ঋভুর ছেলেবেলা কেটেছে দক্ষিন চব্বিশ পরগনার একটি গ্রামে। ওই অজ গ্রামে
বড়দিন বলে আলাদা করে তেমন কোন কিছুর উপস্থিতি থাকার কথা নয়। তবে এই
গ্রীষ্ম প্রধান দেশে ক্ষনস্থায়ী শীতকালের একটা আলাদা মাধুর্য্য অবশ্যই
আছে। এই সময়ে বাৎসরিক পরীক্ষা হয়ে গেছে, পড়ার কোন চাপ নেই, সারাদিন মাঠে
তিনটে কঞ্চি পুতে ক্যাম্বিস বলে ক্রিকেট খেলা আর খেলা। আর খেলতে খেলতে
নিজেরাই কমল ভট্টাচার্য্য কিম্বা অজয় বসুর কন্ঠ নকল করে সেই খেলার
ধারাবিবরনী দেয়া। আর আসেপাশে কার বাড়িতে পিঠে পুলি তৈরী হচ্ছে সে খবর
জোগাড় করে সুযোগ মত তাদের বাড়িতে ঢুকে যাওয়া।
সেইযুগে আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী হিন্দু পরিবারের মত বড়দিনে ঋভুদের
বাড়িতেও কেক খাওয়ার প্রচলন ছিল না। আর তখন ঐসব প্রত্যন্ত এলাকাতে
বিদ্যুতই ছিল না তাই এযুগের মত ঘরে ঘরে টুনি বাল্ব জ্বালিয়ে ক্রিস-মাস
ট্রি তৈরী করার তো কোন প্রশ্নই ছিলনা। তবে ওদের গ্রামের পাশেই মোয়ার জন্য
বিখ্যাত জয়নগর। বড়দিনে ওর বাবা মোয়া কিনে আনতেন। আর ঋভুকে প্রভু যিশুর
গল্প বলতেন।
বাবা বলতেন, মধ্য প্রাচ্যের এক দেশে একদিন রাজাকে কর দেওয়া ও নাম
লেখানোর জন্য হাজার হাজার মানুষ বেথেলহেমে্র পথে চলেছেন। মরিয়মকে গাধার
পিঠে বসিয়ে যোসেফও রওনা দেন সেই বেথেলহেমের পথে। পথেই মরিয়মের
গর্ভবেদনা ওঠে। রাজ্যের মানুষের ভিড়ে বেথেলহেমের কোনো সরাইখানায় জায়গা
হয় না তাঁদের। অবশেষে উপায়ন্তর না দেখে সন্তান জন্মদানের জন্য মরিয়মকে
এক গোয়ালঘরে ঠাঁই নিতে হয়। সেখানেই জন্ম দেন পুত্র যিশুকে। এভাবেই মহা
আশ্চর্যরূপে মা মরিয়মের কোলে খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বীদের মুক্তিদাতা প্রভু
যিশুর জন্ম হয়।
তবে ঋভুদের বাড়ি থেকে সামান্য দূরে আনন্দপুর নামের একটা জায়গায় একটা
চার্চ ছিল। ওই চার্চের পরিবেশটা ঋভুর খুব ভাল লাগতো। ভিতরে ঢুকলেই কেমন
ছবিতে দেখা বিদেশের কাউন্ট্রি সাইড বলে মনে হত। আসলে ঋভুর ঐ চার্চে
যাওয়ার আর একটা কারণও ছিল। খুব ছোটবেলা থেকেই ঋভুর পেন ফ্রেন্ড আর দেশ
বিদেশের ডাকটিকিট জমানোর সখ ছিল । ওই চার্চের ফাদার 'লয়েজ দেমসা'র তাকে
দেশ বিদেশের ডাকটিকিট দিতেন, আর -- কি ঋভু বাবু তুমি কেমন আছো ... বলে
বিদেশী টানে বাংলায় তার সঙ্গে কত কথা বলতেন। তবে ঋভুর সব চেয়ে ভাল লাগতো
কোন সুদুর যুগোশ্লাভিয়ার এক গ্রাম থেকে কি ভাবে এই সুন্দরবন এলাকায়
এসেছিলেন সেই গল্প শুনতে।
ঋভু অবাক হয়ে শুনতো সেসব কথা, আর বাড়ি গিয়ে মানচিত্র খুলে দেখত কোথায় সেই
পূর্ব ইউরোপের যুগোশ্লাভিয়া, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া আর হাজার হাজার মাইল
দূরে কোথায় এই ভারতের পশ্চিম বঙ্গের সুন্দর বন লাগোয়া এক অখ্যাত গ্রাম।
পৃথিবীতে এত দেশ থাকতে ফাদার কি করে আমেরিকা ইংল্যান্ড না গিয়ে এই অজ
গ্রামে এসে থেকে গেলেন সে কথা ভেবে ঋভু অবাক হয়ে যেত। ঋভু মাঝে মাঝে
খবরের কাগজে যুগোশ্লাভিয়া দেশটার নামও খুব দেখতে পেত। ঋভু তখন অতসব বুঝতো
না...... কি সব জোট নিরপেক্ষ না কি যেন! প্রেসিডেন্ট টিটো ইত্যাদি। ওর
খুব ইচ্ছে হত একদিন ঋভুও অন্তত জাহাজের খালাসির চাকরী নিয়েও
যুগোশ্লাভিয়ায় চলে যাবে।
চার্চের ফাদার 'লয়েজ দেমসার' যেমন ঋভুকে বিদেশি ডাক টিকিট দিতেন, বিদেশি
চকলেট খাওয়াতেন, তেমনই প্রভু যিশুর কথাও বলতেন। নিষ্পাপ ঋভু সরল মনে
ফাদারকে জিজ্ঞাসা করতো, তোমাদের যিশু যদি এ্তই ভাল তাহলে তার এমন
মর্মান্তিক মৃত্যু কেন?
একথা শুনে এতটুকু ক্ষুব্ধ হতেন না ফাদার, বলতেন, তোমাদের পরমহংসদেব যেমন
বলতেন, এই তোকে যেমন দেখছি, ঠিক তেমনি আমি ঈশ্বরকেও দেখতে পাই, তিনি যেমন
গিরিশ ঘোষকে বলেছিলেন -- দে আমাকে তোর সকল পাপের বকলমা দে......। ঠাকুর
যেমন সকলের পাপ কন্ঠে ধারণ করেছিলেন বলে তার সেই নীলকন্ঠ কর্কট
রোগাক্রান্ত হয়েছিল। ঠিক তেমনই প্রভু যীশু সকলের পাপ নিজের স্কন্ধে নিয়ে
ক্রুশ বিদ্ধ হয়েছিলেন।
ঋভু এমনিতেই প্রায় প্রতি সপ্তাহে ফাদারের সঙ্গে চার্চে দেখা করতে যেত।
কিন্তু প্রতিবছর ফাদার ঋভুকে বড়দিনের জন্য চার্চে বিশেষ ভাবে আমন্ত্রন
জানাতেন। খৃষ্টান না হয়েও ক্যারোলে যোগদান করত ঋভু। সবার সঙ্গে সমবেত
কন্ঠে ঋভুও গলা মেলাতো। ফাদার পিয়ানো বাজাতেন। ......"" স্বর্গের দুতেরা
জানালো বারতা রাখাল বালকদেরে/ জন্মিল শোন রাজাধিরাজ এক ক্ষুদ্র গোয়াল
ঘরে।""
সঙ্গীতের পর ফাদার, যীশুর বাণী এবং কার্য-কলাপ পাঠ করতেন, ঋভু সেসব বাণী
খুব মন দিয়ে শুনতো। প্রভু যীশু কিভাবে আর্তের সেবা করতেন, কি ভাবে তিনি
নিজ হাতে কুষ্ঠ রোগীর ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে দিতেন । এরপর যীশুর বিচারের
নামে প্রহসনের কথাও বলতেন।
বিচার শেষে যীশু একটি পাথরখন্ডের উপর বসলেন। স্বর্গীয় যুবকের বসার ধরনটি
অপূর্ব। পরনে দীর্ঘ শুভ্র বসন। ঈষৎ লালচে দীর্ঘ চুল। নীলাভ চোখ। মুখময়
ঈষৎ লালচে শ্মশ্রু । ভিড়ের উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে যিশু বললেন,
শক্রকে ভালোবেস। আর, ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবে অযাথা উৎকন্ঠিত হয়ো না। উপস্থিত
জনতার ভিড়ে গুঞ্জন উঠল। তারপর তাঁর জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি কাঁটা তারের
মুকুট পরিয়ে দেওয়া হ'ল তাকে। অতঃপর তিনি নিজের ক্রুশটিকে নিজেই কাঁধে করে
নিয়ে এলেন বধ্য ভুমিতে।
ক্রুশবিদ্ধ অবস্থাতেও তার মুখে কোন কষ্টের চিহ্ন নেই, তার মুখমন্ডল এক
স্বর্গীয় আনন্দে উদ্ভাসিত, আর তিনি বলে চলেছেন, ঈশ্বর তুমি এদের ক্ষমা
কোর। ক্রমশ বড়দিনের বিশেষ অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যেত।
তারপর ঋভুকে বলতেন, আজ তোমার মনের সকল অকথিত অপরাধ এবং প্রার্থনা প্রভু
যীশুর কাছে নিবেদন কর। প্রভু নিশ্চই তোমার সকল অপরাধ মার্জনা করে তোমাকে
নতুন জীবন দান করবেন। সেইযুগে বিদ্যুৎহীন চার্চের ভিতরে মোমবাতির আলোয় এক
স্বর্গীয় পরিবেশে ঋভুর মনে হত যীশু ক্রোড়ে মাতা মেরীর চক্ষু দুটি
অশ্রুসজল। হাতজোড় করে সেই স্বর্গীয় মুর্তির দিকে তাকাতেই তার নিজেরও
চক্ষুদুটি অশ্রুসজল হয়ে উঠত। বালক ঋভুর দুই কপোল সিক্ত হয়ে ওঠে তার অশ্রু
ধারায়। ঋভু কিছুই বলতে বা চাইতে পারতো না। সবশেষে ফাদার ঐদিন তার শত
ব্যস্ততার মধ্যেও ঋভুকে আলাদা করে কাছে ডেকে তার মাথায় হাত বুলিয়ে
আশীর্বাদ করে তাকে একটা সুন্দর কেক, মিষ্টি, চকোলেটের প্যাকেট ও নিজ হাতে
শুভেচ্ছা লিখে একটি ডায়েরি উপহার দিতেন। মফস্বলের বিদ্যুৎ হীন এলাকার
ছোট্ট চার্চ। বেলা থাকতে থাকতেই অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যেত। তবে বাড়ি ফিরেও আর
পাঁচটা দিনের চেয়ে ঐ দিনটা ঋভুর কছে হত সম্পুর্ণ অন্যরকম। এর রেশ থাকতো
পরবর্তী বেশ কয়েকদিন। ওর মনটা এক সুন্দর স্বর্গীয় আনন্দে যেন ভেসে যেত।
গত তিন চার বছর ধরে এটাই ছিল ঋভুর বড়দিনের রুটিন। কিন্তু এবার কি আর
যাওয়া হবে? বড়দিনতো এসেই গেল। কিন্তু গত কদিন ধরেই ঋভুর বেশ জ্বর, সর্দি,
কাশি, ভীষন ঠান্ডা লেগেছে। কবিরাজ মশাই বলেছেন টাইফয়েড। খুব সাবধানে
থাকতে হবে। সেই মুঠো ফোনহীন যুগে প্রায় দশ বারোদিন হয়ে গেল ফাদারের সঙ্গে
দেখা হয়নি। বাবা একটা ছোটদের বিবেকানন্দ বই কিনে দিয়েছেন। মাঝে মাঝে বইটা
উলতে পালটে পড়ে। কোন কিছুই যেন ভাল লাগে না, তেমন মন দিয়ে বইটা পড়তেও
ইচ্ছে করছে না। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে হটাত এক জায়গায় ওর চোখদুটো আটকে
যায়। সদ্য পিতৃ হারা নরেন যতই ভাবে দক্ষিনেশ্বরের ওই বূড়োটার কাছে আর
যাবে না। তবুও কেন না গিয়ে থাকতে পারে না? কি এক অমোঘ আকর্ষণে বার বার
ছুটে যায় ঠাকুরের কাছে।
গত কদিন শরীরটা বেশ সুস্থ লাগছে। কবিরাজ মশাইও অভয় দিয়েছেন। বড়দিনের এখন
কদিন বাকী আছে। এবারও তাহলে ও নিশ্চই চার্চে যেতে পারবে। সেই রাত্রে ঋভু
এক আশ্চর্য্য স্বপ্ন দেখলো। ফাদার দেমসার...... কি অপরূপ তার রূপ, দীর্ঘ,
অত্যন্ত গৌর বর্ণের শ্বেত শুভ্র শশ্রু শোভিত, সমগ্র শরীর শুভ্র গাউনে
আচ্ছাদিত। এক হাতে বাইবেল অন্য হাতটি ঋভুর মাথায় বোলাতে বোলাতে ফাদার
বললেন, কেমন আছো ঋভু? আবার বড়দিন এসে গেল। তোমাকে তো যেতেই হবে চার্চে।
তুমি না গেলে প্রভু রাগ করবেন যে!
ঋভু ফাদারকে দেখে অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে তার হাত দুটি ধরে বলতে গেল- হ্যা
ফাদার আমার যতই শরীর খারাপ হোক না কেন আমাকে যে যেতেই হবে। কিন্তু
ততক্ষনে ফাদার বললেন আমি চলি আমার সময় হয়ে এসেছে। ঋভুর ঘুম ভেঙ্গে
গেল,... আমার সময় হয়ে এসেছে মানে? চোখ খুলে দেখল ভোর হয়ে গেছে। আকাশ
পরিষ্কার হতে শুরু হয়েছে।
ঋভুর শরীরটা বেশ দুর্বল লাগছে। ঊঠে চোখে মুখে জল দিয়ে আবার বিছানায় গিয়ে
শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষন পরে একটু সকাল হতেই ওদের সদর দরজাটায় কে যেন কড়া নাড়া
দিল। ঋভুর বাবা দরজা খুলতেই এক ভদ্রলোক হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে বাড়িতে
ঢুকতেই... ঋভু উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে বলে উঠল- আরে এ তো চার্চের
বাদলদা। ...... কি খবর বাদলদা? জানো আজ ভোর রাত্রে আমি ফাদারকে স্বপ্নে
দেখেছি......। ফাদার কেমন আছেন, বাদলদা? কি ব্যাপার ... তুমি চুপ করে আছো
কেন?
বাদল আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো বাদলদা-----
ফাদার আর নেই দাদাবাবু। গত কাল সন্ধ্যার সময়ে অন্য দিনের মতই প্রার্থণা
করার সময়ে হটাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। পাড়ার পরাণ ডাক্তার দেখে বললেন সব
শেষ।
সঙ্গে সঙ্গে আমরা কলকাতার বড় চার্চে খবর পাঠাই। ওরা এসে দেহ নিয়ে চলে
গেল। কলকাতায় কোন এক গোরস্থানে নাকি গোর দেবে। আর বলে গেলেন দুই-এক দিনের
মধ্যেই নতুন ফাদার চলে আসবেন। ফাদার অনেকদিন তোমার কোন খবরর না পেয়ে
পড়শুদিন আমাকে এই প্যাকেটটা তোমার বাড়িতে পৌছে দিয়ে তোমার খবর নিয়ে যেতে
বলেছিলেন। আমি সময় করে আসতে পারিনি।
হটাৎ ঋভু যেন পাথর হয়ে গেছে, ও কান্না ভুলে গেছে। নিতান্ত অনিচ্ছায় হাতটা
বাড়িয়ে বাদলদার কাছ থেকে প্যাকেটটা নিল। তারপর খুলে দেখলো অন্যান্য বারের
মত এবারেও ওকে একটা ডায়েরি আর একটা পেন পাঠিয়েছেন ফাদার। আর তার প্রথম
পাতায় পরিষ্কার সুন্দর হস্থাক্ষরে লিখে দিয়েছেনঃ- My beloved Rivu...No
need to go to church for god, make your parents happy first to grt
your god........ with blessings from Fr. Loize Demsar

No comments:
Post a Comment