়া তার মায়ের কাছে অনেকবার গঙ্গা মুখুজ্জের নাম শুনেছে... তাই গঙ্গা-কে চিনে নিতে তার অসুবিধা হল না। সে তার বুড়ো ছেলের সঙ্গে গাড়িতে গিয়ে উঠল। ওদিকে এই প্রথম কুঠির মানুষরা তাদের দোর্দন্ড প্রতাপশালী মাসীর চোখে জল দেখলো।
খুব ভাল লাগল......।
ReplyDelete