Tuesday, October 24, 2017

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া


সম্পাদকীয় / গৌতম সেন


প্রথমেই চিলেকোঠা ওয়েবজিনের তরফে চিলেকোঠার সকল সদস্য-সদস্যাদের, এই ব্লগের সমস্ত পাঠক-পাঠিকাদের এবং অন্যান্য শুভানুধ্যায়ী ব্যক্তিদের জানাই শুভ বিজয়া ও শুভ দীপাবলির আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা। ইত্যবসরে শারদীয়া উৎসব দুর্গাপুজো শেষ ও অতি সম্প্রতি হয়ে গেল দীপাবলী তথা কালীপুজো উৎসব। আনন্দ  ও আলো ঝলমলে দিনগুলো আশা করব সবাই খুশি মনে অতিবাহিত করেছেন।
সদ্য সদ্য হেমন্ত ঋতু প্রকৃতির বুকে তার পরশ রেখেছে। মাঠের ধান পাকার সময় আগতপ্রায়। কিন্তু প্রকৃতির খামখেয়ালীপনা যেন কিছুতেই কাটতে চাইছে না। পুনঃ পুনঃ আকাশে বাদল মেঘের আনাগোনা – অকাল বর্ষণের আবির্ভাব আমাদেরকে একরকম ভাবিয়ে তুলছে বারবার। বৃষ্টি শেষে পাকা ফসল তোলা রোদের এখন অপেক্ষা।  সর্বান্তকরণে বরষা বিদায়ের তাই প্রার্থনা জানাই।
এবার তো মনে হিমেল হাওয়ার টান লাগার সময় এসে গেল। ঘরে ঘরে ছাদের ওপর খোলা জায়গায় আকাশ প্রদীপ জ্বালার ক্ষণ। কবির সেই বিখ্যাত গান মনে আসে – “হিমের রাতের ওই গগনের দীপগুলিরে /হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে...” – আকাশের তারারা হালকা কুয়াশার অবগুণ্ঠনের আড়ালে নেবে আশ্রয় আর সামান্য কিছু কালের অবসানে।
চিলেকোঠা ওয়েবজিন কৃতজ্ঞতা জানায় অকুণ্ঠ চিত্তে সকল লেখক, কবিবন্ধুদের যারা তাদের লেখনীর অবদানে শুধু যে ধন্য করেছেন এই সাহিত্যপ্রয়াস কে নির্বিঘ্ন যাত্রা অক্ষুণ্ণ রাখতে তাই নয়, পাশে থেকেছেন এই ওয়েবজিনের জন্মলগ্ন থেকে এর সাফল্যের অংশীদার হয়ে। পাঠক-পাঠিকা, সদস্য-সদস্যাদের অবদান ও নিরবিচ্ছিন্ন সমর্থন এ পত্রিকার আর এক শ্রেষ্ঠ সম্পদ, এগিয়ে চলার মূলধন।
অবশেষে সকলে সুস্থ থাকুন, আনন্দে থাকুন এই শুভকামনা জানাই।






ধারাবাহিক / স্বপ্নস্বরূপ - ১১ ন ন্দি নী সে ন গু প্ত


এবছর বঙ্গদেশে বর্ষা বিলম্বিত। শরত সদ্য প্রবেশ করেছে প্রকৃতিতে। কিন্তু হিসেবমত আশ্বিন ফুরিয়ে গিয়েছে ক্যালেন্ডারে। তাহলে কি হেমন্তকে আর দেখা যাবে না? লুকিয়ে থাকা এই হেমন্ত ঋতুর রূপের কথা ত প্রথম পেয়েছিলাম তাঁরই গানে, যখন শুনেছিলাম ‘হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা’। নিজেকে গোপন করে অন্তরালে থাকার যে মধুর ভাব এই ঋতুর, রবীন্দ্রনাথের প্রকাশভঙ্গীকে আশ্রয় করে তা অনুরণিত হয়েছে বাঙালির মনে। প্রশ্ন উঠেছে চরাচরে শুকিয়ে যাওয়া কাশবনে, ‘আপনাকে এই কেমন তোমার গোপন করে রাখা?’
তবে একই সঙ্গে একটা জিনিস লক্ষ্য করে অবাক লেগেছিল, হেমন্ত ঋতুকে কবি প্রায়ই বলেছেন ‘হেমন্তলক্ষ্মী’। এই ‘লক্ষ্মী’ অভিধাটি এই হেমন্ত ঋতুর সাথে কেন জড়িয়ে গিয়েছিল, সেটা কিশোরীবেলায় বুঝে উঠতে পারিনি। বয়স বাড়লেও বিস্ময় কমে নি। যখন জেনেছিলাম যে কবি পৌত্তলিক হিন্দুধর্মের কেউ নন, অথচ ধনসম্পদের অধিষ্ঠাত্রী এই দেবীরূপের উপমাটি যত্ন সহকারে ব্যবহার করেছেন এক ঋতুর রূপবর্ণনায়, তখন বিস্ময় আরও বেড়েছিল। কিন্তু প্রকৃতির ফসলসমৃদ্ধ রূপ আর কীভাবে বলা যায়? সোনারূপা বা রত্নরাজি নয়, যে জিনিস মানুষের ক্ষুন্নিবৃত্তি করে সে খাদ্যশস্যই যে প্রকৃত সম্পদ। লক্ষ্মীর বাস যে সেখানেই। তাই কবি বারে বারেই তার কাব্যে আবাহন করেন ‘হেমন্তলক্ষ্মী’ কে। প্রণাম জানিয়ে এই ঋতুকে সম্বোধন করেছেন ‘ক্ষুধার্তজনশরণ্য’ রূপে। এমনকি শুধু লক্ষ্মী নয়, আরেকধাপ এগিয়ে তাকে বলেছেন ‘অন্নপূর্ণা’।
‘নটরাজ’ গীতিনাট্যে এই ঋতুকে কবি বলছেন,
‘... “কোথায় গো, অন্নপূর্ণা, ক্ষুধার্তেরে অন্ন দিবে না কি?
শান্ত করো প্রাণের ক্রন্দন, চাও প্রসন্ন নয়ানে
ধরার ভাণ্ডার পানে।” শুনিয়া লুকায়ে হাস্যখানি,
লুকায়ে দক্ষিণ হস্ত দক্ষিণা দিয়েছ তুমি আনি,
ভূমিগর্ভে আপনার দাক্ষিণ্য ঢাকিলে সাবধানে। ...’
হ্যাঁ, এখানেও আছে সেই লুকিয়ে দাক্ষিণ্য দেখাবার কথা। এই বিনীত রূপ, যেখানে ডানহাত সাহায্য করলে, বামহাত জানতে পারেনা, চিরন্তন এই ভারতীয় মূল্যবোধের প্রকাশও দেখতে পাই এই লেখায়। আজ  বিজ্ঞাপনসর্বস্ব সমাজে দাঁড়িয়ে নিজেকে অপ্রকাশে রেখে অন্যকে দাক্ষিণ্য দেখাবার এই চিন্তা হয়ত মুর্খামি ছাড়া কিছু নয়। তবুও এই লেখা মনে করিয়ে দেয় যে এই বোধের মধ্যেও রয়েছে এক আত্মতৃপ্তি, আছে এক অদ্ভুত গর্ব।
হেমন্তের রূপের বর্ণনায় কবির লেখায় অবধারিতভাবেই আসে দীপাবলির প্রসঙ্গ। শিশুবেলায় এই গান গায়নি এমন বাঙালি কম আছে। ‘যাক অবসাদ, বিষাদ কালো, দীপালিকায় জ্বালাও আলো!’ এই ত সবে কিছুদিন হল আমরা পেরিয়ে এলাম দীপাবলির রাত। অদ্ভুত এক দ্যোতনার সৃষ্টি হয় এই গানের মধ্যে বর্ণিত দৃশ্যে। চোখ বুজলে যেন দেখতে পাই আকাশের নক্ষত্রের প্রদীপের কম্পমান শিখাগুলিকে আঁচলের ছায়া দিয়ে আড়াল করছে ‘হেমন্তিকা’ রূপিণী ঋতু।
দীপাবলির প্রসঙ্গ উঠলে কালীপূজার প্রসঙ্গ আসেই। এই প্রসঙ্গে বলিদানের ব্যাপারে কবিমনের বিরূপতা শুধু ‘বিসর্জন’ নাটকে নয়, বিভিন্ন লেখায় প্রকাশ পেয়েছে। শুধু তাই নয় ‘কালী’ প্রসঙ্গে বাঙালিজাতির ভক্তির তমোগুণ তার মনকে সেভাবে আকৃষ্ট করেনি, তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় বারে বারে। যখন তিনি  ‘জাভাযাত্রীর পত্র’ এ উল্লেখ করেন সে দেশের হিন্দুধর্মের আচার আচরণের কথা, তখন কতকটা যেন আশ্বস্তবোধ করেছেন তিনি সেখানে ‘করালবদনা উলঙ্গিনী কালী’র অনুপস্থিতিতে। আশ্বস্তবোধ করেছেন সেখানে পূজায় বলিদানের প্রচলন না থাকায়। তিনি যেন সযত্নে এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন এই দেবীমূর্তি। তার কাছে এই মূর্তি ‘কাল’ বা সময়ের প্রতীক নয়, নয় ঘরের আহ্লাদী মেয়ে ‘শ্যামা আনন্দময়ী’, বরং তিনি যেন শিউরে ওঠেন বারে বারে এই ‘রক্ততৃষাতুরা’ দেবীমূর্তির উপস্থিতিতে। এত ভীতি এবং বিরূপতা থাকলেও ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’য়  রচনা করেছেন মায়ের জয়গান ‘কালী, কালী বলো রে’ এক অদ্ভুত দক্ষতায়। কবির নতুন এক্সপেরিমেন্‌ট বলা চলে এই গানটিকে, যেখানে পাশ্চাত্য সুরের সাথে শেষ লাইনে এসে মেলবন্ধন ঘটছে আমাদের দেশজ সুরের। আরও বিস্ময় জাগে, যখন জানতে পারি যে মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি লিখেছিলেন এই গান। হয়ত বা তারুণ্যের উচ্ছ্বাস তাকে প্রেরণা দিয়েছিল এই নিয়ম-ভাঙ্গা গানখানি লিখতে। তিনি গেয়ে উঠেছিলেন শ্যামা মায়ের জয়গান। ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’ নাটককে কবি নিজেই বলেছেন ‘দস্তুরভাঙ্গা গীতিবিপ্লবের প্রলয়ানন্দে রচিত’। তিনি নিজেই নিশ্চিত ছিলেন যে অনেক গানে তিনি অদ্ভুত দুঃসাহসিক হয়েছেন। আশঙ্কা ছিল যে প্রবল সমালোচনার ঝড় উঠবে। কিন্তু সেরকম কিছু হয়নি, বরং অনেক গবেষণার উপকরণ হিসেবে কালজয়ী হয়ে উঠেছে তার লেখনীর আখরগুলি।                    
                   


কবিতা / অভিরূপের প্রেম.../ অনুপম দাশশর্মা


অন্তরজুড়ে বাসনার জড়াজড়ি। পৃথিবীর  যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ চেপে ধরে মখমল
কথামালায় হৃদয়ের দিগন্ত তুলে ধরছো অভিরূপ।

অথচ এক একটা সময় যেন নেহাত মৃতদিন
আলো নিভে যাওয়া মেঘলা বিকেল।
জীবনের গতিতে চাই আলোর উড়াল
ভেঙ্গে দিতে হয় নৈঃশব্দের অহঙ্কার।

এসব জানো তুমি অভিরূপ। স্বতঃসিদ্ধ।
অথচ বেঁধে রেখেছ বর্ণ, একঘেয়ে চৌষট্টি কলায়।

এবার বেজে উঠুক বৃষ্টিবীণা
ঝরে পড়ুক দেহাতি শব্দে টিনের চালে।
বাসনা নয় হৃদয়ের শস‍্যখেত,
জীবনকে ভালবাসতে লাগে আত্মনিংড়ান দুঃখবোধ
পতিত সমাজের জন‍্য।  তোমার প্রেমিকা
থাক তোমার আত্মমগ্ন বুকে।
ক্লিষ্ট মুখে আলো ফেরাতে আমি অক্ষরে
ছবি এঁকে যাবই একে একে--

জানি, তথাকথিত প্রেম আসন পায়না
মনান্তরের ঘূর্ণিপাকে।


আস্তানা / শ্যামশ্রী চাকী





ছাদের দরজাটা ভালো করে দেখেই বন্ধ করেছিলেন প্রতুল বাবু, নাহ! কোনো ভুলচুক তো হয়নি, তালাটাও দুবার নেড়েচেড়ে  দেখেছিলেন, ওপরের খিলটা লাগিয়ে কড়াগুলো টেনে তালা লাগানো, তাহলে আজও ওই শব্দটা আসছে কোত্থেকে! এই এক জ্বালা হয়েছে !গত এক সপ্তাহ হল ঠিক মাঝরাতে ছাদে কারা যেন হেঁটে বেড়ায়, চোরের মত চুপিচুপি নয় বেশ গটমটিয়ে ধুপধাপ শব্দে। প্রথম প্রথম ভাবতেন মনের ভুল, এই ভাগাড়ে কে আসবে ছাদে চুরি করতে আর এলেও প্রতুলবাবুর আছেটা কি? ওই তো একটা ঝুরঝুরে ট্রাঙ্ক, আদ্দিকালের একটা তক্তাপোষ, আলনা আর একটা কেরোসিনের স্টোভ, দুটো বাসন । নিজেই দুমুঠো ফুটিয়ে খান প্রতুলবাবু সেগুলো নিতে আর যাই হোক ভাঙা কার্নিশ বেয়ে চোরের দল আসবেনা। কিন্তু গত তিন রাতে বার বার ঘুম ভেঙেছে প্রতুলবাবুর।
আজ তাই চারদিক ভালো করে দেখে তালাটা লাগিয়েছিলেন, কি বিপত্তি! এই মাঝরাতে কি শুরু হল রে বাবা! টর্চটা নিয়ে চটিতে পা গলান প্রতুলবাবু।কুলঙ্গিতে রাখা চাবির গোছাটা বের করে চুপিসারে ছাদে উঠে দরজা খোলেন, কোথাও কিচ্ছু নেই। দুদিন আগে পুর্ণিমা গেছে চাঁদের আলোয় ফুটফুটে ছাদ, সামনে কাঁঠাল গাছের পাতা দুলছে, বাতাবী লেবু গাছের ফুলের গন্ধ ম ম করছে, নাহ ছাদে এসে ভুল করেন নি, জ্যোৎস্নার এই হাড়পাঁজর বের হওয়া বাড়িটাকেও রাজপুরী মনে হচ্ছে।একটু পায়চারী করেন প্রতুলবাবু ছাদের উত্তরে ধানক্ষেত, ওদিক থেকে বেশ হাওয়া আসছে।হঠাৎ একটা আলো ধক করে জ্বলে আবার নিভে গেলো আর একটা রাতচরা পাখি ডানা ঝাপটে বিদীর্ণ চিৎকার করে মাথার ওপড় দিয়ে উড়ে গেলো। একটু কেঁপে উঠলেন প্রতুলবাবু, গ্রামে আলেয়ারআলো প্রায়ই দেখা যায় অনেকবার পড়েছেন, একটা গ্যাস জল কাদা থেকে উঠে বাতাসের সংস্পর্শে জ্বলে ওঠে,এই প্রথমবার আলেয়া নিজের চোখে দেখলেন প্রতুলবাবু। হঠাৎ কেমন শীত শীত করতেলাগলো, প্রতুলবাবু নীচে নেমে এলেন। 



পরেরদিন মাঝরাতে প্রতুলবাবুর ঘুম আর ভাঙেনি, একটা সলিড ঘুম দিয়ে সকাল ছ'টায় মর্নিং ওয়াকে বেরোলেন। ওদিকের ধানক্ষেতটা বেশ ভালো করে দেখে এলেন, কোথাও কিছু নেই! শুধু জলা জায়গার কিছুটা শুকিয়ে টান ধরেছে, শীত পড়বে পড়বে... ঠিকই ধরেছিলেন কাল আলেয়ার উৎপত্তি এখান থেকেই। জলার ধারে প্রচুর পরিযায়ী পাখি এসেছে। 
প্রতুলবাবু বাড়ি ফিরে দেখলেন ক্ষিদেটা বেশ চাগাড় দিচ্ছে। ভাতে ভাত বসিয়ে উত্তরের জানালাটা খুলতেই একটা কি পাখি না বাদুড়ের মত উড়ে চলে গেলো ঠিক তখনি একটা লেবু ফুলের গন্ধ টের পেলেন, এই গন্ধটা সেদিন ছাদেও পেয়েছিলেন। প্রতুলবাবুর মনে পড়লো বাতাবী লেবুর গাছটা তো গতবছর ঝড়ে পরে মরে গেছে তাহলে লেবুর গন্ধ এলো কোত্থেকে? এ তল্লাটে কোথাও লেবু গাছ নেই। যাহোক বাতাসে ভেসে এসেছে হয়ত দূর থেকে আবার মনের ভুলও হতে পারে, এই নিয়ে আর কিছু ভাবলেন না প্রতুলবাবু। পরদিন সকালে প্রতুলবাবু ঘুম ভেঙে দেখলেন ছাদের এক কোনে শুয়ে আছেন। রাতে কখন উঠে তালা খুললেন কখনই বা ছাদে এলেন কিছুই মনে করতে পারলেন না, তবে কাল রাতে বেশ গুমোট লাগছিল হয়তো ঘুমের ঘোরে এসেছেন। সারা গায়ে ব্যথা চোখ জবাফুলের মত লাল, এই শীতের শুরুতে খোলা ছাদে শোয়ার ফল, দুপুরে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলো প্রতুলবাবুর।






রাতটা ঘোরের মধ্যে কাটলো, সকালে চোখে রোদ পড়তেই দেখলেন আবার ছাদের কোনে শুয়ে আছেন, শরীর এত দুর্বল উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই! কিভাবে এলেন ছাদে? এবার বেশ ভয় পেয়ে গেলেন প্রতুলবাবু। একটু বেলা যেতেই খানিকটা সুস্থ বোধ করলেন, কোনোমতে রেলিং ধরে ধরে নীচে নেমে এসে ধপাস উঠোনে বসলেন প্রতুলবাবু। ভাগ্যক্রমে সাইকেল নিয়ে পাড়ার একটি ছেলে যাচ্ছিলো প্রতুলবাবুকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে লোকজনকে খবর দিলো। প্রতুলবাবুর এক দুঃসম্পর্কের শরিক ওনাকে তার নিজের বাড়ি নিয়ে এলো খবরটা পেয়েই।  মাঝরাতে ঘুমভেঙে আবার সেই মিষ্টি গন্ধটা পেলেন প্রতুলবাবু এবার দেখলেন ঘর জুড়ে এক অস্পষ্ট ছায়া ক্রমে একটা মুখের আকার নিচ্ছে, গন্ধটা গাঢ় হতে হতে সেই ছায়ামূর্তি সামনে এগিয়ে এলো প্রতুলবাবু  ভয়ে জ্ঞান হারালেন।
পরদিন সকালে সবাই দেখলো প্রতুলবাবু এই অসুস্থ শরীরে নিজের বাড়ি ফিরে গেছেন শুধু ফিরেই যাননি ছাদের এক কোনে শুয়ে আছেন।
সেদিন বিকেল থেকে প্রতুলবাবুর কথা বন্ধ হলো, ভয় পেয়ে প্রতুলবাবুর শহরের বাড়িতে খবর  দিলেন ওনাদের শরিক।




কবিতা / ক্ষমা কোরো / পিনাকী দত্ত গুপ্ত






আজ এই বিদায়ের দিনে, রোমন্থনের ভরা আশ্বিনে,
যদি কিছু ফেলে যাই, যদি পিছনে তাকাই...
ক্ষমা কোরো। ক্ষমা কোরো।

শিউলি ঝরার রাতে যদি, ভুল করে ফুল তুলে রাখি...
যদি অবেলার পথে পিছু ডাকি...
ক্ষমা কোরো। ক্ষমা কোরো।

কুয়াশার আভরণে স্বত্বহীন যদি কিছু ভুলে যেতে চাই,
যদি অসমর্থিত কিছু ভালোবাসা পাই...
ক্ষমা কোরো। ক্ষমা কোরো।

বিসর্জনের ঢাক বেজে গেছে। যদিও বর্ষা খরতর...
পথের দুপাশে চেনা মাটি, চেনা গন্ধ, চেনা সঙ্কেত;
অনাবশ্যক স্মৃতি, দুটি পা জড়িয়ে কেন ধরো?
রেখে গেছি কিছু শব্দ, জেনো আজ আমি অনিকেত...
তবুও হেমন্ত এলে জ্বেলে রেখো আকাশ প্রদীপ!
অস্পষ্ট ছায়ালোকে যেন পথ চিনে নিতে পারি;
যে পথের শেষে খুঁজে পাবো এক পারিজাত দ্বীপ,
যে দ্বীপে নির্দ্বিধায় তুমি হ’তে পারো এক নারী...

হয়ত এমন কিছু ঘটবেনা, দীর্ঘশ্বাসে বুক ভোরো;
অনুষ্টুপের মতো বলে যাই – ‘ক্ষমা কোরো’!



কবিতা / বৃষ্টি / গৌতম সেন



জলের ধারা মেঘের দলে
ঝরলে তখন বৃষ্টি -
আকাশ কালো ওড়না ওড়ে,
তোমায় দেখতে কত মিষ্টি।

ভিজলে পরে সবুজ পাতা
হিংসে বড় হয় -
আমায় এসে ভেজাও না তো,
তুমি এমনই নির্দয়?

তোমায় নিয়ে জলকেলিতে
ধরার মাটি মত্ত -
নিজের ক’রে তোমায় পেতে
আমার তরে শর্ত!

আমিই হব সবুজ পাতা
আমিই ধরার মাটি-                  
ভিজব যখন তোমায় মেখে
বুঝবে আমিও খাঁটি ।

বৃষ্টিজলের বৃষ্টি রে তুই
শ্যামল মাটির কন্যে,
সবুজ পাতার আঁচল ভাসা
তোর মন আর কতকাল
করবে আমায় হন্যে?




শিরোনাম : দুর্ঘটনা ? / দূর্বা মিত্র


ইন্সপেক্টর সৌমাভ সান্যাল হাতের ফাইল থেকে চোখ তুলে জানলার বাইরে কাঠচাঁঁপা গাছটার দিকে তাকায় | নাহ - হিসেবে কোথাও গরমিল আছে | অংকের ছাত্র সৌমাভ সন্তুষ্ট হতে পারছে না ।ফাইল এর বর্ণনা অনুযায়ী সহজ সরল "দুর্ঘটনা" নামক উপসংহার এ সই করতে ও পারছে না |

সুনীল সরকার মানুষটি খুচরো গুঁড়ো মশলার ব্যবসায়ী, অবিবাহিত, হিসেবী, অনাড়ম্বর জীবন যাপন এ অভ্যস্ত | তিনতলার উপর থেকে পড়ে গিয়ে মাথা ও মেরুদন্ড ভেঙে মৃত্যু হয়েছে । পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট সহ ফাইল এসেছে সৌমাভর টেবিল এ - সই করে কেস ক্লোস করে দিলেই হলো |

সেখানেই সৌমাভ কোথাও হোঁচট খাচ্ছে | লোকটার চরিত্র ও জীবন যাত্রার সাথে শেষ দশ মিনিটের হিসেবে আকাশ পাতাল তফাৎ |

তিনতলার যে ঘরে থাকতো - সেটা তে তিনটে দরজা - দুটো জানলা | করিডোর দিয়ে ঘরে ঢুকলে ঘরের মাঝখানেএকটা সেকেলে খাটপার হয়ে যে দেওয়াল - তাতে দুটো জানলা | একটার সামনে একজোড়া টেবিল চেয়ার , আরেকটা জানলার পাশে একটাস্টিলের আলমারি | ব্যাস - আর কোনো আসবাব নেই | অন্য দুটি দেয়ালে দুটি দরজা | বাঁঁ দিকের দরজাটা বাথরুম |
ডানদিকের দরজাটা ই গোলমালের মূল সূত্র |

মাস ছয়েক আগেও ওই  ডানদিকের দেয়াল ঘেঁষে খাট থাকতো | ছাদে যেতে তিনটে তালা খুলতে হয় বলে সুনীল বাবুওই দেওয়াল কেটে একটা দরজা আর একটা ছোট ব্যালকনি বানিয়ে নেন | মাস তিনেক খুব খুশি ছিলেন - ওখানে বসেই চা খাওয়া,কাগজ পড়া,দাড়ি কামানো - সব করতেন |

হঠাৎ কর্পোরেশন থেকে নোটিশ আসে - ওই বারান্দা বেআইনী - ভেঙে ফেলতে হবে | সুনীল বাবু তাই করলেন | শুধু দরজা সরিয়ে দেওয়াল গেঁথে দেয়া বাকি ছিল |

জানলা খোলা থাকতো - সেদিকেই মাথা করে শুতেন |

রাতে একবার বাথরুম যেতেন - খাট থেকে নেমে ডান দিকের দরজা |

বাঁ দিকে কোনোদিন যান নি - দরজা খুললেই সোজা নিচের চাতাল এ পতন |

"দুর্ঘটনা" সেভাবেই ঘটলো | বাথরুমের দরজা ভেবে বাঁদিকের দরজা খুলে পা বাড়ালেন মৃত্যুর দিকে |

এইখানেই সমীকরণে ধাক্কা খাচ্ছে সৌমাভ | যে মানুষ কোনোদিন বাথরুম যেতে বাঁদিকের দরজা খোলেন না -- ওই রাতে কেন খুললেন ? আত্মহত্যা ? কোনো কারণ দেখা যাচ্ছে না ৬৭ বছর বয়েসী মানুষটার ফাইল এ |

সৌমাভ বেল বাজিয়ে জীপ্ বার করতে বলে নিজেই একবার বাথরুম যায় | তারপর ফাইল আর দুই সহকারী নিয়ে রওনা দেয় অকুস্থলের দিকে |

তিনতলার ঘরে ঢুকে ফাইল এ রাখা ফটোগুলির সাথে মিলিয়ে দেখতে থাকে সব কিছু | সহকারী দুজন টেবিল আর আলমারি দেখে নেয় | খাট টা একটু দেখে সৌমাভ | ভুরু কুঁচকে তাকায় মাথার আর পায়ের দিকের কারুকাজ করা রেলিং এর দিকে | উঁচু দিকটামাথা - নিচু দিকটা পা | সেটা জানালার দিকে ! বুট সমেত শুয়ে পড়ে বালিশে মাথা দিয়ে -- হাত দুটো লম্বা করে দুপাশে ছড়ায়ে তর্জনী উঁচু করে |

লাফ মেরে উঠে এক সহকারীকে বলে সব জানলা দরজা খুলে দিয়ে ঠিক ওর মতো করে শুয়ে পড়তে  - আরেকজন কে বলে দোতলা থেকে সুনীলবাবুর গোমস্তা সহদেব কে সপরিবারে ওপরে আসতে | মোবাইল এ খবর পাঠায়ে থানা থেকে মহিলা পুলিশ সহ আরো ফোর্স পাঠাতে |

দোতলায় সহদেব থাকে তার দুই ছেলে, স্ত্রী ও বড়ো ছেলের বৌকে নিয়ে | এক তলায় থাকে এক ঠাকুর ও এক চাকর - সেই পড়ে যাবার আওয়াজ শুনে বাইরে গিয়ে মৃতদেহ দেখে থানায় ফোন করে |

সিঁড়ির সব তলাতেই গ্রিলের গেট - রাতে তালা পড়ে - চাবি সহদেবের কাছে থাকে |
সহদেবরা বলেছে তারা কিছু শোনেনি, দেখেনি, কিছুই জানে না | পুলিশ যা বলেছে - তাই জানে যে দুর্ঘটনায় মৃত্যু |

তারা উপরে এসে দেখে সৌমাভ টর্চ নিয়ে খাটের তলায় উপুড় হয়ে প্রত্যেকটা পায়া দেখছে - একটি কনস্টেবল খাটে দু হাত ছড়িয়ে শুয়ে আছে | আরেকজন করিডোর এর দরজায় - হাত কোমরের পিস্তলে |

সৌমাভ উঠে দাঁড়ায় | সহদেবের বৌমাকে জিজ্ঞেস করে,"হাতে পিঠে খুব ব্যথা - তাই না ?"
মেয়েটি ঘাড় নেড়ে হাঁ বলেই চমকে আর সবার দিকে তাকায় -- সবার চোখে রাগ দেখে মাথা নিচু করে |

সৌমাভ হেসে ফেলে | সহদেব কে  বলে, " যে মানুষটা এতবছর ডান দিকের দরজা খুলে বাথরুম গেলো - সে হঠাৎ বা দিকের  দরজাটা বারান্দা জেনেও খুলবে কেন ? রোজ সকালে স্নানের পরে আলমারির
মাথায় রাখা লক্ষ্মী - গণেশ কে যে  পুজো দেয় -- সে হঠাৎ সেদিকে পা দিয়ে শোবে কেন ? জবাব দিন সহদেব বাবু !"

পাঁচ  জন নিশ্চুপ | থানা থেকে আসা মহিলা পুলিশ আর বাকি সহকারীদের সৌমাভ বলে ঘিড়ে দাঁড়াতে | সহদেবের দিকে ঘুরে বলে, "চলুন - বাকি কথা থানায় হবে |"

পাঁচ জন এবার আর্তনাদ করে ওঠে | সৌমাভ এক ধমক দেয়, " সে রাতে সুনীল বাবু ঘুমোনোর পরে পাঁচজন  এসে ওনার খাটের চারটে পায়া ধরে পুরো উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেন - মহিলারা দুজন একটা পায়া তুলেছিলেন - তাও ব্যথা করছে বৌমার পিঠে | পায়াগুলো এতবছর একভাবে থাকাতে যে দাগ পড়েছিল - ঘুরিয়ে দেওয়াতে দাগে দাগ মেলেনি |

 যে এখন শুয়ে আছে - তার ডান হাত ভাঙা দরজার দিকে - বা হাত বাথরুমের দিকে - পা ঠাকুরের আসনের দিকে | সেই রাতে সুনীলবাবু অভ্যেস মতো ডান দিকেই গেছিলেন | আপনারা ওনার সম্পত্তি আর ব্যবসার লোভেই "দুর্ঘটনা" ঘটার ব্যবস্থা করেন | চলুন - বাকি কথা থানায় হবে |"



রম্য রচনা / পুজো পরিক্রমা- সময়ের উল্টোরথে / -অরুণ চট্টোপাধ্যায়


রাত তখন দশটা। আমার দু’চাকাটা ঘড় ঘড় করে যাত্রার সূচনা করল। তারপর ফার্স্ট গিয়ার, সেকেন্ড গিয়ার থার্ড গিয়ারে ভর করে যেই চড়তে যাবে গতির পাহাড়ে অমনি এক রামধাক্কা। গলাধাক্কার থেকেও প্রবল এ ধাক্কার নাম প্রতিমা দর্শনার্থী। পুরীর সমুদ্রে যখন ঢেউয়ের পরে ঢেউ আসতে থাকে তখন মাথা উঁচিয়ে থেকেছেন কি? যিনি থেকেছেন তিনি ক্রমশ চলে যাচ্ছেন সমুদ্রগর্ভে অর্থাৎ বেলাভূমি থেকে অনেক দূরে। আমারও অবস্থা খানিকটা তেমনই। সেই মহাভীড়ের ভয়ে ভীত আমার দ্বিচক্রযান তার ইঞ্জিনকে পৌঁছে দিয়েছে থার্ড গিয়ার থেকে আবার ফার্স্ট গিয়ারে। আমার বাঁ পা যথারীতি মাথা নত করেছে মাটিতে।   
ক্লাচকে অতি কষ্টে চেপে ধরে অ্যাকসিলারেটর ঘোরাচ্ছি সন্তর্পণে। মাঝে মাঝে পেছন ফিরে দেখছি খানিকটা গরুচোরের মত। কিন্তু ব্যাকগিয়ারেও (যদিও এটা কোনও দু’চাকার গাড়িতে থাকে না।) নো এন্ট্রি। ভীড় এসে ট্র্যাফিক পুলিশের ভূমিকায় অবতীর্ণ।
পুজো প্যান্ডেলকে বাঁ হাতে পাশ কাটিয়ে ডানদিকের রাস্তা ধরেছি নিরূপদ্রব পরিভ্রমণের উদ্দেশ্যে। এখানে নেই আলোর উজ্জ্বলতা। কিন্তু সেই আধা-অন্ধকারে কলকাকলির কমতি নেই। আলোআঁধারির এই লুকোচুরিতে অভাব নেই হাস্যপরিহাসের। অভাব নেই যথেষ্ট রস নিনিময়েরও। আমার দু’চাকার গিয়ার সেকেন্ড হয়েই রইল থার্ড আর হতে পারল না।
গলি থেকে রাজপথ—কোনরকমে তো এসেছি। রাজপথে পা দিয়ে মাথা ঘুরছে বনবন করে। কোথায় পা রাখব আমি মানে আমার চাকা? কালো পিচের বদলে শুধুই কালো মাথা। এ সময় উপগ্রহ থেকে তোলা কোনও ভিডিও চিত্র দেখলে মনে হবে অসংখ্য কালির ফোঁটা বুঝি নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে।
ক্লাচের চাপুনিতে আমার গাড়ি রুদ্ধশ্বাসে ফুঁসছে। দুই থেকে এক নম্বরে আবার হয়েছে গিয়ারের অধঃপতন। পা ছুঁয়েছে মাটিকে (মাঝে মাঝে আবার চলতি মানুষের বিছোন পায়ের পাতার কার্পেটে। নিখঞ্জ আমি খোঁড়াতে খোঁড়াতে কেমন ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে চলেছি। আমার গাড়ির হর্ণের তারস্বর সম্মিলিত কোলাহলে ঢাকা পড়ে গেল। পদযাত্রিদের সতর্ক করার প্রয়াসে আমিই সর্বদা সতর্ক আর ভয়ে কাঠ হয়ে রইলাম। গাড়ি চালানোর মহাসুখ আমি টের পেলাম হাড়ে হাড়ে।  
নদীর স্রোতের মত ভিড় এগিয়ে চলেছে। রাস্তায় আলোর বিশেষ সমারোহ নেই। মাথার ওপর অদূর আকাশে বিছোন মিড়মিড়ে মিনিয়েচারের তারকামন্ডলী আর মাটির নিচে তার অস্পষ্ট কম্পিত ছায়া। এটাই নাকি এ যুগের ফ্যাসান। ভীড়ের ঘনত্ব এখানে তুলনায় অনেক কম। ছায়াছায়া সেই ভাবগম্ভীর পরিবেশে টুকরো টাকরা কথা। কেমন যেন আধি দৈবিক পরিবেশ।
কত গলি কত রাস্তা। আগে দেখিনি। কিংবা দেখেছি হয়ত খেয়াল করিনি। কিংবা খেয়াল করেছি মনে রাখিনি। দূরে প্যান্ডেল দেখা যাচ্ছে। না প্যান্ডেল নয়। এ তো একটা বিয়ে বাড়ি। বিশাল আলোকমালায় সজ্জিত এক প্রজাপতি। সানাই বাজছে। আশ্বিন মাসে বিয়ে হয় কিনা ভাবতে ভাবতেই আর এক বাধা। এখান থেকে শুরু হল ডিভাইডার। পথ মেপে দিল দড়ির বন্ধন গ্রন্থি। প্রবেশেচ্ছু আর নির্গমোনেচ্ছুদের আলাদা পথ। গাড়ি এখানে রেখে হয়ত সিকি কিলোমিটার হাঁটতে হবে।
ফিরে এসে আবার চলা (মানে গড়ানো আর কি)। কতদূর গেছি আর কত ঠাকুর দেখেছি মনে নেই। কেননা ভাবে হঠাৎ বিভোর হয়েছি আমি। অতি আধুনিকতার মাঝে অতিপ্রাচীনতাও আমাকে আবিষ্ট করে রেখেছে। হঠাৎ সোমনাথের মন্দির আমার সামনে। পুলকিত আমি মুহূর্তে অনুভব করি আমার সামান্য দু’চাকায় গুজরাট ভ্রমণ করছি আমি। তার মানে আমার সামনে একঝাঁক রিপোর্টার আর ক্যামেরা পার্সন। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে হাত-পা-মুখ নেড়ে আমি ব্যক্ত করছি আমার সুদীর্ঘ কষ্টকর ভ্রমণ কাহিনী। এই বয়েসে আমি সেলিব্রিটি হয়ে গেছি। আর আমাকে পায় কে।
--প্যান্ডেলটা দারুণ তাই না? মনেই হয় না এটা একটা প্যান্ডেল। আহা কি দারুণ টেকনিক!
কে যেন বলল পাশ থেকে। আর হয়ত আমার নীরবতাকে তার মতের সমর্থক ধরে নিয়ে চলে গেল আর সময় নষ্ট না করে। চলে গেল আমাকে পেছনে ফেলে। কারণ মুগ্ধতার রেশ তখনও কাটে নি আমার।
সত্যি তো। গুজরাটে নয় আমি রয়েছি এই বাংলাতেই। আর হুঁকোমুকো হ্যাংলার মতই অবাক বিস্ময়ে চোখ আমার ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। তারপর এক এক করে কোথাও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কোথাও অজন্তা ইলোরার গুহা আবার কোথাও খাজুরাহো খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চোখের সামনে থিমের পর্দায়। ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, স্থাপত্য, ভাস্কর্য সব কিছু যেন নিপুণ মোড়কে উপস্থাপিত। নকল যে আসলকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে এটা যেন আবার একবার উপলব্ধ হল।
থিমের এই আশ্চর্য মলম দু’চোখে মেখে আমার দু’চাকার রথ ভীড়ের মধ্যে দিয়ে শ্লথ গতিতে। হঠাৎ একটা বিশাল ঝাঁকুনি দিল গাড়িটা তারপর আবার চলতে লাগল। এই ঝাঁকুনিটা অবশ্যই ছিল থিমের এই জগৎ ছেড়ে অন্য কোনও জগতে যাওয়ার গিয়ার পরিবর্তনের ঝাঁকুনি।
বিশাল বিশাল প্যান্ডেল যেন আকাশকে ছোঁয়ার পাল্লায় নেমেছে। বিরাট বিরাট গেট। আধ কিলোমিটার জুড়ে আলোকের কেরামতি। রামরাবণের যুদ্ধ থেকে কারগিল যুদ্ধ কি নেই? যেন জেনারেল নলেজের সচিত্র প্রদর্শনী। প্যান্ডেলের গেটে পর্দা ঝোলান। মা এখানে পর্দানশিন। গেটের বাইরে আধ মাইল জুড়ে দর্শনার্থীদের সাগ্রহ সারিবদ্ধ অপেক্ষা। কচ্ছপকে লজ্জা দিয়ে এগিয়ে চলেছে সে লাইন। মনের মাঝে অচেনা পর্দাখানা কিন্তু উঠে গেল সহসা। আরে এ তো আমার চেনা চেনা যেন। হ্যাঁ আমার গাড়ির ঝাঁকুনি-গিয়ার আমাকে প্রায় দেড় দশকের বেশি পিছিয়ে দিয়েছে। স্মৃতির ডায়রিখানার পাতা কে যেন উলটে উলটে জানিয়ে দিল এটা ঠিক।  
আলো আলো আর আলো। প্যান্ডেলের বিশালতা আর বিস্ময়ভরা বৈচিত্র। এসব ছাড়িয়ে আমার গাড়ি আবার ঝাঁকুনি দিয়ে এগিয়ে (পড়ুন পিছিয়ে) চলেছে। ভীড় যেন বেশ একটু কমে গেছে। প্যান্ডেল যেন নয় আর বাক্সবন্দীও। মা এখানে বেশ খোলামেলা আবহে আছেন। আলোর তান্ডব বেশ একটু কম। প্যান্ডেলগুলোও আকারে আর উচ্চতায় বেশ একটু ছোট। মাইকে তারস্বরে বাজছে হিন্দিগান। ছেলেমেয়ে সব সে তালে মেতেছে। মেয়েদের থেকে ছেলেরাই সংখ্যায় অনেক বেশি। প্রতিমার মুখগুলিও যেন চেনা চেনা লাগছে। মনের চোখে ভেসে ওঠে কত বলিউডি দৃশ্য।
গাড়িতে আবার একটা ঝাঁকুনি। কারা যেন সমস্বরে বলাবলি করছে, ব্যাকগিয়ার! ব্যাকগিয়ার!!
আমার গাড়ির ঝাঁকুনি-গিয়ার আমাকে আবার নিয়ে গেল গত শতকের সাত দশকের এপার ওপার। প্যান্ডেলে ভীড় তখনকার হিসেবে গাদা হলেও এখনকার হিসেবে তেমন কিছুই নয়। ডিজে দূরে থাক, বক্স পড়ে থাক—চোঙা মাইকে আধুনিক গান বাজছে। লতা, আশা, সন্ধ্যা, হেমন্ত, মান্না, শ্যামল, পিন্টু, তালাদ, কিশোর, আরতি, বনশ্রী, পান্নালাল, ধনঞ্জয়, পঙ্কজ, আরতি আরও আরও কত। কখনও মাইকে বাজছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের দরদী-ভরাট গলায় মহালয়ার চন্ডীপাঠ। তখন মহালয়ার ভোর থেকেই বাতাসে শিউলি, পদ্ম, শালুকের সঙ্গেই শুভ্র শারদীয়ার পুজো পুজো গন্ধ ভেসে বেড়াত।  
প্যান্ডেল ধূপ আর ধুনোর গন্ধে আমোদিত উৎফুল্ল। সোনাগলা রোদ্দুরটা কড়া হলেও মানুষ সইয়ে নিচ্ছে দিব্বি। কেননা শরৎ এসেছে, শারদীয়া হেসেছে। ঢাকের ডাক যেন মনের মধ্যে ছড়িয়ে দিত অদ্ভুত এক মাদকতা।  
সারা বছর যে সব জামাকাপড়ের দোকান মাছি খুঁজে খুঁজে হন্যে হয়ে বেড়াত মারার জন্যে তারাই এখন গায়ে মশা বসলেও মারার সময় পাচ্ছে না। তখনও মাল্টি ন্যাশন্যাল হয় নি। প্রাইভেট সেক্টর বলে কোনও শব্দ আছে কিনা সে সব নিয়ে সাধারণ মানুষ মাথা ঘামাত না। ছেলেমায়েদের সারা বছরের জামাকাপড় হত এই সময়। তাও বছরে দুই বা তিনটির বেশি নয়। সেই নিয়েই উদবাহু হত। বাড়ি বাড়ি সবাই ঘুরে ঘুরে পুজোর জামাকাপড় দেখতে বেরোত। উৎসবের আগে সেও ছিল এক আকর্ষণীয় মহা উৎসব। নস্টালজিয়া শব্দটি তখনও কিছু প্রোথিতযশা সাহিত্যিকের কলমে আটকে ছিল। প্রবেশ করে নি সাধারণ্যে। প্রবেশ করার দরকার হয় নি। তখন পৃথিবীর ঘূর্ণন বেগ এখনকার মত প্রচন্ড ছিল না। জগৎ পাল্টাত খুব ঢিমেলয়ে।
তারপরে এক কান্ড। আবার এক প্রকান্ড ঝাঁকুনি। গাড়ি কোথায়? আমি শুয়ে আছি বাড়িতে। পাশে আমার মা। ঘুম ভেঙ্গেছে ‘দুর্গা মাইকি’ এই আনন্দ উচ্ছ্বল চিৎকারে। আমরা সবাই উঠে পড়েছি। এই পঞ্চমীর রাত আমাদের যেন এক মহা জাগরণের রাত। ঘড়িতে তখন রাত দেড়টা পৌনে দুটো। হুড়মুড় করে সবাই সেই গভীর রাতেও বাইরে। ল্যাম্প পোস্টের অল্প আলোয় লড়িটা এগিয়ে আসছে ঢিমেতালে পিঠে প্রতিমা নিয়ে। লড়ির পিঠে ঠাকুর নয় যেন একটি গোটা বাঙালি পরিবার। মধ্যরাত থেকে তিনটে চারটের মধ্যে পাড়ার রাস্তা দিয়ে পিঠে মাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া লড়ির দল। এ পাড়া ওপাড়া সেপাড়া। এরা শুধু প্রতিমাই বয় না। বয়ে নিয়ে আসে আসন্ন শারদীয় আনন্দকেও।
প্রতিমা দেখার পর আমরা শুয়ে পড়েছি। গুরুজনের ভ্রূকুটির ধার এখন একটু কম। হাই এসেছে গন্ডায় গন্ডায় কিন্তু ঘুম আসে নি। মা বলল, দেখতে দেখতে পঞ্চমী এসে গেল। মনে হচ্ছে যেন এই তো সেদিন পুজো গেল।
বোন বলল, পঞ্চমী কি গো মা। মহালয়ার ভোর থেকেই তো পুজো লেগে গেল। ওঃ এই চারপাঁচ দিন যে কিভাবে কাটিয়েছি। শুধু ভেবেছি পঞ্চমী কবে আসবে। এই রাতে ঠাকুর দেখতে খুব মজা তাই না ভাই?
পঞ্চমীর সেই রাতটা কি আর ঘুমোতে পেরেছি? কখন যে ষষ্ঠীর সকালটা আসবে। কনমতে মুখটা ধুয়েই ছুটতে হবে প্যান্ডেলে। চা খাবার সময় পর্যন্ত থাকবে না। প্রতিমা কেমন হল দেখতে হবে। অসুরের মাসল গুলো কত ফুলো কিংবা সিংহের হাঁ টা কত বড় তা দেখার প্রবল বাসনা আমাদের। সরস্বতীর হাঁস কিংবা গনেশের ইঁদুর ঠিক দিয়েছে তো? মা লক্ষ্মীর প্যাঁচা বা কার্তিকের ময়ূর? সে পেখম ছড়িয়েছে বেশ। আমাদের কৌতূহলী কল্পনার সঙ্গে বাস্তবটাকে মিলিয়ে নিতে হবে তো?
এখনও প্রতিমা অসজ্জিতা। অস্ত্র আর গয়না বা অন্য সাজ পরান হবে আজ রাত্রে। এ ক’দিন আর বই খোলা নয়। আমাদের মাত্রাছাড়া পরিশ্রমের মধ্যে তাদের কিছু বিশ্রাম। এসে গেল সপ্তমী। কলাবৌকে কেমন দেখতে লাগছে দেখ পেট মোটা গনেশের পাশে। লাল শাড়ির ঘোমটা দেওয়া কলাবৌ। বাজছে ঢাক, বাতাসে উড়ছে ধূপ ধুনোর গন্ধ, ঢাকের আওয়াজ আর পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণের গমগমে আওয়াজ।
সপ্তমী থেকে আবার প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে পুজো দর্শন। তখন গাড়িতে করে প্রতিমা দর্শন ছিল এক দুঃস্বপ্ন। গাড়ি বলতে তখন বোঝাত রিক্সাকেই। মোটর গাড়ি যাদের থাকত তাঁদের সংখ্যা ছিল তা হিসেব করার জন্য জোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের কোনও দরকার ছিল না। একমাত্র খুব অসুস্থ বা ধনীদেরই রিক্সায় চেপে ঠাকুর দেখতে দেখেছি। তাদের সেই ঠাকুর দর্শনও ছিল আমাদের অবাক-দর্শনের তালিকাতেই। হেঁটে হেঁটে পা ব্যথা হয়ে গেলেও ঠাকুর দেখার আনন্দ কিছুতেই ম্লান হয়ে যেত না।
সপ্তমীর সন্ধ্যায় হত আবৃত্তি প্রতিযোগিতা। অষ্টমীতে অন্ন চলবে না। লুচি, বেগুনভাজা, কুমড়োর ছক্কা আর সুজির হালুয়া। অষ্টমীর সন্ধিপুজো ছিল দেখার মত। রাত আড়াইটের সময় হুড়মুড় করে উঠে পড়েছি। আশ্চর্য! এত রাতেও পুজো দেখতে এত ভীড়! সেই ভীড়ের মধ্যে কোনও রকমে মাথা গলিয়ে দিয়েছি আর দেখছি এক মহা বিস্ময়কে। একশ আটটা প্রদীপ জ্বেলে সন্ধি পুজো হচ্ছে। পরে জেনেছি এই সময়টা হচ্ছে অষ্টমী আর নবমীর মহা সন্ধিক্ষণ। অষ্টমী যাচ্ছে আর নবমী আসছে। তাই নবমীতে বড় মন খারাপ হয়ে যেত। পুজোর শেষ।
দশমীর দিনটা হল দুঃখ আর আনন্দের এক সহাবস্থান। উৎসবের শেষ এই কারণে দুঃখ আবার এইদিন সবাই একসঙ্গে মিলিত হবে সেই কারণে বড় আনন্দের। এইদিন হল মিলনের দিন। (বর্তমানে হয়ত ডিজে বাজিয়ে অন্যের হার্ট আর কান ফুটো করার দিন)। এদিন মাংস খেতে হয়। তখন মুরগীর মাংসের চল তেমন ছিল না। আর ব্রাহ্মণদের তো নাম করা বা মনে আনাটাই ছিল গর্হিত কাজ। সেই হিসেবে মুরগী আমাদের বাড়িতে কোনদিন আসত না। এমন কি রেস্টুরেন্টেও বিশেষ সহজলভ্য ছিল না।
বিকেল থেকে শুরু হত আমাদের এক মহা অভিযান। এর দুটো অংশ ছিল। একটা হল যারা আসবেন আমাদের বাড়িতে প্রণাম করতে বড়দের বা সমবয়সীদের সঙ্গে কোলাকুলি করতে তাদের অভ্যর্থনা করা। আর দ্বিতীয়টা হল পাড়ায় আমাদের থেকে বয়স্কদের বাড়ি গিয়ে তাদের প্রণাম করা। এই কাজ খুব ভাল লাগত আমাদের। অধিকাংশ বাড়িতেই মিষ্টি তৈরি হত। নারকোলের ছাপা, নাড়ু। দোকানে হত বড় বড় গজা, মিহিদানা আর বোঁদে। আর হত সুন্দর ঘুঘনি। একটানা মিষ্টির মরুভূমিতে এটাই ছিল স্নিগ্ধ এক মরূদ্যান।
রাত বোধহয় ভোর হয়ে এল। ফেরার সময় দেখা সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে। যাবার সময় যিনি বলেছিলেন, একটু ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন? শরীর টরির----
--হ্যাঁ, এলার্জিক ব্রংকাইটিস তো। শ্বাস যে বশে থাকে না আমার সব সময়।
ফেরার সময় তিনি বললেন, আপনাকে এখন বেশ চাংগা লাগছে। ঠাকুর দেখার একটা গুণ আছে কি বলেন?
--ঠাকুর দেখা নয়। একটা অপারেশন হল যে। আর তাতেই—
--অপারেশন! কি অপারেশন? কোথায়? লাঙে নাকি মশায়? খুব চিন্তিত সে ভদ্রলোক।
--লাঙে নয় লঙে। আশ্বস্ত করে আমি হাসতে হাসতে বলি, অপারেশন টাইম মেশিন। বোধহয় অন্তত অর্ধশতক পিছিয়ে গিয়েছিলাম। পৌঁছে গিয়েছিলাম আমার ছেলেবেলায়।
--টু হুইলারে ব্যাক গিয়ার পেলেন কোথায় দাদা? ভদ্রলোক হাসলেন। খুব রসিক কিনা।
--মনের ইঞ্জিনে সব থাকে মশাই। স্মৃতির পেট্রল ঢেলে চলে যান না মাইলের পর মেইল। যতদূর খুশি। তবে পেছনে যেতে যেতে একসময় ভীষণ ধাক্কা খাবেন। অনেক কিছু হারিয়ে ফেলার বেদনার ধাক্কা হজম করা খুব কষ্টকর জানেন? অতএব—
--অতএব টপ গিয়ার জিন্দাবাদ ব্যাক গিয়ার মুর্দাবাদ। হো হো করে হেসে উঠলেন ভদ্রলোক। খুব অমায়িক আর রসিক কিনা।
আমি ফার্ষ্ট গিয়ার থেকে আবার টপ গিয়ারে। বাড়ি ফিরতে হবে তো? সূর্য উঠে পড়েছে। ও বেচারির তো কোনও ব্যাক গিয়ার নেই।    



কবিতা /প্রথম ফাগুন / অর্পিতা ভট্টাচার্য


 ও আমার কিশোরী বেলা,
 ও আমার সবুজ মন,
 কেন ওমন আঁচল টানিস?
 হয় যে মন উচাটন।
                                         
 মনের ওই আগুন টুকু
 থাকনা ছাইতে চাপা।
 উড়িয়ে স্মৃতির ধুলো,
 কেন শুধু কষ্ট মাপা ?

 দিব্যি কাটছে জীবন,
জীবনের সত্যি ছুঁয়ে।
 তবে কি, খুঁজে বেড়াস,
 ফেলে আসা সেই সময়ে ?

 অবুঝ ওই পাগল মনে
 কেন তুই সময় পুষিস ?
 নতুন এই স্মৃতির ভিড়ে,
 কাউকে কেন খুঁজিস?

 হারানো সময় যেমন ,
 যায়না ফিরিয়ে আনা,
 তেমনি কারও মাঝে,
 কাউকে খুঁজতে মানা।

 স্মৃতিকে খুঁজে না ফিরে,
 ও আমার অবুঝ মন,
 ধরে রাখ মনের ঘরে,
 তোর প্রিয় প্রথম ফাগুন।





কবিতা / আত্মহত্যা / সোমা দে



এক তরঙ্গায়িত সাপ খেলা করে অতিনির্জনে,
মস্তিষ্ক থেকে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে
পায়ের পাতায় বা আরো অনেক কিছুতে।
প্রতিলিপি লেখা হয় প্রতিদিন,
চোখ কখনও দেখে ; কখনও বা হৃদয়!
নিরুচ্চারে উড়ে যায় নীরব বসন্ত-
থেমে থাকে অনাবিল অপেক্ষা....
নীল নির্জনে জন্ম নেয় অনেক স্বপ্ন।
আর তারপর,
আস্ত একটি হৃদয়,
আত্মহত্যা করে প্রতিরাত্রে!

কবিতা / নতুন অধ্যায় /প্রজ্ঞা পারমিতা ভাওয়াল


এক ঝুড়ি বিষাদ নিয়ে বসলে  এসে গা এলিয়ে ,
যেন হৃদয় জুড়ে  খাচ্ছে  উঁই ;
এতো মেঘাচ্ছন্ন  মুখ বড্ডো বিরক্তিকর
আমার শাঁকচুন্নি হাসির আওয়াজে
আরো বিরক্তি ছেয়ে গেলো যেন।

বলি, হলোটা  কী ?
ক্ষতবিক্ষত? 
গড়ে দিলে কে ?  কি ভাবে?
বিষাদের, বিরক্তির ,অভিমানের ,দুঃখের আলপনা কখনো  হয় মনোরম।
ভালোবাসার মায়াপাশ কাটাও ;
ভুলচুকের কাহিনীগুলো বিসর্জন দেয়া যায়না?
ক্যারেক্টার এনালিসিস,মন এনালিসিস , মস্তিষ্কের চিন্তার এনালিসিস
ঊফফ চরম অসহ্য
উত্তাল সুনামি।
ধ্যাৎ।
ক্ষত কে পরিত্যক্ত করো  দক্ষতায়।
মনের  বিষাক্ত অসুখ সোজাসাপটা ভাবনার কোলাকুলিতে ভরিয়ে
ফোটাও  পারিজাত।
কণামাত্র কোঁদল নয়
চোখে  জ্বালা উঠুক ,বালিশ না ভেজে।
নিশ্চুপ থেকেই  উঠে দাঁড়ালে,
অপছন্দের হলো আমার বাচালতা। 
স্বপনের ঝড়, ছুঁড়ে ছেনে বিধস্ত তুমি ;
যেন পথটা গড়ে দিলে,
বাতলে দিলেই সা করে চলে যাবে, নতুন অধ্যায়ে ।


অনুগল্প / কংগ্রাচুলেশন / উৎসব দত্ত



প্রায় এক বছর আগে শুভর সাথে পায়েলের আলাপ চ্যাট করতে করতে সারা রাত কাটিয়ে দিত ওরা সকালে ঘুম থেকে উঠে আবার শুভর ইনবক্সে মেসেজ ভেসে উঠত "উঠে পড়ো ভীতুরাম" মাঝে মধ্যে দেখাও করতো ওরা রবিবার করে সপ্তাহের মাঝে ছুটি পেতনা যেহেতু ভার্চুয়াল সম্পর্কের টানাপোড়েনে ধীরে ধীরে চ্যাটের শব্দগুলো কমতে থাকল পায়েলের ভীতুরাম আর ইনসোমনিয়া  তে ভোগে না একটা মিথ্যে তার পেছনে আরও একটা মিথ্যে অথচ দুজনেই সব কিছু বোঝে শুধু সত্যি বলার সত সাহসটুকু কেউ দেখাতে পারছেনা প্রেম হওয়া আর প্রেম করার মধ্যে যে তফাত সেটা ধীরে ধীরে শুভ বুঝতে পারছিল পায়েলের আবদার গুলো মেটাতে না পারা কিম্বা ভার্চুয়াল শুভর সাথে রক্তমাংসের শুভর তফাত পায়েলকে হতাশ করছিল কিন্তু পায়েল এই নিয়ে কোনোদিন অভিযোগ করেনি বরং ভালবেসে মেনে নিতে শিখেছিল আজ সত্যিটা বলতেই হবে শুভ মনে মনে ঠিক করে রেখেছে পায়েলকে বন্ধু হিসেবে সারাজীবন পেতে চায় কিন্তু প্রেম আর সম্ভব নয় এটা শুনে পায়েলের কি রিএকশন হবে সেই ভাবতে ভাবতে শুভ বুঝল ওর মনের কোনে এখনও সামান্যতম একটি জায়গা পায়েলের জন্য রয়ে গ্যাছে জিন্সের সাথে কালো চশমায় পায়েলকে আজ যেন একটু বেশি সুন্দরী লাগছে শুভকে দেখেই পায়েল হেসে বলল অ্যাই জানো তো কাল আমায় দেখতে এসেছিল বাবার অফিসের কলিগের ছেলে, মুম্বাইতে একটা অ্যাড এজেন্সিতে চাকরি করে সামনের মাসে বিয়ের দিন ফাইনাল করে ফেলবে ওরা শুভ কি বলবে বুঝতে না পেরে বলল্‌,"বাহ কংগ্রাচুলেশান।“




সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া