এসে গেল নতুন বছর। বাংলা
নববর্ষ ১৪২৪। বছরের শুরু যে তাঁর জন্মমাস দিয়েই, কাজেই তাঁকে ভোলার কোনও জো নেই।
শুধু কি তাই? বাঙ্গালী তাঁর ভাষা ধার করেই স্বাগত জানায় নববর্ষকে। স্লোগানের মত
উচ্চারিত হয়, ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।’
তাঁর ভাষা, তাঁর দেখিয়ে
দেওয়া পথে বাঙ্গালী বরণ করে নিতে চায় নতুন বছরের নতুন আশা- আকাঙ্ক্ষা। সবারই
ভাবনার মধ্যে থাকে, ‘তাপস-নিঃশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে, বৎসরের আবর্জনা
যাক।’ হ্যাঁ, পুরনো সময়ের গ্লানি এভাবে ঝেড়ে ফেলে নতুনের আবাহন করার মধ্য দিয়ে
আমরা যেন নিজেরাও নতুন হয়ে উঠতে চাই। হয়ত অনেকেই বলবেন, বাংলা নববর্ষ শুধুই একটি
তারিখ ছাড়া কিছু নয়। বাঙ্গালী হুজুগে জাত, সে হুজুগে পড়ে ইংরেজি নববর্ষকে আপন করে
নিয়েছে একথা যেমন মিথ্যে নয়, তেমন একথাও
সত্যি যে বাঙ্গালী সারা বছর বাংলা তারিখ, তিথি মনে না রাখলেও বাংলা নববর্ষকে ফেলে
দেয়নি মোটে। নতুন নতুন উদযাপনে রক্তের মধ্যে ভরে নিতে চাইছে নতুন বছরের বার্তা।
সেকাজ করতে গিয়ে বাঙ্গালী রবীন্দ্রনাথের কথা যদি ধার করেই বলতে চায়, বলুক না।
ক্ষতি কি? হোক না সেই বলা বহু- ব্যবহৃত, বহু- চর্চিত। ‘মরা, মরা’ জপ করতে করতেই
একদিন দস্যু রত্নাকর হয়ে উঠেছিলেন মহর্ষি বাল্মীকি। ঠিক সেভাবেই বাঙ্গালী নিজের
মধ্যমেধার মনন দিয়েও যদি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে চর্চা বিস্মৃত না হয়, সে যে নিজের
অগৌরবকে অতিক্রম করতে সক্ষম হবে, এবিষয়ে সন্দেহ নেই।
বৈশাখ মানেই কবির জন্মদিনের
উদযাপন, তাঁকে ঘিরে উৎসব। তাঁর জীবদ্দশাতে বিশেষ মাত্রা পেত এই উৎসব পঁচিশে
বৈশাখে। তাঁরি লেখা গানে- কবিতায় তাঁকে স্মরণ। সেই ধারা এখনো অব্যাহত সাধারণ
বাঙ্গালীর জীবনেও। কিন্তু এই বৈশাখ কবিকে শুধু তার কালবৈশাখীর রুদ্ররূপ দেখিয়ে
ক্ষান্ত দিয়েছিল এমন নয়। পরিণত বয়সে এসে প্রিয়জনের মৃত্যুশোক কতখানি যন্ত্রণাদায়ক,
এ উপলব্ধি প্রথম তার হয়েছিল কোনও এক বৈশাখেই। ১২৯১ সালের ৮ই বৈশাখ মারা গিয়েছিলেন
রবীন্দ্রনাথের বৌঠান কাদম্বরী দেবী। এই প্রসঙ্গে কবি লিখছেন, ‘কিন্তু আমার চব্বিশবছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয় হইল তাহা স্থায়ী পরিচয়। তাহা তাহার পরবর্তী প্রত্যেক বিচ্ছেদশোকের সঙ্গে মিলিয়া অশ্রুর মালা
দীর্ঘ করিয়া গাঁথিয়া চলিয়াছে।‘ ... অতএব, বৈশাখ মানে কবির কাছে
শুধুই সুমধুর স্মৃতি ছিল না।
প্রতি নববর্ষের বার্তায় কবি
খুঁজে ফিরেছেন অসীম আনন্দ, সন্ধান করেছেন সুন্দরের। ধার্মিক আচার- আচরণের উর্দ্ধে
এক আনন্দসুন্দর যাপনের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন বহুবার। বলেছেন... ‘নববর্ষের প্রাতঃসূর্যালোকে দাঁড়াইয়া অদ্য
আমাদের হৃদয়কে চারিদিক হইতে আহ্বান করি। ভারতবর্ষের যে পৈতৃক মঙ্গলশঙ্খ গৃহের
প্রান্তে উপেক্ষিত হইয়া পড়িয়া আছে সমস্ত প্রাণের নিশ্বাস তাহাতে পরিপূর্ণ করি- সেই
মধুর গম্ভীর শঙ্খধ্বনি শুনিলে আমাদের বিক্ষিপ্ত চিত্ত অহংকার হইতে স্বার্থ হইতে
বিলাস হইতে প্রলোভন হইতে ছুটিয়া আসিবে। আজ শতধারা একধারা হইয়া গোমুখীর মুখনিঃসৃত
সমুদ্রবাহিনী গঙ্গার ন্যায় প্রবাহিত হইবে...’
হ্যাঁ, তাঁর এই বিশ্বাস ছিল। শুধু বাঙ্গালীকে নিয়ে নয়। ভারতবর্ষের আপামর
জনগণকে নিয়ে এই স্বপ্ন লালন করেছিলেন তিনি।
স্বপ্নদ্রষ্টা কবি তাই তাঁর নিজের জীবনের শেষ বৈশাখেও লিখে যেতে পারেন...
‘এই দিন বলে আজি মোর কানে,
‘অম্লান নূতন হয়ে অসংখ্যের মাঝখানে
একদিন তুমি এসেছিলে
এ নিখিলে
নবমল্লিকার গন্ধে,
সপ্তপর্ণ-পল্লবের পবনহিল্লোল-দোল-ছন্দে,
শ্যামলের বুকে,
নির্নিমেষ নীলিমার নয়নসম্মুখে।
সেই-যে নূতন তুমি,
তোমারে ললাট চুমি
এসেছি জাগাতে
বৈশাখের উদ্দীপ্ত প্রভাতে।‘...
‘অম্লান নূতন হয়ে অসংখ্যের মাঝখানে
একদিন তুমি এসেছিলে
এ নিখিলে
নবমল্লিকার গন্ধে,
সপ্তপর্ণ-পল্লবের পবনহিল্লোল-দোল-ছন্দে,
শ্যামলের বুকে,
নির্নিমেষ নীলিমার নয়নসম্মুখে।
সেই-যে নূতন তুমি,
তোমারে ললাট চুমি
এসেছি জাগাতে
বৈশাখের উদ্দীপ্ত প্রভাতে।‘...
কবি দেখেছিলেন এক উদ্দীপ্ত প্রভাতের স্বপ্ন। দীর্ঘজীবী কবি তাঁর অভিজ্ঞতায় এবং
জীবনে পৃথিবীতে সভ্যতার কালো অধ্যায় কম দেখেননি। দুটি বিশ্বযুদ্ধ দেখেছেন, দেখেছেন
মানুষে মানুষে অবিশ্বাসের কালো ছায়া। তবুও স্বপ্ন দেখা বন্ধ হয়নি তাঁর। নববর্ষের
আবাহনে কখনও বিশ্ববিধাতার প্রতি বেজেছে অভিযোগ, অনুযোগের সুর, কিন্তু কখনও শুকিয়ে
যায়নি অন্তর্নিহিত আশাবাদের ফল্গুধারা। চরম নিরাশার মধ্যেও তিনি উচ্চারণ করেছেন
আনন্দের বার্তা। আমরা কান পেতে আছি সেই ধ্বনির অপেক্ষায়...
‘কতবার নববর্ষ এসেছে, কত নববর্ষের দিনে তোমরা কাছে মঙ্গল প্রার্থনা করেছি। কিন্তু, কত মিথ্যা আর বলব। বারে বারে কত মিথ্যা সংকল্প আর উচ্চারণ করব। বাক্যের ব্যর্থ
অলংকারকে আর কত রাশীকৃত করে জমিয়ে তুলব। জীবন যদি সত্য হয়ে না থাকে তবে ব্যর্থ
জীবনের সত্য হয়ে উঠুক– সেই বেদনার বহ্নিশিখায় তুমি আমাকে পবিত্র করো। হে রুদ্র, বৈশাখের প্রথম দিনে আজ আমি তোমাকেই প্রণাম করি– তোমার প্রলয়লীলা আমার
জীবনবীণার সমস্ত আলস্যসুপ্ত তারগুলোকে কঠিনবলে আঘাত করুক, তা হলেই আমার মধ্যে তোমার সৃষ্টিলীলার নব আনন্দসংগীত বিশুদ্ধ হয়ে বেজে উঠবে।‘
"তৃপ্তি আমার , অতৃপ্তি মোর ,মুক্তি আমার , বন্ধনডোর
ReplyDeleteদুঃখসুখের চরম আমার জীবন মরণ হে । "
খুব সুন্দর লিখেছ :)
অনেক ধন্যবাদ জয়াদি!
Deleteখুব সুন্দর লিখেছ নন্দিনী....
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ নূপুরদি।
Delete