Sunday, December 24, 2017

অনু গল্প / আকাঙ্খার দিনরাত্রি / অরুণ চট্টোপাধ্যায়


আনাজপাতি, মাছ, দুধ এসব দিয়ে চলে গেল জেসমিন। একটু পরে একটা বাড়ির ঠিকে কাজ আর একটা বাড়ি রান্নার কাজ সামলে আবার আসবে। অবাঙ্গালি এই মেয়েটি ভাল রাঁধে। তাই পাঁচ বছর ধরে রাঁধছে এখানে।
সেই ভয়াবহ প্লেন ক্র্যাশটা হওয়ার পর থেকে। আগুনে পুড়ে সব শেষ হয়ে গিয়েছিল। মহারাষ্ট্রের কাছাকাছি সাগরের বালুতটে হু হু করে বয়ে যাওয়া বাতাস বাড়িয়ে দিয়েছিল আগুনের শিখা। অর্ধেক যাত্রী পুড়ে মারা গিয়েছিল। সেই অর্ধেকের মধ্যে ছিল শুভময়।
বাকি অর্ধেক বিচময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল। কেউ কেউ বেঁচে যায়আর গড়াতে গড়াতে সাগরে পড়েছিল সে। সাগরের ঢেউ বেশ কিছুক্ষন তার দেহটা নিয়ে পাথরে পাথরে ঠোকাঠুকি খেলছিল। খেলার শেষে আকাঙ্ক্ষাকে উপহার দিয়েছিল একটা পঙ্গু জীবন। মেয়ের বাড়ি ওয়াশিংটন যাওয়ার বদলে হাসপাতাল থেকে মাল্টিপল ফ্রাকচার নিয়ে যাদবপুরের বাড়িতেই সাত মাস পরে ফিরতে হয়েছিল তাকে।
রান্না করতে করতে কথা বলা একটা বাতিক জেসমিনের। বাংলা বেশ ভালই জানে। দীর্ঘদিন বাংলায় থাকার ফল। ডালে ফোড়ন দিতে দিতে বলল, তোমার মেয়ে জামায়ের না দেশে ফিরে আসার কথা? কবে আসছে গো দিদি?
ফোড়নের ঝাঁঝ সহ্য হয় না আকাঙ্ক্ষার। কিন্তু যতটা কাশি হওয়ার কথা তার থেকে একটু বেশি কাশতে লাগল। জেসমিন সেদ্ধ ডালটা কড়ায় ঢালতে ঢালতে তার দিকে তাকাল একবার। তার চোখেমুখে একটা সন্দেহের ছায়া। আসলে অনেকদিন কাজ করছে বলেই আকাঙ্ক্ষার মনের একটু কাছাকাছি চলে এসেছে।
- মেয়ের কোনও খবর আসে নি দিদি?
উত্তরে আবার কাশল আকাঙ্ক্ষা। জেসমিন আর কথা বলল না। রান্না করে ঢাকাঢুকি দিয়ে বলল, সময় মত খাবারগুলো খেয়ে নিয়ো দিদি। এ কদিন দেখছি কিছুই তেমন খাচ্ছ না। সব ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছ। যতই ঢাকাঢুকি দিয়ে ফেলার চেষ্টা কর আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না।
একটু আগে বর্ণালি ফোন করেছিল আমেরিকা থেকে। ওদের ওখানে এখন রাত বারোটা। বলল, কেমন আছ মা?  
এ প্রশ্নের উত্তর ক্রমশ যেন হারিয়ে যেতে বসেছে তার কাছে। আগে বলত। এখন আর বলে না। এখন শুধু বলল, তোরা কেমন মা? কেমন আছে দিদিভাই?
- তোমার দিদিভাই এখন লেডি হয়ে উঠছে আস্তে আস্তে মা। বলে খিলখিল করে হাসল, ওরা সব এখন ঘুমোচ্ছে মা। আমিও চললাম। গুড নাইট।
ফোন কেটে গেল। অনেক কিছু বলার ছিল। অনেক কিছু জানার কথা। জামাই অভিষেকের কথা। ওদের এখানে আসার কথা। পাঁচবছরের চুক্তিতে ওরা স্টেটসে গেছে। চুক্তি শেষ হলে ওরা ইন্ডিয়াতে ফিরবে। বালিগঞ্জে একটা ভাল ফ্ল্যাট ওদের জন্যে পছন্দ করে রেখেছে সে। অবশ্য গিয়ে পছন্দ করা সম্ভব হয় নি। সারাক্ষণ হুইল চেয়ারে বসে থাকা আকাঙ্ক্ষার পক্ষে তা সম্ভব নয়। কিন্তু ওরা এম-এম-এস করে ফ্ল্যাটের একটা ভিডিয়ো পাঠিয়েছিল।  
জামাই ভাল হুইল চেয়ারের বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। ফিমার, টিবিয়া, আরও নানান জায়গায় অনেক অনেক ফ্রাকচার। কয়েকটা রিপেয়ার করা গেছে। কিন্তু বাকিগুলো নিয়ে ওর ভবিষ্যৎ এই হুইল চেয়ারেই নির্দিষ্ট হয়ে আছে।
কদিন আগে বর্ণালি বলেছিল, আর কটা দিন মা। ওর কন্ট্রাক্ট শেষ হয়ে যাবে মনে হয় আর কিছুদিনের মধ্যেই। তারপর আমরা ফিরে যাব। পরশু মনে হয় ফাইনাল খবর পাওয়া যাবে। আমি জানাব।
সেই পরশুটা হল আজ। সারারাত বিছানায় ছটফট করেছে। বালিশের নিচে থেকে মোবাইলের সেটিং ঘেটে দেখেছে ভুল করে সেটা মিউট হয়ে আছে কিনা।
ঠিক ছটা বেজে পঁয়ত্রিশ। মোবাইল বাজল।
- হ্যালো মা। গুড নিউজ।
মেয়ের কথা শোনার জন্যে উদগ্রীব হল আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু কলকল করে এবার বলে উঠল দিয়া। বর্ণালীর বর্ণিত সেই লেডি হয়ে আসাআকাঙ্খার আদরের দিদিভাই।
-- বাবার প্রমোশন হয়েছে দিদা। আমরা স্টেটস ছেড়ে চলে যাচ্ছি।
দিয়া আরও কত কি বলে যাচ্ছিল। আনন্দে কান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আকাঙ্ক্ষার। ফিরছে তার মেয়ে জামাই। একটু পরেই বালিগঞ্জের ফ্ল্যাট রেডি করার জন্যে কেয়ার টেকারকে ফোন করতে হবে।
- হ্যালো মা শুনছ? তোমার জামাইয়ের প্রমোশন হয়ে গেছে তো শুনলে। খুব খুশির খবর কি বল? আমরা জার্মানি চলে যাচ্ছি। মাত্র তিনবছরের জন্যে। যাই মা ও অফিস থেকে ফিরল। একটু কফি করে দিই।
এবার ওপার থেকে দিয়া বলল, গুড ইভিনিং গ্র্যান্ড মাম।
ইভিনিং? হ্যাঁ পৃথিবীর অপর প্রান্তে তো এখন উজ্জ্বল এক সন্ধ্যা বিরাজ করছে। বর্ণালিতে উজ্জ্বল এক স্বর্ণালি সন্ধ্যা। এপারটায় রয়ে গেছে এখনও ঘন রাতের গাঢ় অন্ধকার।  


1 comment:

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া