Sunday, December 24, 2017

ধারাবাহিক / স্বপ্নস্বরূপ - ১৩ / ন ন্দি নী সে ন গু প্ত


স্বপ্নস্বরূপ - ১৩
আজ এমন একটি বিষয় নিয়ে বলতে চাই, জানি না সে বিষয় এক পর্বে বলা সম্ভব কিনা। কিন্তু সম্ভব না হলেও, এটা বুঝতে পারছি যে এই কথা বলবার এই মুহূর্তে বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। অদ্ভুতভাবে কিছু চোরাস্রোত প্রবেশ করছে আমাদের সমাজজীবনে যেখান থেকে এরকম মত উঠে আসছে যে রবীন্দ্রনাথ সেই অর্থে সাম্প্রদায়িক না হলেও একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাসের ব্যাপারে বেশ জাজমেন্‌টাল ছিলেন। এই কালিমালেপন যে মৃত্যুর এত বছর পরেও তাকে সহ্য করতে হবে, সে কথা কে জানত? না, এই মুহূর্তে আর মানুষটি হৃদয়ের অন্তস্থলে কিরকম ভাব পুষে রেখেছিলেন, সে কথা জানা সম্ভব নয়। তবে তার বিভিন্ন লেখাপত্র থেকে জানা সম্ভব যে ঠিক কী ধরণের চিন্তা সমাজে ছড়িয়ে পড়া উচিত বলে তিনি ভেবেছিলেন। সমাজের মঙ্গলকামনায় তার মতো একজন শিক্ষাবিদের ধারণা কি ছিল এই বিষয়ে আজ উচ্চকিত কণ্ঠে বলবার সময় এসেছে।
আজ এই বিশ্বায়নের যুগে দাঁড়িয়েও বারে বারে পৃথিবীতে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে নানা বিভেদকামী শক্তি। তার ভাষাতেই বলি, ‘বাহিরের দিকে দরজা যতই খুলিতেছে, প্রাচীর যতই ভাঙিতেছে, মানুষের জাতিগুলির স্বাতন্ত্র্যবোধ ততই যেন আরো প্রবল হইয়া উঠিতেছে। এক সময় মনে হইত মিলিবার উপায় ছিল না বলিয়াই মানুষেরা পৃথক হইয়া আছে কিন্তু এখন মিলিবার বাধা সকল যথাসম্ভব দূর হইয়াও দেখা যাইতেছে পার্থক্য দূর হইতেছে না।' তিনি সত্যদ্রষ্টা ছিলেন। সমাজকে সতর্ক করেছেন তার বার্তার মধ্য দিয়ে বারবার। ভেদবুদ্ধি ছড়িয়েছেন বলে কোনও অর্বাচীন কোথাও বলবে না। তবুও যদি কেউ আজ বলে, ধরে নিতে হবে ক্ষুদ্রস্বার্থবুদ্ধি তাকে দিয়ে আজ বলিয়ে নিচ্ছে এই কথা।
সবার আগে কবি নিজেকে চিনে নেওয়ার চেষ্টায় রত ছিলেন। যিনি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে জানেন, বোঝেন যে তার ধর্ম কীভাবে তার অস্তিত্বকে ধারণ করে আছে, তিনি কি অন্যধর্মের প্রতি অসহিষ্ণু থাকতে পারেন? যার নিজের ব্রহ্মাণ্ডের ভরকেন্দ্র টলটলায়মান, তিনিই ক্ষিপ্ত হয়ে বিভেদকামিতাকে আমন্ত্রণ জানাবেন। সুখের কথা এবং শান্তির কথা, রবীন্দ্রনাথের সেরকম কোনও অবকাশ আসেনি।
না, রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ছিলেন না। তিনি ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী ছিলেন। কিন্তু হিন্দুধর্ম যে ক্ষুদ্র স্বার্থান্বেষী মানুষের ধর্ম নয়, সে বিষয়ে তার থেকে ভালো বিশ্লেষণ আর কেউ কোথাও করেছেন বলে চোখে পড়ে নি। বলেছেন, যা জীবনধর্মী, তা গতিশীলএর স্থিতির দিকে যেমন সংজ্ঞা আর অস্তিত্ব আছে, গতির দিকেও পাল্লা হাল্কা নয়। এখন যেকোনো একদিক থেকে একে বিচার করাই একচোখোমি। তিনি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। আমরা অন্ধ, মূক, বধির হয়ে আছি। কবি বলছেন, ‘যেসকল আচার আমাদের শাস্ত্রে এবং প্রথায় অহিন্দু বলিয়া গণ্য ছিল আজ কত হিন্দু তাহা প্রকাশ্যেই লঙ্ঘন করিয়া চলিয়াছে; কত লোককে আমরা জানি যাঁহারা সভায় বক্তৃতা দিবার ও কাগজে প্রবন্ধ লিখিবার বেলায় আচারের স্খলন লেশমাত্র সহ্য করিতে পারেন না অথচ যাঁহাদের পানাহারের তালিকা দেখিলে মনু ও পরাশর নিশ্চয়ই উদ্‌বিগ্ন হইয়া উঠিবেন এবং রঘুনন্দন আনন্দিত হইবেন না। সমস্ত বাঁধাবাঁধির মধ্যেও হিন্দুসমাজ একপ্রকার অর্ধচেতন ভাবে অনুভব করিতে পারে যে, বাহিরের এইসমস্ত পরিবর্তন হাজার হইলেও তবু বাহিরের — যথার্থ হিন্দুত্বের সীমা এইটুকুর মধ্যে কখনোই বদ্ধ নহে।’
আমরা হয়তো বা আজ ভুলতে বসেছি যে তিনি পদে পদে সতর্ক করে গিয়েছিলেন। বলে গিয়েছিলেন, ‘ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে...’। তিনি সম্যকরূপে ভারতবর্ষকে চেনবার একটা চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি জানতেন, ব্রিটিশ আমলেও এই সমস্যা নতুন কিছু ছিল না। তার কথায় ‘স্বদেশ ও স্বজাতি-রক্ষার জন্য হিন্দু এক হইতে পারে না, গোষ্ঠ এবং গোজাতি-রক্ষার জন্য চাই কি তাহারা এক হইতেও পারে। স্বাধীনতা স্বদেশ আত্মসন্মান মনুষ্যত্ব প্রভৃতি অনেক শ্রেষ্ঠতর পদার্থের অপেক্ষা গোরুকে রক্ষা করা যে আমাদের পরমতর কর্তব্য, এ কথা হিন্দু ভূপতি হইতে কৃষক পর্যন্ত সকলেই সহজে বুঝিবে।’ তিনি বুঝেছিলেন হিন্দুধর্মের বিপদের খানাখন্দ। বড় দুঃখের কথা, আমরা আজ স্বাধীনতার এত বছর পরেও বেরিয়ে আসতে পারি নি, চলতে পারি নি ভেদবুদ্ধির উর্ধে উঠে তার নির্দেশিত পথে।

(চলবে) 

1 comment:

  1. অসাধারণ ও সমসাময়িক একটই রচনা

    ReplyDelete

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া

সম্পাদকীয় ও চিত্রাঙ্কন-গৌতম সেন ... সম্পাদনা ও কারিগরী সহায়তা - নূপুর বড়ুয়া